১৯৮৭: উপমহাদেশের আসরে অস্ট্রেলিয়ার চমক

আঁতুড় ঘর থেকে বেরিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপ যেন পৌঁছায় দর্শকের আরও কাছে। ইংল্যান্ডে হয়ে যাওয়া আগের তিন আসরের চেয়ে অনেক বর্ণিল ছিল উপমহাদেশের আসর। মাঠের ক্রিকেট ছিল জমজমাট, লড়াই ছিল তীব্র। বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর যৌথভাবে আয়োজন করে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও পাকিস্তান। ফাইনালে ওঠে ক্রিকেটের দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। টুর্নামেন্টের আগে সেভাবে আলোচনায় না থাকা অস্ট্রেলিয়া চমকে দেয় প্রথম শিরোপা জিতে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2019, 02:18 PM
Updated : 23 May 2019, 02:18 PM

বিশ্বকাপের প্রথম তিন আসরই বসেছিল ইংল্যান্ডে। একক অধিকার থেকে তাদের মুঠি আলগা হয়ে যায় ১৯৮৭ সালে। ঐতিহ্যে এগিয়ে, অবকাঠামোয় অন্য সবার চেয়ে আধুনিক এবং গ্রীষ্মের দীর্ঘ দিনে ৬০ ওভার ম্যাচ আয়োজনের উপযুক্ততা- এসব যুক্তিতেই তো শুরুর তিন টুর্নামেন্ট হয়েছিল ইংল্যান্ডে। আইসিসির অন্য দেশগুলোর চাপের মুখে সেসব যুক্তি আর ধোপে টেকেনি। ভারত ও পাকিস্তানকে তাই যৌথভাবে দেওয়া হয় বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব।

বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে মোটেও ভালো করেনি বাংলাদেশ। ‘এ’ গ্রুপে ছয় ম্যাচের দুটিতে জেতে তারা, হারে চারটিতে। আট পয়েন্ট নিয়ে ছয় নম্বরে থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ।

কেমন হয় উপমহাদেশের বিশ্বকাপ, এ নিয়ে জমা হওয়া সংশয়ের মেঘ কেটে যায় টুর্নামেন্টের শুরুতেই। উদ্বোধনী দিনে পাকিস্তান কোনোমতে শ্রীলঙ্কাকে হারায় ১৫ রানে। আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ভারত ১ রানে হেরে যায় অস্ট্রেলিয়ার কাছে। শেষ তিন ওভারে ৩৫ রানের সমীকরণ মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেয় ইংল্যান্ড। নিউ জিল্যান্ডকে ভড়কে দিয়ে শেষ পর্যন্ত ৩ রানে হেরে যায় বাছাই পর্ব পেরিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে খেলতে আসা জিম্বাবুয়ে।

চতুর্থ বিশ্বকাপে খেলে তৃতীয় আসরের দলগুলোই। ভারত-পাকিস্তান যৌথ আয়োজক হলেও ফরম্যাটে পরিবর্তন আসেনি। বড় পরিবর্তন এসেছিল অন্য জায়গায়। উপমহাদেশে যেহেতু ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মের মতো দেরি করে সন্ধ্যা নামে না, সে কারণে ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমিয়ে আনা হয় ৫০ ওভারে। আর এই প্রথমবারের মতো ম্যাচ পরিচালনায় ব্যবহার করা হয় নিরপেক্ষ আম্পায়ার।

স্বাগতিকের মতো বদলে যায় টুর্নামেন্টের সময়ও। প্রথম তিন বিশ্বকাপ হয়েছিল জুন মাসে। উপমহাদেশের ক্রিকেটীয় আবহাওয়ায় ৮ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বরে হয় বিশ্বকাপ। এই আসরে খেলা হয় ২১ ভেন্যুতে, এর ১৪টি ছিল ভারতে, সাতটি পাকিস্তানে।

এত সব পরিবর্তনের ভিড়ে আরেকটি পরিবর্তন ছিল লক্ষ্যণীয়। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেট ঘিরে তৈরি হয় প্রবল উন্মাদনা। আগের বিশ্বকাপে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা এখানে কাজ করেছে জাদুর মতো। দুই প্রবল প্রতিপক্ষ ভারত-পাকিস্তানের স্বপ্নের ফাইনালের আশায় ছিলেন সমর্থকরা। বিশ্বকাপের উত্তেজনার পারদ ওপরের দিকে ওঠায় সেটিও রেখেছিল বড় ভূমিকা।

মাঠের ক্রিকেট শুরুর আগে ফেভারিটের তকমাটা ছিল ওই ভারত-পাকিস্তানেরই। তবে প্রথম তিন আসরের ফাইনালিস্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজের সম্ভাবনা বাতিল করে দেওয়ার উপায় ছিল না। যদিও ক্লাইভ লয়েড ততদিনে অবসরে, চোটের কারণে ছিলেন না গর্ডন গ্রিনিজ ও ম্যালকম মার্শাল। তার পরও ভিভ রিচার্ডসের দল ছিল ফেভারিটদের কাতারে।

সম্ভাবনায় ছিল ইংল্যান্ডও। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে সত্যিকার অর্থে গোনায় ধরেননি খুব বেশি লোক। আগের দুই বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে বিদায় নেওয়া দলটির স্কোয়াড সেবারও তেমন শক্তিশালী ছিল না। এক ঝাঁক নতুন ক্রিকেটার নিয়ে উপমহাদেশে আসে অস্ট্রেলিয়া। কে জানত, তাদের হাতেই শেষ পর্যন্ত উঠবে ট্রফি! ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ভারত-রূপকথার মতো না হলেও অ্যালান বোর্ডারের দলের শিরোপা জয়টা অবাক করা নিঃসন্দেহে।

গ্রুপ পর্বে ভারত-পাকিস্তান ছিল আলাদা গ্রুপে, তাদের ম্যাচগুলোও নিজ নিজ দেশে। পাকিস্তান জয় দিয়ে শুরু করে টুর্নামেন্ট, ভারত হার দিয়ে। শুরুর ওই হোঁচট সামলে প্রবল প্রতাপে টুর্নামেন্টে ফেরে ভারত। জেতে টানা পাঁচ ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র হার ছিল ভারতের বিপক্ষে ফিরতি ম্যাচেই। তাতে এই দুই দলের পয়েন্ট হয়ে যায় সমান। নেট রান রেটে এগিয়ে থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমি-ফাইনালে যায় ভারত।

ভারতের গ্রুপ পর্বের ছয় ম্যাচের মধ্যে প্রথমটি স্মরণীয় হয়ে আছে রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে। বারবার রঙ পাল্টানো ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে স্বাগতিকরা হারে এক রানে। ২৭০ রান তাড়ায় এক সময়ে তাদের স্কোর ছিল ২০৭/২। তবু জিততে পারেনি ভারত। ১৩ রানের মধ্যে শেষ চার উইকেট হারিয়ে ১ বল বাকি থাকতে গুটিয়ে যায় ২৬৯ রানে।

আর শেষটির কথা ইতিহাস মনে রেখেছে দুটি পারফরম্যান্সের সৌজন্যে। নাগপুরে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন চেতন শর্মা। আর টেস্ট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার করেন তার প্রথম ও একমাত্র ওয়ানডে সেঞ্চুরি। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ৬০ ওভার খেলে ৩৬ রানে অপরাজিত থাকার দায়মোচন হয়তো অবশেষে হয় তাতে!

‘বি’ গ্রুপে আরেক স্বাগতিক পাকিস্তানের পথচলাও ভারতের মতো। ছয় ম্যাচের মধ্যে পাঁচটি জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই সেমি-ফাইনালে যায় ইমরান খানের দল। পার্থক্য বলতে, ভারত হেরেছিল নিজেদের প্রথম ম্যাচ, পাকিস্তান শেষ ম্যাচে। ধ্রুপদী ম্যাচের মর্যাদা পেয়েছে এই গ্রুপের একটি ম্যাচ, যেখানে পাকিস্তান এক উইকেটে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। আগের তিন আসরের ফাইনালিস্ট ক্যারিবিয়ানরা বিদায় নেয় গ্রুপ পর্ব থেকেই।

সেমি-ফাইনালে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ ম্যাচে জিতলেই ফাইনালের স্বপ্ন মঞ্চে মুখোমুখি-এই রোমাঞ্চে বুঁদ ছিল দেশ দুটির মানুষ। কিন্তু সেই প্রত্যাশায় কুঠারাঘাতটা হয় বড্ড নির্মম। ৪ নভেম্বর লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে পাকিস্তানকে ১৮ রানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। ২৪ ঘন্টা পর তখনকার বোম্বের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতকে ৩৫ রানে হারিয়ে ফাইনালে যায় ইংল্যান্ড। ৮ নভেম্বর ইডেন গার্ডেনসের নন্দনকাননে তাই ভারত-পাকিস্তান নয়, বিশ্বকাপ ট্রফির লড়াইয়ে নামে অন্য দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী।

প্রথম তিন আসরের স্বাগতিক তারা, মাঝেরবার ফাইনালে উঠলেও ট্রফিতে হাত ছোঁয়া হয়নি- ট্রফি জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের মরিয়া থাকাটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, প্রথমবার ফাইনাল খেলা অস্ট্রেলিয়া পরের দুই আসরে বাদ প্রথম রাউন্ডেই। নতুনের ঝাণ্ডা ওড়ানো দলটি তাই ট্রফিটা জিততে চাইছিল যে কোনো ভাবে।

আগে ব্যাটিং করে পাঁচ উইকেটে ২৫৩ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া। টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ ফর্মে থাকা ডেভিড বুনের ৭৫ রান যে ইনিংসের ভিত্তি। আর শেষ দিকে মাইক ভেলেটার ৩১ বলে অপরাজিত ৪৫ রানে আড়াইশ পার হয় দলটি।

তবে ওই রান ইডেনের উইকেটে নিরাপদ ছিল না মোটেও। বিল অ্যাথি (৫৮) আর মাইক গ্যাটিং (৪১) মিলে জয়ের বন্দরের দিকেই নিয়ে যাচ্ছিলেন ইংল্যান্ডকে। কিন্তু অধিনায়ক মাইক গ্যাটিংয়ের এক মুহূর্তের পাগলামি শেষ করে দেয় প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা। ২ উইকেটে রান তখন ১৩৫, এমন সময় বোর্ডারকে অহেতুক রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ক্যাচ দেন তিনি। যে মুহূর্তটি বিবেচিত ১৯৮৩ আসরের ফাইনালে কপিল দেবের নেওয়া ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচের মতোই টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে। গ্যাটিংয়ের আউটে ধাক্কা খাওয়া ইংল্যান্ড ম্যাচটি হেরে যায় ৭ রানে। আর ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথম শিরোপার স্বাদ পায় অস্ট্রেলিয়া।

সর্বোচ্চ ৪৭১ রান করেন ইংল্যান্ডের গুচ। চারশর বেশি রান করেন অস্ট্রেলিয়ার বুন ও জিওফ মার্শ। সর্বোচ্চ ১৮ উইকেট নেন অস্ট্রেলিয়ার পেসার ক্রেইগ ম্যাকডারমট। ১৭ উইকেট নেন পাকিস্তানের অলরাউন্ডার ইমরান খান।

সবচেয়ে বেশি রান:

ব্যাটসম্যান/দেশ

ম্যাচ

রান

সেরা

গড়

১০০/৫০

গ্রাহাম গুচ/ইংল্যান্ড

৪৭১

১১৫

৫৮.৮৭

১/৩

ডেভিড বুন/অস্ট্রেলিয়া

৪৪৭

৯৩

৫৫.৮৭

০/৫

জিওফ মার্শ/অস্ট্রেলিয়া

৪২৮

১২৬*

৬১.১৪

২/১

ভিভ রিচার্ডস/ওয়েস্ট ইন্ডিজ

৩৯১

১৮১

৬৫.১৬

১/৩

মাইক গ্যাটিং/ইংল্যান্ড

৩৫৪

৬০

৫০.৫৭

০/৩

সবচেয়ে বেশি উইকেট:

বোলার/দেশ

ম্যাচ

উইকেট

সেরা

গড়

ইকোনমি

ক্রেগ ম্যাকডারমট/অস্ট্রেলিয়া

১৮

৫/৪৪

১৮.৯৪

৪.৬৭

ইমরান খান/পাকিস্তান

১৭

৪/৩৭

১৩.০৫

৪.৪৫

প্যাট্রিক প্যাটারসন/ওয়েস্ট ইন্ডিজ

১৪

৩/৩১

১৮.০৭

৪.৫১

মানিন্দর সিং/ভারত

১৪

৩/২১

২০.০০

৪.০০

এডি হেমিংস/ইংল্যান্ড

১৩

৪/৫২

২১.০৭

৪.৬০