সীমিত ওভারের ক্রিকেট সে সময়ে অনেকটা অনাহূত এক সংস্করণ। এক সময়ে ইংল্যান্ডে এক ইনিংসের বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচ প্রচলিত ছিল। ১৯৬৩ সাল থেকে দেশটিতে শুরু হয় সীমিত ওভারের ক্রিকেট। তার প্রায় আট বছর পর ক্রিকেট বিশ্ব দেখে এই সংস্করণে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেটিও ঘটনাক্রমে, একটি টেস্টের বেশিরভাগ সময় বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার পর।
১৯৭১ সালে মেলবোর্নে অ্যাশেজ টেস্ট সিরিজের একটি ম্যাচের তিন দিন বৃষ্টিতে ভেসে গেলে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে হঠাৎ করেই একটি ওয়ানডে আয়োজন করা হয়। ৪০ ওভারের সেই ম্যাচে সহজেই জেতে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া।
পরের বছর দেখা মেলে প্রথম দ্বি-পাক্ষিক সিরিজের। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই সিরিজে দলকে নেতৃত্ব দিতে শুরুতে রাজি ছিলেন না অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল। পরে অবশ্য তিনিই নেতৃত্বে দিয়েছিলেন দলকে। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রতি বিতৃষ্ণা ছিল স্পষ্ট। সেটা কেবল চ্যাপেলের একার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল না।
ছেলেদের বিশ্বকাপের দুই বছর আগে বসে মেয়েদের বিশ্বকাপ। ১৯৭৩ সালের ২৮ জুলাই এজবাস্টনে প্রিন্সেস অ্যান ইংল্যান্ডের হাতে শিরোপা তুলে দেওয়ার তিন দিন আগে সে সময়কার ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্স (আইসিসি) নিজেদের ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটিতে ছেলেদের বিশ্বকাপের অনুমোদন দেয়।
টেস্ট ক্রিকেটই তখনও ক্রিকেটের চূড়ান্ত। তবে পাঁচ দিনের ম্যাচ দিয়ে অমন কোনো প্রতিযোগিতা আয়োজন ছিল সময় সাপেক্ষ। তাই প্রয়োজন পড়ে সংক্ষিপ্ত সংস্করণের, এক দিনেই শেষ হবে এমন ম্যাচের।
৬০ ওভারের ওয়ানডে ম্যাচ হয়ে আসে তার সমাধান। আলোর মুখ দেখে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ফ্লাড লাইটে ক্রিকেট সে সময় সম্ভব ছিল না। জুনে ইংল্যান্ডের সূর্যের আলো থাকে লম্বা সময় ধরে। অবকাঠামোগত সুবিধা ভালো, তাদের মাঠও ছিল প্রস্তুত, তাই দেশটিকে প্রথম আসরের স্বাগতিক হিসেবে বেছে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।
বর্ণবাদের জন্য সে সময় নিষিদ্ধ ছিল টেস্ট খেলুড়ে দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। সে সময়ের রোডেশিয়া (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) টালমাটাল ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতায়। আফ্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে টুর্নামেন্টে খেলে পূর্ব আফ্রিকা। কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডা ও জাম্বিয়ার ক্লাব ক্রিকেটারদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দলটির সঙ্গে ‘এ’ গ্রুপে ছিল ভারত, ইংল্যান্ড ও নিউ জিল্যান্ড। ‘বি’ গ্রুপে ছিল অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। টেস্ট মর্যাদা ছিল না কেবল পূর্ব আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কার।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১ উইকেটের নাটকীয় জয় ছাড়া গ্রুপ পর্বের প্রতিটি ম্যাচ ছিল একপেশে। ‘এ’ গ্রুপের সেরা হয়ে শেষ চারে যায় ইংল্যান্ড, রানার্সআপ হয় নিউ জিল্যান্ড। টানা তিন জয়ে ‘বি’ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমি-ফাইনালে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, রানার্সআপ হয় অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র সেবারই উপমহাদেশের কোনো দল সেরা চারে যেতে ব্যর্থ হয়।
কম রানের রোমাঞ্চকর ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ৪ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছায় অস্ট্রেলিয়া। অন্য সেমি-ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডকে ৫ উইকেটে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ফাইনালে ক্লাইভ লয়েড ৮৫ বলে খেলেন ১০২ রানের বিস্ফোরক এক ইনিংস। অধিনায়কের সেঞ্চুরিতে ৬০ ওভারে আট উইকেটে ২৯১ রান তোলে ক্যারিবিয়ানরা। জবাবে অস্ট্রেলিয়া অলআউট ২৭৪ রানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস ব্যাটারির মধ্যে কিথ বয়েস (৪/৫০) ছিলেন সফলতম। তবে অস্ট্রেলিয়ার পতনে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা তার না; সেটি রান আউটের। ইনিংসে পাঁচ-পাঁচটি রান আউট যে তাদের! এর মধ্যে তিনটি ভিভ রিচার্ডসের থ্রোতে।
৭ জুন, একই সময়ে চার ভেন্যুতে শুরু হয়েছিল চার ম্যাচ। অর্থাৎ প্রথম দিনেই মাঠে নেমেছিল সব দল। সেদিনই ওয়ানডে ইতিহাসের অদ্ভুততম ইনিংসটি খেলেন ভারতীয় ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার।
বিশ্বকাপের আগে ওয়ানডে হয়েছিল সাকুল্যে ১৮টি। অনেক দলই টেস্টের সাথে ওয়ানডের পার্থক্য সে সময়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। ভারতই যেমন, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৩৪ রান তাড়ায় ৩ উইকেটে করেছিল ১৩২! দৃষ্টিকটু মন্থর ব্যাটিংয়ে ৬০ ওভার ব্যাটিং করে ৩৬ রানে অপরাজিত ছিলেন গাভাস্কার। তার ১৭৪ বলের ইনিংসে চার ছিল কেবল একটি। ৭ উইকেট হাতে রেখেও ভারত হারে ২০২ রানের বড় ব্যবধানে।
জাভেদ মিয়াঁদাদ তার ক্যারিয়ার শুরু করেন এই বিশ্বকাপ দিয়ে। পাকিস্তানের ব্যাটিং কিংবদন্তি সে সময় ছিলেন সম্ভাবনাময় তরুণ। অনেক পরে বলেছিলেন, বিশ্বকাপ কী সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তার। তার বিশ্বাস, অন্য কোনো দলও বুঝতে পারেনি এই টুর্নামেন্টটা আসলে কি হতে যাচ্ছে। তার মতে সে সময় মাঠের বাইরের পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। আবহ ছিল ইতিবাচক ও বন্ধুত্বপূর্ণ।
আবহাওয়া ছিল আদর্শ, কন্ডিশন ছিল উপযোগী। প্রতিটি ম্যাচ ছিল ৬০ ওভারের। এক জন বোলার সর্বোচ্চ ১২ ওভার বোলিং করতে পারতেন। ছয় ভেন্যুতে আট দলের টুর্নামেন্টে ম্যাচ হয়েছিল ১৫টি। পরনে ছিল সাদা পোশাক। খেলা হয়েছিল লাল বলে।
উদ্বোধনী দিনে ভারতের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের ৪ উইকেটে ৩৩৪ ছিল আসরের সর্বোচ্চ।
৩৩৩ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন নিউ জিল্যান্ডের গ্লেন টার্নার। পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে তার অপরাজিত ১৭১ ছিল টুর্নামেন্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। টুর্নামেন্টে সব মিলিয়ে হয়েছিল ছয়টি সেঞ্চুরি, তার দুটি এসেছিল টার্নারের ব্যাট থেকে। কেবল তিনিই করেছিলেন একাধিক সেঞ্চুরি।
মাত্র দুটি ম্যাচ খেলে ১১ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বাঁহাতি সুইং বোলার গ্যারি গিলমোর। খেলেছিলেন কেবল সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে। শেষ চারের লড়াইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪ রানে তার ৬ উইকেট ছিল টুর্নামেন্টের সেরা বোলিংয়ের কীর্তি। গিলমোরের বাইরে ম্যাচে পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন কেবল আরেক অস্ট্রেলিয়ান ডেনিস লিলি।
উদ্বোধনী দিনে গাভাস্কারের অমন মন্থর শুরুটা কেউ মনে রাখেনি। দাগ কেটে আছে রোমাঞ্চকর ফাইনাল। লয়েডের চোখ ধাঁধাঁনো সেঞ্চুরি। রান তাড়ায় দশম উইকেটে ভীতিকর দুই পেসার লিলি ও জেফ টমসনের ৪১ রানের জুটিতে অস্ট্রেলিয়ার লড়াই।
যে রোমাঞ্চের আশায় আয়োজন করা হয়েছিল টুর্নামেন্ট, লর্ডসে তার অনিবর্চনীয় স্বাদ পায় ২৬ হাজার দর্শক। সাদামাটা টুর্নামেন্টের বর্ণিল সমাপ্তি জানান দেয়, থাকতেই এসেছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ।
সবচেয়ে বেশি রান:
নাম/দেশ | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় | ১০০/৫০ |
গ্লেন টার্নার/নিউ জিল্যান্ড | ৪ | ৩৩৩ | ১৭১* | ১৬৬.৫০ | ২/০ |
ডেনিস অ্যামিস/ইংল্যান্ড | ৪ | ২৪৩ | ১৩৭ | ৬০.৭৫ | ১/১ |
মাজিদ খান/পাকিস্তান | ৩ | ২০৯ | ৮৪ | ৬৯.৬৬ | ০/৩ |
কিথ ফ্লেচার/ইংল্যান্ড | ৪ | ২০৭ | ১৩১ | ৬৯.০০ | ১/১ |
অ্যালেন টার্নার/অস্ট্রেলিয়া | ৫ | ২০১ | ১০১ | ৪০.২০ | ১/০ |
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
নাম/দেশ | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি |
গ্যারি গিলমোর/অস্ট্রেলিয়া | ২ | ১১ | ৬/১৪ | ৫.৬৩ | ২.৫৮ |
বার্নার্ড জুলিয়েন/ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ৫ | ১০ | ৪/২০ | ১৭.৭০ | ২.৯৫ |
কিথ বায়েস/ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ৫ | ১০ | ৪/৫০ | ১৮.৫০ | ৩.৫৫ |
রিচার্ড হ্যাডলি/নিউ জিল্যান্ড | ৪ | ৮ | ৩/২১ | ২০.২৫ | ৩.৫২ |
অ্যান্ডি রবার্টস/ওয়েস্ট ইন্ডিজ | ৫ | ৮ | ৩/৩৯ | ২০.৬২ | ২.৯১ |
ডেনিস লিলি/অস্ট্রেলিয়া | ৫ | ৮ | ৫/৩৪ | ২৭.৮৭ | ৪.২০ |