২০১৫: বাংলাদেশের সেরা সাফল্য, অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম শিরোপা

এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা-ক্যারিবিয়ানে বিশ্বকাপ জেতা অস্ট্রেলিয়ার অপূর্ণতা ছিল নিজ দেশে। ২০১৫ আসরে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে টুর্নামেন্টের সফলতম দলটি ঘরের মাঠে জিতে নেয় পঞ্চম শিরোপা। এই আসরেই বাংলাদেশের ক্রিকেট পৌঁছায় নতুন উচ্চতায়। প্রথমবারের মতো খেলে কোয়ার্টার-ফাইনালে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2019, 01:36 PM
Updated : 25 May 2019, 01:45 PM

তাসমান পারের দুই দেশে এটি দ্বিতীয় আসর। ১৪ ভেন্যুতে হয় ৪৯ ম্যাচ। ফাইনালসহ ২৬ ম্যাচ হয় অস্ট্রেলিয়ায়, ২৩টি নিউ জিল্যান্ডে। ১৯৯২ সালে এখানে হয়ে যাওয়া বিশ্বকাপের পঞ্চম আসরে বদলে গিয়েছিল টুর্নামেন্টের গতিপথ। একাদশ আসর যেন বদলে দেয় ওয়ানডে ক্রিকেটকেই।

২০১৫ বিশ্বকাপকে বলা যায় রেকর্ডের বিশ্বকাপ। এই আসর হয়ে উঠেছিল ব্যাটসম্যানদের দাপট দেখানোর মঞ্চ। সব মিলিয়ে হয় ৩৮ সেঞ্চুরি। ছক্কা হয়েছিল ৪৬৩টি, প্রতি ৯ ওভারে একটি!

ম্যাচের ৩০তম ওভারে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্স খেলেন ৬৬ বলে ১৬২ রানের খুনে ইনিংস। দ্রুততম দেড়শ রানের আগের রেকর্ড থেকে তার লাগে ১৯ বল কম! জেসন হোল্ডার ১ উইকেট নিতে খরচ করেন ১০৪ রান, বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরুচে বোলিং।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে পার্থে ৬ উইকেটে ৪১৭ রান করে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপের ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ। সেই ম্যাচে ২৭৫ রানে জেতে স্বাগতিকরা, যা বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড। বিশ্বকাপে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও হয় সেবার। সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কা ম্যাচে ওঠে ৬৮৮ রান।

ক্রিস গেইলের হাত ধরে বিশ্বকাপ দেখে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যানবেরায় ক্যারিবিয়ান ওপেনার করেছিলেন ২১৫ রান। ওয়েলিংটনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অপরাজিত ২৩৭ রান করেন নিউ জিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিল। বিশ্বকাপে যা সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মারলন স্যামুলেসের সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে ৩৭২ রানের জুটি গড়েন গেইল যা বিশ্বকাপে যে কোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটি।

বিশ্বকাপের একাদশ আসর ৪০ বছর আগে হয়ে যাওয়া প্রথম আসরের চেয়ে দৈর্ঘ্যে তিনগুণ বড় ছিল। প্রায় দ্বিগুণ দল এতে অংশ নেয়। ছয় গুণের বেশি দর্শক মাঠে বসে খেলা দেখে। দুই স্বাগতিক দেশের ফাইনালে ছিল রেকর্ড ৯৩ হাজার ১৩ জন দর্শক। 

উপমহাদেশে হয়ে যাওয়া আগের আসরের ফরম্যাট, দল সংখ্যা কোনো কিছুতে পরিবর্তন আনা হয়নি। ১০ টেস্ট খেলুড়ে দেশের সঙ্গে ছিল বাছাই পর্ব পেরিয়ে আসা আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই সহ-স্বাগতিক। ভারতের পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে দেশের মাটিতে ফাইনালে জেতে অস্ট্রেলিয়া।

কোয়ার্টার-ফাইনালে উপস্থিত ছিল উপমহাদেশের চার দেশ- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। আগের বছরটি খুব বাজে কাটানো বাংলাদেশের শেষ আটে খেলা বেশ চমকপ্রদ। ফিটনেস ইস্যুতে বিতর্কিতভাবে ২০১১ বিশ্বকাপের দলে জায়গা না পাওয়া মাশরাফি বিন মুর্তজার অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্বে বাংলাদেশের ক্রিকেট ওঠে নতুন উচ্চতায়।

নকআউট পর্বে নিজেদের প্রথম জয়ের স্বাদ পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। সেমি-ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়ার চক্র ভেঙে প্রথমবারের মতো ফাইনালে পৌঁছায় নিউ জিল্যান্ড। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৫ বলে ৭৭ রান করার পথে দলটির অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ভাঙেন নিজেরই বিশ্বকাপের দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড। 

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের স্পর্শে আগেই বদলাতে শুরু করেছিল ব্যাটিংয়ের ধরন। ২০১১ আসরে উপমহাদেশের মন্থর উইকেটে এর খুব একটা প্রভাব পড়েনি। তবে অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে রীতিমতো ঝড় বয়ে যায় বোলারদের ওপর দিয়ে।

বিশ্বকাপের আগে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে কড়া অবস্থান নেয় আইসিসি। ত্রুটিপূর্ণ বোলিং অ্যাকশনের জন্য খেলার সুযোগ পাননি সাঈদ আজমল, সুনিল নারাইনরা।

টানা চার ম্যাচে সেঞ্চুরির ইতিহাস গড়েন কুমার সাঙ্গাকারা। বিশ্বকাপে তো বটেই, ওয়ানডে ক্রিকেটেই প্রথম। মাহমুদউল্লাহর হাত ধরে নিজেদের পঞ্চম আসরে এসে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পায় বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন অঙ্ক ছোঁয়ার পর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেও সেঞ্চুরি করেন মাহমুদউল্লাহ।

১৯৮৭ আসরের ফাইনালে বাঁহাতি স্পিনারকে রিভার্স সুইপ খেলে আউট হয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের মাইক গ্যাটিং। সেখানে বাঁহাতি পেসারদের বিপক্ষে ইচ্ছেমত রিভার্স শট খেলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। অফ স্টাম্পের এক গজ দূরে দাঁড়িয়ে স্লগ সুইপ করে ডিপ ফাইন লেগ দিয়ে ছক্কায় উড়িয়েছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। ৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটিংয়ের দুর্দান্ত প্রদর্শনী সাজিয়ে বসেছিলেন যেন তিনি।

‘এ’ গ্রুপে দুই স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে ছিল বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ড।

সব ম্যাচ জিতে সেরা দল হিসেবে শেষ চারে যায় নিউ জিল্যান্ড। তাদের বিপক্ষেই আসে অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র হারটি। বৃষ্টির বাধায় ভেসে যায় বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের ম্যাচ। দুই স্বাগতিক ও বাংলাদেশের সঙ্গে কোয়ার্টার-ফাইনালে যায় শ্রীলঙ্কা। মাত্র দুটি জয় পাওয়া ইংল্যান্ড ছিটকে যায় গ্রুপ পর্ব থেকে। সেখানে তাদের সঙ্গী আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ড।

‘বি’ গ্রুপে আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ভারতের সঙ্গী ছিল পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

সব ম্যাচ জিতে গ্রুপ সেরা হয়ে কোয়ার্টার-ফাইনালে যায় ভারত। চারটি করে জয় পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তান ছিল পরের দুটি স্থানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে রান রেটে পিছিয়ে থাকায় একটুর জন্য শেষ আটে যেতে পারেনি আয়ারল্যান্ড।

চার কোয়ার্টার-ফাইনালই ছিল একপেশে। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৯৪ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেমে যায় ২৫০ রানে। শ্রীলঙ্কাকে ১৩৩ রানে গুঁড়িয়ে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা পায় বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে নিজেদের প্রথম জয়। পাকিস্তানকে ২১৩ রানে থামিয়ে অস্ট্রেলিয়া জেতে ৬ উইকেটে। ওয়াহাব রিয়াজের দুর্দান্ত স্পেল উত্তেজনা ছড়ালেও ম্যাচের ফলে এর প্রভাব ছিল সামান্যই।

ভারতের বিপক্ষে আশা জাগিয়েছিল বাংলাদেশ। ২৮ ওভারে ১১৫ রানে ফিরিয়ে দিয়েছিল তিন ব্যাটসম্যানকে। সুরেশ রায়নাকে নিয়ে জুটি গড়ে দলকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন রোহিত। রানের গতিতে দম দেওয়ার আগেই তার উইকেট পেতে পারতো বাংলাদেশ।

রুবেল হোসেনের করা ৪০তম ওভারের চতুর্থ বলটি ছিল ফুলটস। ডিপ মিডউইকেট দিয়ে উড়ানোর চেষ্টায় ধরা পড়েন রোহিত। কিন্তু তৃতীয় আম্পায়ারের সঙ্গে কোনো আলোচনায় না গিয়ে সরাসরি ‘নো’ বল ডাকেন আম্পায়ার। রিপ্লেতে দেখা যায়, ‘নো’ ছিল না রুবেলের বলটি। ‘জীবন’ পান রোহিত। সেই কাণ্ডের পর বোলিংয়ে ছন্দ হারানো বাংলাদেশ পায় তিনশ ছাড়ানো লক্ষ্য। পরে ব্যাটিং ব্যর্থতায় হেরে যায় ১০৯ রানের বড় ব্যবধানে।

‘সেমি-ফাইনালের দল’ নিউ জিল্যান্ড এবার থামেনি শেষ চারে। ব্রেন্ডন ম্যাককালামের উজ্জ্বীবিত নেতৃত্ব আর দারুণ সব ক্রিকেটারে গড়া দলটি অকল্যান্ডে ডি ভিলিয়ার্সের দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো পৌঁছায় ফাইনালে। বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধতিতে নিউ জিল্যান্ডের জয়ের নায়ক জোহানেসবার্গে জন্ম নেওয়া অলরাউন্ডার গ্রান্ট এলিয়ট। ২৯৮ রানের লক্ষ্য তাড়া করে জেতে নিউ জিল্যান্ড, যা বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে সর্বোচ্চ।

অন্য সেমি-ফাইনাল জমেনি মোটেও। সিডনিতে ভারতকে ৯৫ রানে হারিয়ে এক আসর বাদে ফাইনালে পৌঁছায় অস্ট্রেলিয়া। ৩২৯ রানের বড় লক্ষ্য তাড়ায় ২৩৩ রানে গুটিয়ে যায় ভারত।

২৯ মার্চ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড বা এমসিজিতে মুখোমুখি হয় টুর্নামেন্টের সেরা দুই দল নিউ জিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। ম্যাককালামের উজ্জ্বীবিত নেতৃত্ব, মার্টিন গাপটিলের বিস্ফোরক শুরু, ট্রেন্ট বোল্টের সুইং, অলরাউন্ডারদের উপস্থিতিতে দুর্দান্ত ভারসাম্য। ফাইনালের আগ পর্যন্ত টুর্নামেন্টের একমাত্র অপরাজিত দলটি বুক বেঁধেছিল প্রথম শিরোপা-স্বপ্নে।

অন্য দিকে মিচেল স্টার্ক, মিচেল জনসন ও জেমস ফকনারে গড়া অস্ট্রেলিয়ার ত্রিমুখী বাঁহাতি পেস আক্রমণের সামনে খুব কম ব্যাটসম্যানই দাঁড়াতে পেরেছিলেন। ষোলোর নিচে গড়ে ৪৭ উইকেট নেন তারা তিন জন, ওভার প্রতি খরচ করেন সাড়ে চারের কম। রান উৎসবের বিশ্বকাপে যেটা প্রায় অবিশ্বাস্য।

টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা ম্যাচে গ্রুপ পর্বে ইডেন পার্কে অস্ট্রেলিয়াকে ১ উইকেটে হারিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। কিন্তু ফাইনালটা হয় একপেশে। ফকনার-জনসন-স্টার্কের ছোবলে ১৮৩ রানে গুটিয়ে যায় নিউ জিল্যান্ড। দলকে টানেন কেবল এলিয়ট। খেলেন ৮২ বলে ৮৩ রানের দাপুটে ইনিংস।

রান তাড়ায় দলকে শুরুতে পথ দেখান ডেভিড ওয়ার্নার। শতরানের জুটিতে অস্ট্রেলিয়াকে টানেন মাইকেল ক্লার্ক ও স্টিভেন স্মিথ। ৭ উইকেটের জয়ে পঞ্চম শিরোপা জয়ের উৎসবে মাতে অস্ট্রেলিয়া।

সবচেয়ে বেশি রান:

ব্যাটসম্যান/দেশ

ম্যাচ

রান

সেরা

গড়

১০০/৫০

মার্টিন গাপটিল/নিউ জিল্যান্ড

৫৪৭

২৩৭*

৬৮.৩৭

২/১

কুমার সাঙ্গাকারা/শ্রীলঙ্কা

৫৪১

১২৪

১০৮.২০

৪/০

এবি ডি ভিলিয়ার্স/দক্ষিণ আফ্রিকা

৪৮২

১৬২*

৯৬.৪০

১/৩

ব্রেন্ডন টেইলর/জিম্বাবুয়ে

৪৩৩

১৩৮

৭২.১৬

২/১

শিখর ধাওয়ান/ভারত

৪১২

১৩৭

৫১.৫০

২/১

সবচেয়ে বেশি উইকেট:

বোলার/দেশ

ম্যাচ

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

মিচেল স্টার্ক/অস্ট্রেলিয়া

২২

৬/২৮

১০.১৮

৩.৫০

ট্রেন্ট বোল্ট/নিউ জিল্যান্ড

২২

৫/২৭

১৬.৮৬

৪.৩৬

উমেশ যাদব/ভারত

১৮

৪/৩১

১৭.৮৩

৪.৯৮

মোহাম্মদ সামি/ভারত

১৭

৪/৩৫

১৭.২৯

৪.৮১

মর্নে মর্কেল/দক্ষিণ আফ্রিকা

১৭

৩/৩৪

১৭.৫৮

৪.৩৮