শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয় এখনও ক্রিকেটের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর আখ্যানগুলোর একটি। শুধু চ্যাম্পিয়ন হওয়াই নয়, লঙ্কানদের আগ্রাসী ও বিনোদনদায়ী ক্রিকেট রাঙিয়েছিল বিশ্বকাপ। ওয়ানডে ক্রিকেটের ঘরানায় যোগ করেছিল নতুন মাত্রা।
১৯৯৬ বিশ্বকাপের অন্যতম স্বাগতিকও ছিল শ্রীলঙ্কা। প্রথমবারের মতো তিন দেশে বসে বিশ্বসেরার আসর। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে শ্রীলঙ্কাও ছিল অন্যতম আয়োজক। তবে স্বাগতিকের স্বাদ তারা পেয়েছিল সামান্যই।
কেবল চারটি ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল শ্রীলঙ্কায়। তার দুটিই হলো না, অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে দ্বীপ দেশটিতে যেতেই রাজি হলো না!
টুর্নামেন্ট শুরুর সপ্তাহ তিনেক আগে কলম্বোয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের সামনে তামিল টাইগারদের বোমা বিস্ফোরণে হতাহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় হাজার। নিরাপত্তার শঙ্কায় অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়। লঙ্কান সরকারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাস, আইসিসির নিরাপত্তার অনুমোদনেও মত বদলায়নি তাদের। নিয়ম অনুযায়ী গ্রুপের ওই দুটি ম্যাচে জয়ী ঘোষণা করা হয় শ্রীলঙ্কাকে।
তবে উপহার পাওয়া সেই পয়েন্টে মিশে ছিল খানিকটা অপমানের যন্ত্রণাও। সেই জেদ যেন আরও বেগবান করেছিল লঙ্কানদের ইতিহাস গড়ার তাড়নাকে।
তিন দেশ মিলিয়ে সেবার ২৭ ভেন্যুতে হয় ৩৭ ম্যাচ। ভারতে ১৭ ম্যাচ ছিল ১৭টি ভিন্ন ভেন্যুতে!
১৯৯২ সালে জিম্বাবুয়ে টেস্ট পরিবারের সদস্যপদ পাওয়ার পর পরিবর্তন আনা হয় ফরম্যাটে। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের দাবিকে মেনে ১২ দলের বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বাইরে আইসিসি ট্রফি থেকে তিনটি দলকে সুযোগ দেওয়া হয় বিশ্বসেরার আসরে নাম লেখানোর।
১৯৭৯ সাল থেকে আইসিসি ট্রফি খেলে আসা বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন এবার রঙিন হয়ে ওঠে সত্যিকার অর্থেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশার সেই পুরোনো গল্পই রচিত হয় কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে। দ্বিতীয় রাউন্ডে শুরুতে নেদারল্যান্ডস ও পরে কেনিয়ার কাছে হেরে বাংলাদেশ উঠতে পারেনি সেমি-ফাইনালেই। বাছাই পেরিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপের টিকেট পায় কেনিয়া, নেদারল্যান্ডস ও একগাদা অভিবাসী ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া দল সংযুক্ত আরব আমিরাত।
১২ দলকে রাখা হয় দুটি গ্রুপে। ‘এ’ গ্রুপে দুই স্বাগতিক ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গী ছিল অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া। ‘বি’ গ্রুপে আরেক স্বাগতিক পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নেদারল্যান্ডস। টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো রাখা হয় কোয়ার্টার-ফাইনাল।
সনাৎ জয়াসুরিয়া ও রুমেশ কালুভিতারানা জুটির পিঞ্চ হিটিং ও গোটা দলের আগ্রাসী ক্রিকেট দিয়ে চমক দেখায় শ্রীলঙ্কা। অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়াকওভার এবং ভারত, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়ার বিপক্ষে বাকি তিন ম্যাচ জিতে ‘এ’ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠে শ্রীলঙ্কা।
তিনটি করে ম্যাচ জিতে শেষ আটে ওঠে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। দুই বারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই ম্যাচ জিতে কোনোরকমে পায় শেষ আটের ঠিকানা। ক্যারিবিয়ানদের তিন হারের একটি ছিল কেনিয়ার বিপক্ষে। ১৬৬ রানের পুঁজি নিয়েও কেনিয়া পায় বড় জয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুটিয়ে দেয় ৯৩ রানে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা অঘটন হিসেবে সেটি স্বীকৃত এখনও।
‘বি’ গ্রুপে বোমা হামলার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, মাঠের ক্রিকেটেও ছিল না অঘটন। টানা পাঁচ ম্যাচ জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের ঘোষণা করে টুর্নামেন্ট ‘ফেভারিট’ হিসেবে। চার, তিন ও দুই জয় নিয়ে যথাক্রমে পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড নিশ্চিত করে কোয়ার্টার-ফাইনাল। গ্রুপের প্রথম ম্যাচে আসরের প্রথম সেঞ্চুরি উপহার দেন নিউ জিল্যান্ডের ন্যাথান অ্যাস্টল।
গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ১৮৮ রান করে প্রোটিয়া ওপেনার গ্যারি কার্স্টেন গড়েন বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড।
আকাশে উড়তে থাকা এই দক্ষিণ আফ্রিকাকে মাটিতে নামিয়ে আনে ধুঁকতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ব্রায়ান লারা! কোয়ার্টার-ফাইনালে তার চোখ ধাঁধানো সেঞ্চুরিতে শেষ আটেই থেমে যায় প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপ অভিযান। জয়াসুরিয়ার খুনে ইনিংসে ইংলিশদের গুঁড়িয়ে শ্রীলঙ্কা প্রথমবার পা রাখে শেষ চারে। নিউ জিল্যান্ডের ক্রিস হ্যারিসের সেঞ্চুরি বিফল করে দিয়ে টুর্নামেন্টে মার্ক ওয়াহর তৃতীয় সেঞ্চুরি অস্ট্রেলিয়াকে তোলে সেমি-ফাইনালে।
কোয়ার্টার-ফাইনালে উত্তেজনার সবচেয়ে বেশি বারুদ জমা ছিল অবশ্য বেঙ্গালুরুতে। মুখোমুখি হয় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। খেলার ঠিক আগে চোটের কারণে ম্যাচ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন পাকিস্তান অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম। অনেকটা নাটকীয়তার ম্যাচে ভারতের কাছে হেরে যায় পাকিস্তান। ইচ্ছে করে ম্যাচ না খেলার অভিযোগ তুলে পাকিস্তানি সমর্থকেরা প্রায় শূলে চড়ায় আকরামকে। আক্রমণ করা হয় এই বাঁহাতি পেসারের বাড়িতে। ক্রিকেটারদের দেশে ফিরতে হয় অনেকটা লুকিয়ে।
শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ভারতের ফাইনালে ওঠার সাক্ষী হতে ইডেনে ছিল লাখখানেক দর্শক। ম্যাচের প্রথম ওভারে জাভাগাল শ্রীনাথ যখন জয়সুরিয়া ও কালুভিথারানাকে আউট করেন, তাদের উচ্ছ্বাস ছুঁতে চায় যেন আকাশ। কিন্তু প্রতি-আক্রমণে অরবিন্দ ডি সিলভার ৬৬ রানের ইনিংস ম্যাচে ফেরায় শ্রীলঙ্কাকে। শেষ পর্যন্ত ৮ উইকেটে ২৫১ রান তোলে তারা।
ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপের জন্য লক্ষ্য নাগালের বাইরে ছিল না। কিন্তু এক শচীন টেন্ডুলকার ছাড়া দাঁড়াতেই পারলেন না কেউ। রাতের ইডেনে বল টার্ন করতে থাকে ভয়ঙ্করভাবে। ম্যাচে ৬৫ আর টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৫২৩ রান করে টেন্ডুলকার আউট হয়ে যাওয়ার পরই অনেকটা নির্ধারিত হয়ে যায় ম্যাচের ভাগ্য।
১২০ রানের মধ্যে ভারতের ৮ উইকেট পড়ে যাওয়ায় পরাজয় অবধারিত জেনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে কিছু দর্শক। গ্যালারির নানা জায়গায় ধরিয়ে দেয় আগুন। নিরাপত্তাজনিত কারণে ক্রিকেটারদের নিয়ে মাঠ ছাড়েন আম্পায়াররা, বিজয়ী ঘোষণা করা হয় শ্রীলঙ্কাকে।
অন্য সেমি-ফাইনালটি মাঠের ক্রিকেটেই হয়ে ওঠে তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ। ফেভারিট অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচের বেশিরভাগ সময় চাপে রেখেও শেষ পর্যন্ত নির্মম হারের বেদনায় পুড়তে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
মোহালিতে কার্টলি অ্যামব্রোস ও ইয়ান বিশপের আগুনে প্রথম স্পেলে ১৫ রানে ৪ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। পরে স্টুয়ার্ট ল ও মাইকেল বেভানের ফিফটিতে তারা যেতে পারে ২০৭ রান পর্যন্ত। রান তাড়ায় শিবনারায়ন চন্দরপল, লারা ও রিচি রিচার্ডসনের ব্যাটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল সহজ জয়ের পথে। এক পর্যায়ে রান ছিল তাদের ২ উইকেটে ১৬৫।
কিন্তু এরপর কিছুটা নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং, কিছুটা শেন ওয়ার্নের জাদুকরী বোলিং আর অস্ট্রেলিয়ার হার না মানা মানসিকতা, সব মিলিয়ে পাল্টে যায় ম্যাচের মোড়। ৩৭ রানের মধ্যে শেষ ৮ উইকেট হারিয়ে ৫ রানে ম্যাচ হেরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা ওয়ার্ন।
ম্যাচের এক পর্যায়ে রিচার্ডসনের সুইপ শট লেগ আম্পায়ার বিসি কুরের হ্যাটে লাগলে নিশ্চিত বাউন্ডারি থেকে বঞ্চিত হয় ক্যারিবিয়ানরা, পরে যেটি হয়ে ওঠে ম্যাচের প্রেক্ষাপটে মহামূল্য রান।
রিচার্ডসন শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ৪৯ রানে। তবে হারের দায় অনেকে দিয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ককেও। শেষ ওভারে যখন প্রয়োজন ১০ রান, ড্যামিয়েন ফ্লেমিংয়ের প্রথম বলেই মারেন বাউন্ডারি। কিন্তু পরের বলেই মেজাজ হারালেন। অযথা ঝুঁকিপূর্ণ সিঙ্গেল নিতে গিয়ে রান আউট কার্টলি অ্যামব্রোস। রিচার্ডসন হারালেন স্ট্রাইকও। সেটি আর তিনি ফিরে পাননি। তৃতীয় বলেই কোর্টনি ওয়ালশকে বোল্ড করে ম্যাচ শেষ করে দেন ফ্লেমিং।
ফাইনালকে ঘিরে উত্তেজার পারদ যতটা উঁচুতে উঠেছিল, ম্যাচে মেটেনি সেই প্রত্যাশা। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়াকে সেভাবে পাত্তাই দেয়নি শ্রীলঙ্কা।
টস জিতে লঙ্কান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা বোলিং নিয়ে চমকে দেন সবাইকে। বড় ম্যাচে রান তাড়া সবসময়ই চাপের, আগের পাঁচ ফাইনালে কখনোই জেতেনি পরে ব্যাট করা দল।
অধিনায়ক মার্ক টেলরের ৭৪ রানের ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া তোলে ২৪১ রান। অফ স্পিনে ৯ ওভারে অরবিন্দ ডি সিলভা ৪২ রানে নেন তিন উইকেট। নিয়েছিলেন দারুণ দুটি ক্যাচও। তবে সেসব পরে আর কে মনে রাখে! তার ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের স্মৃতিটাই যে জ্বলজ্বলে সবার মনে!
ফাইনাল হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু চ্যালেঞ্জ জমলই না। শুরুতে শ্রীলঙ্কা দুই ওপেনারকে হারালেও ডি সিলভা ও অসাঙ্কা গুরুসিনহার ১২৫ রানের জুটি দলকে এগিয়ে নিল জয়ের পথে। রানাতুঙ্গা নেমে শেষ করলেন কাজ। অবিচ্ছিন্ন ৯৭ রানের জুটিতে লঙ্কান অধিনায়ক যখন জয়সূচক রান নিচ্ছেন, ডি সিলভা তখন অপরাজিত ১০৭ রানে।
ডেভ হোয়াটমোরের কোচিং ও রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা গড়ে ইতিহাস। সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে ম্যাচ সেরা হয়ে সেই ইতিহাস গড়ার নায়ক ডি সিলভা। খ্যাপাটে ব্যাটিং আর কার্যকর স্পিন দিয়ে টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার ফাইনালের আগেই নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন জয়াসুরিয়া।
সবচেয়ে বেশি রান:
ব্যাটসম্যান/দেশ | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় | ১০০/৫০ |
শচীন টেন্ডুলকার/ভারত | ৭ | ৫২৩ | ১৩৭ | ৮৭.১৬ | ২/৩ |
মার্ক ওয়াহ/অস্ট্রেলিয়া | ৭ | ৪৮৪ | ১৩০ | ৮০.৬৬ | ৩/১ |
অরবিন্দ ডি সিলভা/শ্রীলঙ্কা | ৬ | ৪৪৮ | ১৪৫ | ৮৯.৬০ | ২/২ |
গ্যারি কারস্টেন/দক্ষিণ আফ্রিকা | ৬ | ৩৯১ | ১৮৮ | ৭৮.২০ | ১/১ |
সাঈদ আনোয়ার/পাকিস্তান | ৬ | ৩২৯ | ৮৩* | ৮২.২৫ | ০/২ |
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
বোলার/দেশ | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি |
অনিল কুম্বলে/ভারত | ৭ | ১৫ | ৩/২৮ | ১৮.৭৩ | ৪.০৩ |
ওয়াকার ইউনুস/পাকিস্তান | ৬ | ১৩ | ৪/২৬ | ১৯.৪৬ | ৪.৬৮ |
পল স্ট্র্যাং/জিম্বাবুয়ে | ৬ | ১২ | ৫/২১ | ১৬.০০ | ৪.৫৫ |
রজার হার্পার/ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ৬ | ১২ | ৪/৪৭ | ১৮.২৫ | ৩.৭৭ |
ড্যামিয়েন ফ্লেমিং/অস্ট্রেলিয়া | ৬ | ১২ | ৫/৩৬ | ১৮.৪১ | ৪.৮৭ |