১৯৭৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের সম্প্রচার স্বত্ব কেনার চেষ্টা করে প্যাকারের প্রতিষ্ঠান চ্যানেল নাইন। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলে তেতে ওঠেন প্যাকার। প্রস্তুতি নেন ১৯৭৭-৭৮ অস্ট্রেলিয়ান মৌসুমে স্বাগতিক বোর্ডকে টেক্কা দিতে একই সময়ে অন্য এক টুর্নামেন্ট আয়োজনের।
১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি থেকে পরের বছরের শুরুর সময় পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রায় তিন ডজন ক্রিকেটারের সঙ্গে চুক্তি করেন প্যাকার। সে সময়ে বোর্ড থেকে খুব একটা অর্থ পেতেন না ক্রিকেটাররা। ওয়ার্ল্ড সিরিজের লোভনীয় প্রস্তাবে তাই সাড়া দিতে থাকেন নতুন নতুন খেলোয়াড়। অস্ট্রেলিয়া একাদশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ একাদশ ও বিশ্ব একাদশের বাইরে আরও দুটি একাদশ গঠনের মতো খেলোয়াড় এসে যায় প্যাকারের হাতে।
টাকার স্রোতে ভেসে একের পর এক তারকা ক্রিকেটার চলে যাচ্ছিলেন ওয়ার্ল্ড সিরিজে। মাঠের ক্রিকেট ছিল জমজমাট, বাইরে ছিল উদ্ভাবনী কৌশলের শক্তি। দুইয়ে মিলে ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছিল বিদ্রোহী এই সিরিজ। এদিকে বিশ্বকাপ এগিয়ে আসায় চিন্তার ভাঁজ বাড়তে থাকে আইসিসির।
প্রায় সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মাঠে নামে তারা। একের পর এক মিটিং শেষে ১৯৭৯ সালের ৩০ মে আসে সমাধান। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সম্প্রচার স্বত্ব পান প্যাকার। সঙ্গে খেলাটির প্রচার, উন্নতি ও বিপণনের জন্য তার সঙ্গে ১০ বছরের একটি চুক্তিও করা হয়। এর ১০ দিন পর মাঠে গড়ায় দ্বিতীয় বিশ্বকাপ।
১৯৭৯ আসরে স্বাগতিক হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল ভারত। তবে অবকাঠামোগত সুবিধা ও বেশি সময় ধরে সূর্যের আলো থাকায় সেবারও স্বাগতিক হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ইংল্যান্ডকে। আট দলের টুর্নামেন্ট চলে ৯ থেকে ২৩ জুন। ছয় ভেন্যুতে হয় ১৫টি ম্যাচ।
যথারীতি প্রতিটি ইনিংসের দৈর্ঘ্য ছিল ৬০ ওভার। একজন বোলার সর্বোচ্চ ১২ ওভার বল করতে পারতেন। নেতিবাচক বোলিং ঠেকাতে ওয়াইড ও বাউন্সারের দিকে এই আসরে কড়া নজর রেখেছিলেন আম্পায়াররা।
পরিবর্তন হয়নি ১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ডেই হয়ে যাওয়া প্রথম আসরের ফরম্যাটে। বর্ণবাদের দায়ে নিষিদ্ধ টেস্ট খেলুড়ে দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা খেলতে পারেনি এই আসরেও। তবে এই বিশ্বকাপের আগে প্রথমবারের মতো বাছাইপর্ব আয়োজন করে আইসিসি।
আইসিসি ট্রফি নামে পরিচিত ১৫ দলের টুর্নামেন্টে অংশ নেয় বাংলাদেশও। চার ম্যাচের দুটিতে জয় পাওয়া দলটি বিদায় নেয় গ্রুপ পর্ব থেকেই। সেমি-ফাইনালে জিতে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয় শ্রীলঙ্কা ও কানাডা। সেমি-ফাইনাল দুটি হয় মূল আসর শুরুর মাত্র তিন দিন আগে। পূর্ব আফ্রিকা বাছাই পর্ব উতরাতে না পারায় আফ্রিকার কোনো দল ছিল না এই বিশ্বকাপে।
চূড়ান্ত পর্বের ফাইনালের দুই দিন আগে হয় আইসিসি ট্রফির ফাইনাল। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়া কানাডাকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তোলে শ্রীলঙ্কা।
‘এ’ গ্রুপে প্রথম আসরের রানার্সআপ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গী ছিল ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও কানাডা। ‘বি’ গ্রুপে শিরোপাধারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গী ছিল ভারত, নিউ জিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা।
‘এ’ গ্রুপের সেরা হয়ে ইংল্যান্ড ও রানার্সআপ হয়ে পাকিস্তান শেষ চারে ওঠে। ‘বি’ গ্রুপের সেরা হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও রানার্সআপ হয়ে নিউ জিল্যান্ড সেমি-ফাইনালে পৌঁছায়। উপমহাদেশের প্রথম দল হিসেবে শেষ চারে খেলা পাকিস্তানকে বিদায় করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফাইনালে যাওয়ার আরেক লড়াইয়ে নিউ জিল্যান্ডকে হারায় ইংল্যান্ড।
লর্ডসে ফাইনালে ভিভ রিচার্ডস খেলেন অপরাজিত ১৩৮ রানের অসাধারণ এক ইনিংস, এখনও যেটিকে মনে করা হয় সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ইনিংসগুলোর একটি। ৬৬ বলে ৮৬ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলেন কলিস কিংস। এক পর্যায়ে ৯৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলা ওয়েস্ট ইন্ডিজ পরে তোলে ৯ উইকেটে ২৮৬ রান।
ইংল্যান্ড উদ্বোধনী জুটিতে তুলেছিল ১২৯ রান। তবে গতি ছিল ভীষণ মন্থর। পরে গতি বাড়াতে গিয়েই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে ইনিংস। ইয়র্কারের প্রদর্শনীতে ৫ উইকেট নেন ‘বিগ বার্ড’ জোয়েল গার্নার। ১৯৪ রানে গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। ৯২ রানের জয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ট্রফি ঘরে তোলে ক্লাইভ লয়েডের দল।
২৫৩ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। তিনি ছাড়া দুইশর বেশি রান করেন কেবল রিচার্ডস ও ইংল্যান্ডের গ্রাহাম গুচ। সর্বোচ্চ ১০ উইকেট নেন ইংল্যান্ডের মাইক হেনড্রিক। ম্যাচে একবার করে পাঁচ উইকেট নেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যালান হার্স্ট ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের গার্নার।
প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয় আসরে বড় রান হয়নি খুব একটা। তিনশ ছুঁতে পারেনি কোনো দল। সেঞ্চুরি হয় সাকুল্যে দুটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্রিনিজ ও রিচার্ডস কেবল ছুঁতে পারেন তিন অঙ্ক।
প্রথম বিশ্বকাপের পরও খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি ওয়ানডে। পরের চার বছরে ম্যাচ হয় মোটে ২৭টি। বিশ্বকাপ ফাইনালের পর থেকে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কোনো ওয়ানডে খেলেনি অস্ট্রেলিয়া।
প্যাকারের সিরিজের জন্য দুর্বল দল নিয়ে খেলতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। পূর্ণ শক্তির দল নিয়ে যাওয়া ভারতের যাচ্ছেতাই কাটে টুর্নামেন্টটা। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে হেরে শূন্য হাতে ফিরে যায় তারা।
সবচেয়ে বেশি রান:
নাম/দেশ | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় | ১০০/৫০ |
গর্ডন গ্রিনিজ/ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ৪ | ২৫৩ | ১০৬* | ৮৪.৩৩ | ১/২ |
ভিভ রিচার্ডস/ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ৪ | ২১৭ | ১৩৮* | ১০৮.৫০ | ১/০ |
গ্রাহাম গুচ/ইংল্যান্ড | ৫ | ২১০ | ৭১ | ৫২.৫০ | ০/২ |
গ্লেন টার্নার/নিউ জিল্যান্ড | ৪ | ১৭৬ | ৮৩* | ৮৮.০০ | ০/১ |
জন রাইট/নিউ জিল্যান্ড | ৪ | ১৬৬ | ৬৯ | ৪১.৫০ | ০/১ |
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
নাম/দেশ | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি |
মাইক হেনড্রিক/ইংল্যান্ড | ৫ | ১০ | ৪/১৫ | ১৪.৯০ | ২.৬৬ |
ব্রায়ান ম্যাকেঞ্জি/নিউ জিল্যান্ড | ৪ | ৯ | ৩/২৪ | ১৫.৬৬ | ৩.০৭ |
আসিফ ইকবাল/পাকিস্তান | ৪ | ৯ | ৪/৫৬ | ১৭.৪৪ | ৩.৩৪ |
ক্রিস ওল্ড/ইংল্যান্ড | ৫ | ৯ | ৩/৮ | ১৭.৪৪ | ২.৭০ |
মাইকেল হোল্ডিং/ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ৪ | ৮ | ৪/৩৩ | ১৩.২৫ | ২.৫৮ |