উপমহাদেশের দলটির শিরোপা জয় হয়ে গেছে ক্রিকেটীয় রূপকথার অংশ। আগের বিশ্বকাপে তিন ম্যাচেই হেরে যাওয়া দলটিকে নিয়ে বাজি ধরার লোক ছিল না খুব একটা। সেই ভারতই টুর্নামেন্টে দুইবার হারিয়ে দেয় সেই সময়ের অপ্রতিরোধ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
আগের দুই আসরের মতো এবারও ছিল আট দল। ততদিনে টেস্ট মর্যাদা পেয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা খেলে সরাসরি। ১৯৮২ সালে হয়ে যাওয়া বাছাই পর্ব পেরিয়ে চূড়ান্ত আসরে জায়গা করে নেয় জিম্বাবুয়ে। তাদের হাত ধরে বিশ্বকাপে ফেরে আফ্রিকার প্রতিনিধি। বর্ণবাদের দায়ে নির্বাসনে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা হয়নি এবারও।
১৬ দলের বাছাই পর্বে ২০ পয়েন্ট নিয়ে ‘বি’ গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে শেষ চারে যায় বাংলাদেশ। ‘এ’ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে সেমি-ফাইনাল থেকে বিদায় নেয় তারা।
চূড়ান্ত আসরে ‘এ’ গ্রুপে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সঙ্গী ছিল পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা। ‘বি’ গ্রুপে প্রথম দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গী ছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জিম্বাবুয়ে।
এই আসরে বাড়ানো হয় ম্যাচ। গ্রুপ পর্বে প্রতিটি দল দুইবার করে মুখোমুখি হয়। ৯ থেকে ২৫ জুন হওয়া টুর্নামেন্টে ম্যাচ হয় ২৭টি। আগের দুই আসরে ম্যাচ হয়েছিল ১৫টি করে। প্রথম দুই আসরে ভেন্যু ছিল ছয়টি করে, তৃতীয় আসরে বেড়ে দাঁড়ায় ১৫-তে।
যথারীতি ম্যাচের দৈর্ঘ্য ছিল ৬০ ওভার। একজন বোলার করতে পারতেন সর্বোচ্চ ১২ ওভার।
এই আসরে পরিবর্তন আসে ফিল্ডিংয়ের নিয়মে। স্টাম্পের ৩০ গজের মধ্যে একটি ডিম্বাকৃতি বৃত্ত এঁকে দেওয়া হয়। পুরো ৬০ ওভারই এর ভেতরে অন্তত চারজন ফিল্ডার থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। আর ওয়াইড ও বাউন্সারের ব্যাপারে আম্পায়ারদের কঠোর হওয়ার নির্দেশনাও ছিল আইসিসির তরফ থেকে। ফলে আগের বিশ্বকাপের চেয়ে ম্যাচপ্রতি ওয়াইডের সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় দ্বিগুণ (১৯৭৯ সালে ম্যাচপ্রতি ৪.৬৪; ১৯৮৩ সালে ৯.৫৯)।
‘এ’ গ্রুপে খেলায় একমাত্র অঘটন ছিল আগের দুই আসরের সেমি-ফাইনালিস্ট নিউ জিল্যান্ডকে শ্রীলঙ্কার হারিয়ে দেওয়া। ইংল্যান্ড হারে একটি ম্যাচ, নিউ জিল্যান্ডের কাছে। পাঁচ জয় নিয়ে স্বাগতিকদের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমি-ফাইনালে উঠতে সমস্যা হয়নি।
ইংলিশদের সঙ্গী হওয়ার লড়াইটা ছিল জমজমাট। পাকিস্তান ও নিউ জিল্যান্ড দুই দলই জেতে তিনটি করে ম্যাচ। রান রেটে নিউ জিল্যান্ডের (৩.৯২৭) চেয়ে সামান্য এগিয়ে থাকায় পাকিস্তান (৪.০১৪) পেয়ে যায় সেমি-ফাইনালের টিকেট।
‘বি’ গ্রুপের পরতে পরতে ছিল চমক। বিশ্বকাপ অভিষিক্ত জিম্বাবুয়ের জন্য সেটি ছিল ওয়ানডে অভিষেকও। নিজেদের প্রথম ম্যাচে ট্রেন্ট ব্রিজে দলটি ১৩ রানে হারিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়াকে। ম্যাচটিকে ধরা হয় ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা অঘটন হিসেবে।
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ভারতের ৩৪ রানের জয়টিও কম বড় চমক ছিল না। তৃতীয় আসরে এসে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম হারের স্বাদ পায় ক্যারিবিয়ানরা। এই হারের ধাক্কা সামাল দিয়ে টানা পাঁচ জয়ে গ্রুপ সেরা হয়েই যায় শেষ চারে।
চার জয় নিয়ে তাদের সঙ্গী হয় ভারত। দলটিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। ১৭ রানে পাঁচ এবং ৭৮ রানের মধ্যে ভারতের সাত উইকেট তুলে নিয়েছিল তারা। কিন্তু জিম্বাবুয়েকে দ্বিতীয় অঘটন ঘটাতে দেননি কপিল দেব। অধিনায়কের ১৩৮ বলে অপরাজিত ১৭৫ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংসে জয়ের ভিত্তি পেয়ে যায় ভারত।
সেমি-ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ছয় উইকেটে হারিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবেই তারা উঠে যায় ফাইনালে। পাকিস্তানকে আট উইকেটে উড়িয়ে টানা তৃতীয় ফাইনালে পৌঁছায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
অনেকের চোখে লর্ডসে ২৫ জুনের ফাইনাল ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিশোধের ম্যাচ। অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংয়ের পেস ব্যাটারির সামনে ১৮৩ রানে গুটিয়ে যায় ভারত।
গ্যালারিতে তখন ক্যালিপসোর সুর মূর্ছনায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকরা মাতোয়ারা। টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াটা ছিল যেন কেবলই সময়ের ব্যাপার!
শেষ পর্যন্ত হলো উল্টো। এক বিশ্বকাপে ক্যারিবিয়ান বধ কীর্তি দুইবার গড়ে কপিলের ভারত চমকে দেয় ক্রিকেট বিশ্বকে। ছোট রান তাড়ায় মদনলাল-মহিন্দার অমরনাথদের মতো মিডিয়াম পেস বোলারদের সামনে আত্মাহুতির মিছিলে সামিল হয়ে ক্যারিবিয়ানদের কালজয়ী ব্যাটিং লাইন গুটিয়ে যায় মাত্র ১৪০ রানে।
ব্যাটিংয়ে ২৬ রান করা অমরনাথ বোলিংয়ে সাত ওভারে ১২ রান দিয়ে নেন তিন উইকেট। সেমি-ফাইনালের মতো ফাইনালেও তাই তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
সর্বোচ্চ ৩৮৪ রান করেছিলেন ইংল্যান্ডের ডেভিড গাওয়ার। ভারতের রজার বিনি নিয়েছিলেন সর্বোচ্চ ১৮ উইকেট।
সবচেয়ে বেশি রান:
ব্যাটসম্যান/দেশ | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় | ১০০/৫০ |
ডেভিড গাওয়ার/ইংল্যান্ড | ৭ | ৩৮৪ | ১৩০ | ৭৬.৮০ | ১/১ |
ভিভ রিচার্ডস/ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ৮ | ৩৬৭ | ১১৯ | ৭৩.৪০ | ১/২ |
গ্রাহাম ফাওলার/ইংল্যান্ড | ৭ | ৩৬০ | ৮১* | ৭২.০০ | ০/৪ |
জহির আব্বাস/পাকিস্তান | ৭ | ৩১৩ | ১০৩* | ৬২.৬০ | ১/২ |
কপিল দেব/ভারত | ৮ | ৩০৩ | ১৭৫* | ৬০.৬০ | ১/০ |
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
বোলার/দেশ | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি |
রাজার বিনি/ভারত | ৮ | ১৮ | ৪/২৯ | ১৮.৬৬ | ৩.৮১ |
অশান্ত ডি মেল/শ্রীলঙ্কা | ৬ | ১৭ | ৫/৩২ | ১৫.৫৮ | ৪.০১ |
মদন লাল/ভারত | ৮ | ১৭ | ৪/২০ | ১৬.৭৬ | ৩.৪৩ |
রিচার্ড হ্যাডলি/নিউ জিল্যান্ড | ৬ | ১৪ | ৫/২৫ | ১২.৮৫ | ২.৭৬ |
ভিক মার্কস/ইংল্যান্ড | ৭ | ১৩ | ৫/৩৯ | ১৮.৯২ | ৩.১৫ |