২০০৭ বিশ্বকাপ: হ্যাটট্রিক শিরোপায় অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস

মহাদেশ বদলায়, ভেন্যু বদলায় কিন্তু বদলায় না অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ব জয়ের পথচলা। থামে না ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করা দেশটির দাপট। ক্যারিবিয়ানে জিতে ইতিহাসের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র দল হিসেবে হ্যাটট্রিক শিরোপা ঘরে তোলে অস্ট্রেলিয়া। আগের আসরের দুঃস্বপ্ন ভুলে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। তারুণ্যের আলোয় দলটি প্রথমবারের মতো পার হয় গ্রুপ পর্বের গণ্ডি।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2019, 12:17 PM
Updated : 24 May 2019, 12:17 PM

টুর্নামেন্ট শুরুর তিন দশকের বেশি সময় পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজে হয় ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ১৩ মার্চ থেকে ২৮ এপ্রিল হয়ে যাওয়া নবম আসরে অংশ নেয় ১৬ দেশ। আগের আসরের চেয়ে দল দুটি বাড়লেও ম্যাচ কমে যায় তিনটি। 

বিশ্বকাপের ফরম্যাট নিয়ে আইসিসির পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এবার দেখা মেলে সুপার এইটের। চার গ্রুপে অংশ নেয় চারটি করে দল। সেরা দুই দল যায় পরের ধাপে। সুপার এইটের সেরা চার দল খেলে সেমি-ফাইনালে। আট ভেন্যুতে সব মিলিয়ে ম্যাচ হয় ৫১টি।

১০ টেস্ট খেলুড়ে দেশের সাথে সরাসরি বিশ্বকাপের টিকেট পায় আগেই ওয়ানডে মর্যাদা পাওয়া কেনিয়া। ২০০৫ আইসিসি ট্রফির মাধ্যমে আসে স্কটল্যান্ড, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও বারমুডা। এর মধ্যে শেষ দুটি দলের জন্য এটি ছিল বিশ্বকাপ অভিষেক।

এই বিশ্বকাপে মাত্র তিন জন বোলার নেন ইনিংসে পাঁচ উইকেট। তিনজনই ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার- অ্যান্ড্রু হল, চার্লস ল্যাঙ্গেভেল্ট ও আন্দ্রে নেল।  

‘এ’ গ্রুপে শেষ দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গী ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, স্কটল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। ‘বি’ গ্রুপে উপমহাদেশের তিন দেশ বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গী ছিল বারমুডা। ‘সি’ গ্রুপে ইংল্যান্ড-নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে ছিল দুই সহযোগী দেশ কেনিয়া-কানাডা। ‘ডি’ গ্রুপে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ছিল পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ড।

১৯৯৯ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে যে অজেয় যাত্রা শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার তা চলতে থাকে ২০০৭ আসরেও। বিশ্বকাপে অপরাজিত থাকার রেকর্ড ২৯ ম্যাচে নিয়ে যায় টানা তৃতীয় ও সব মিলিয়ে চতুর্থ শিরোপা জেতা দেশটি। টানা তিন আসরের ফাইনালে উপমহাদেশের তিন দলকে হারায় অস্ট্রেলিয়া। পাকিস্তান, ভারতের পর এবার শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারায় তারা।

ক্যারিবিয়ানে পৌঁছানোর পর অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাকগ্রা জানান, ২০০৩ আসরে তাদের লক্ষ্য ছিল শিরোপা জয়। এবার লক্ষ্য দাপট ধরে রাখা। শুধু কথায় নয়, পারফরম্যান্সেও ছিল সেই তাড়না।

কতটা দাপুটে ছিল তারা, পরিসংখ্যানে মেলে প্রমাণ। ১১ ম্যাচের সবকটি জিতে হয় অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। ফাইনালে যাওয়ার পথে যখনই আগে ব্যাট করেছে, গড়েছে তিনশ ছাড়ানো সংগ্রহ। বিরূপ আবহাওয়ার জন্য ৩৮ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে তুলেছিল তারা ২৮১ রান! কখনও ছয় উইকেটের বেশি হারায়নি। দুইশর বেশি রানে জিতেছে তিনবার। সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের সেরা দশে ছিল অস্ট্রেলিয়ার চার ব্যাটসম্যান, সর্বোচ্চ উইকেটশিকারীদের সেরা সাতে ছিল তাদের চারজন।

স্বাগতিকদের স্লোগান ছিল, ‘সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ’। বাস্তবে হয়েছে সবচেয়ে বাজে। তাদের আয়োজনের ব্যর্থতাটা ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্যারিবিয়ানদের জীবনধারার সঙ্গে ছিল না কোনো সামঞ্জস্য। অব্যবস্থাপনা ছিল পদে পদে। একপেশে ম্যাচের সংখ্যা ছিল ভুরি ভুরি। আবার গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের কাছে হেরে ভারত এবং আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে পাকিস্তান বিদায় নেওয়ায় এই দুই দেশের অনেকের কাছেই আকর্ষণ হারায় বিশ্বকাপ।

বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড সুপার এইটে ওঠায় সেখানেও একপেশে ম্যাচের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ যদিও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে টুর্নামেন্টে চমক উপহার দেয় দ্বিতীয়বার। কিন্তু কার্যত সেমি-ফাইনালে খেলার সম্ভাবনা জাগাতে পারেনি কখনো। বাকি ছয় দলের মধ্যেই সীমিত ছিল সেই লড়াই।

মাঠের ক্রিকেট যেমনই হোক, আমুদে ক্যারিবিয়ান দর্শকে গ্যালারি রঙিন হওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু সেটি রঙচটা হয়ে যায় আইসিসির অবিশ্বাস্য এক সিদ্ধান্তে। ঢোল-বাদ্য নিয়ে দর্শকদের স্টেডিয়ামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে তারা! সঙ্গে ছিল চড়া মূল্যের টিকেট। সব মিলিয়ে নিজ দেশের বিশ্বকাপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ক্যারিবিয়ানরা।

ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচের আবহে অবশ্য বিষাদের ছায়ায় ঢেকে ছিল হাবিবুল বাশারের দল। দেশ থেকে উড়ে আসে মানজারুল ইসলামের মৃত্যুসংবাদ। এই বাঁহাতি স্পিনার খুব সহজেই স্কোয়াডের অংশ হয়ে উড়ে আসতে পারতেন ক্যারিবিয়ানে। অল্পের জন্য চূড়ান্ত দলে জায়গা হয়নি। খুলনায় সড়ক দুর্ঘটনায় মানজারুলের মৃত্যুর খবর ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে পৌঁছে ভারতের বিপক্ষে খেলার আগের দিন।

শোককে শক্তিতে পরিণত করে সেদিন মাঠে নামে হাবিবুলের দল। দুর্দান্ত বোলিংয়ে সুরটা বেঁধে দেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। চার উইকেট নিয়ে লক্ষ্যটা রাখেন হাতের নাগালে। তিন তরুণ তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসানের ফিফটিতে ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপকেই কাঁপিয়ে দেয় বাংলাদেশ। আর ওই এক ম্যাচের ফলে বাংলাদেশ সুপার এইটে ওঠার পথে এবং ভারত বিদায়ের পথে এগিয়ে যায় অনেকখানি। শ্রীলঙ্কার কাছে হারলেও বারমুডাকে হারিয়ে ঠিকই ‘বি’ গ্রুপ থেকে প্রথম পর্ব পেরোয় বাশারের দল। ওদিকে বাংলাদেশের পর শ্রীলঙ্কার কাছেও হেরে ছিটকে পড়ে ভারত।

‘এ’ গ্রুপে ঘটেনি কোনো অঘটন। নেদারল্যান্ডস-স্কটল্যান্ডকে পিছু ফেলে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা ওঠে সুপার এইটে। ‘সি’ গ্রুপেও কেনিয়া-কানাডাকে রেখে ওঠে নিউ জিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। কিন্তু ‘ডি’ গ্রুপে ঘটে যায় বড়সড় অঘটন। স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ তিন জয়ে পরবর্তী পর্ব নিশ্চিত করলেও পাকিস্তান পারেনি তাদের সঙ্গী হতে। তাদের হারানো আয়ারল্যান্ড জায়গা করে নেয় সেরা আটে। তবে এর চেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে মাঠের বাইরে। আইরিশদের কাছে হারের কয়েক ঘন্টা পর হোটেল কক্ষে পাওয়া যায় পাকিস্তানের কোচ বব উলমারের মৃতদেহ।

মোহাম্মদ আশরাফুলের দারুণ ব্যাটিংয়ে সুপার এইটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এর আগে-পরে সুপার এইটের সব খেলায় হারে তারা; এমনকি আয়ারল্যান্ডের কাছেও। এই পর্বেই স্বপ্নযাত্রা থেমে যায় এই দুটি দলের। সঙ্গে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ডেরও। ক্যারিবিয়ানদের বিদায়ের পর সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে ব্রায়ান লারা স্বাগতিকদের বিষাদ দেন বাড়িয়ে।

সেমি-ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে সহজেই হারায় সাত উইকেটে। আগে ব্যাটিং করা প্রোটিয়ারা ২৭ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে শুরুতেই চাপে পড়ে যায়। সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে ১৪৯ পর্যন্ত যেতে পারে তারা। অন্য সেমি-ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডকে ৮১ রানে হারিয়ে ১৯৯৬ সালের পর প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠে শ্রীলঙ্কা।

প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোনো ফাইনাল হয় ‘রি-ম্যাচ’। আর তাতে প্রতিশোধ নেয় অস্ট্রেলিয়া। বৃষ্টিতে ৩৮ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে ১০৪ বলে ১৪৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। অস্ট্রেলিয়া তোলে ৪ উইকেটে ২৮১ রান। রান তাড়ায় দ্বিতীয় উইকেটে সনাৎ জয়াসুরিয়া ও কুমার সাঙ্গাকারার ১১৬ রানের জুটিতে ভালোই জবাব দিচ্ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু তাদের আউটের পর আস্কিং রেটের সঙ্গে আর পাল্লা দিতে পারেনি শ্রীলঙ্কা।

শেষটাও ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের জন্য ছিল বিব্রতকর। আরেক দফা বৃষ্টিতে শ্রীলঙ্কার সামনে পুনঃনির্ধারিত লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৬ ওভারে ২৬৯ রান। ৩৩ ওভারে আলোর স্বল্পতায় দুই আম্পায়ার স্টিভ বাকনর-আলিম দার যখন খেলা বন্ধ ঘোষণা করেন, ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে তখন ৩৭ রানে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া। নূন্যতম ২০ ওভার যেহেতু ব্যাটিং হয়ে গেছে, বিশ্বকাপ জয়ের উল্লাসে তাই মেতে ওঠে পন্টিংয়ের দল। স্কোরবোর্ডে অভিনন্দন জানানো হয় অস্ট্রেলিয়াকে। দুই আম্পায়ার বাধ সাধেন সেই উৎসবে। জানান, ম্যাচ শেষ হয়নি। খেলতে হবে শেষ তিন ওভার। এদিন খেলা সম্ভব না হলে সেই তিন ওভার হবে রিজার্ভ ডেতে।

স্পিনারদের দিয়ে বোলিং করিয়ে সেদিনই খেলা শেষ করার ব্যাপারে একমত হন দুই অধিনায়ক পন্টিং ও জয়াবর্ধনে। প্রায় অন্ধকারের মধ্যেই হয় শেষ তিনটি ওভার। প্রয়োজন ছিল ৬৩ রান, শ্রীলঙ্কা তুলতে পারে কেবল ৯ রান। ৮ উইকেটে ২১৫ রানে থামে জয়াবর্ধনের দল। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল জেতে ৫৩ রানে।

সবচেয়ে বেশি রান:

ব্যাটসম্যান/দেশ

ম্যাচ

রান

সেরা

গড়

১০০/৫০

ম্যাথু হেইডেন/অস্ট্রেলিয়া

১১

৬৫৯

১৫৮

৭৩.২২

৩/১

মাহেলা জয়াবর্ধনে/শ্রীলঙ্কা

১১

৫৪৮

১১৫*

৬০.৮৮

১/৪

রিকি পন্টিং/অস্ট্রেলিয়া

১১

৫৩৯

১১৩

৬৭.৩৭

১/৪

স্কট স্টাইরিস/নিউ জিল্যান্ড

১০

৪৯৯

১১১*

৮৩.১৬

১/৪

জ্যাক ক্যালিস/দক্ষিণ আফ্রিকা

১০

৪৮৫

১২৮*

৮০.৮৩

১/৩

সবচেয়ে বেশি উইকেট:

বোলার/দেশ

ম্যাচ

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

গ্লেন ম্যাকগ্রা/অস্ট্রেলিয়া

১১

২৬

৩/১৪

১৩.৭৩

৪.৪১

মুত্তিয়া মুরালিধরন/শ্রীলঙ্কা

১০

২৩

৪/১৯

১৫.২৬

৪.১৪

শন টেইট/অস্ট্রেলিয়া

১১

২৩

৪/৩৯

২০.৩০

৫.৫২

ব্র্যাড হগ/অস্ট্রেলিয়া

১১

২১

৪/২৭

১৫.৮০

৪.০০

লাসিথ মালিঙ্গা/শ্রীলঙ্কা

১৮

৪/৫৪

১৫.৭৭

৪.৮৬