২০১০ সালে বাংলাদেশ দলকে অর্ডিনারি বলেছিলেন তিনি, এবার বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স দেখে সাবেক এই ভারতীয় ব্যাটসম্যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে বললেন, ‘বাংলাদেশ এখনও অর্ডিনারি।’
Published : 16 Nov 2023, 10:04 AM
আইসিসি হল অব ফেম অনুষ্ঠানে ততক্ষণে ভিরেন্দার শেবাগের পর্ব শেষ হয়ে গেছে। হলরুমে বাইরে বসেছিলেন তিনি। আইসিসির মিডিয়া ম্যানেজার এসে জানালেন, সংবাদকর্মীদের জন্য শেবাগের সঙ্গে ৫ মিনিটের একটি সেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাত্রই তখন টেবিলে ডিনার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেবাগের কথার চেয়ে আকর্ষণীয় খাবার তখন আর কী আছে! সবাই ছুটলেন শেবাগের কাছে। অনেক কিছু নিয়েই কথা বললেন ভারতীয় কিংবদন্তি। কথা বলার সময়ই হুট করে বেজে উঠল টেবিলে রাখা একটি ফোনের অ্যালার্ম। শেবাগ সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘টাইম আপ…।’ এরপর ফোন হাতে নিয়ে সোজা হাঁটা দিলেন!
সেটি শেবাগেরই ফোন। আইসিসির মিডিয়া ম্যানেজার ৫ মিনিটের সময় নিয়েছেন। তিনিই অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছেন নিজের ফোনে। ৫ মিনিট মানে ৫ মিনিটই!
এমনকি যে প্রশ্নের উত্তর তিনি দিচ্ছিলেন তখন, সেটিও শেষ করলেন না। ওখান থেকেই বাদ। নতুন যারা তাকে দেখলেন, সবাই অবাক। তবে পুরোনো সংবাদকর্মীদের জন্য এটা চেনা দৃশ্য। শেবাগ বরাবরই এমন!
ফোন নিয়ে চলে যাওয়ার সময় দু-একজন একটু অনুরোধ করলেন আর দু-এক মিনিট সময় দিতে। শেবাগ পেছন ফিরে বললেন, “আর কথা নেই… এমনিতেও তো আমি কিছু বললেই বিতর্ক হয়…!”
তার পরও যদি একটু কিছু পাওয়া যায়, এই আশায় পিছু ছুটে গিয়ে কোনোরকমে বলা গেল, “আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, বাংলাদেশের জন্য যদি ১ মিনিট সময় মেলে আপনার কাছ থেকে…!”
দারুণ কাজ হলো এতে। শেবাগ থমকে দাঁড়ালেন।
বাংলাদেশ দল নিয়ে তার তুমুল আলোচিত এক মন্তব্য ছিল ২০১০ সালের জানুয়ারিতে। মহেন্দ্র সিং ধোনি চোটের কারণে ছিটকে পড়ায় চট্টগাম টেস্টে শেবাগ ছিলেন ভারতের অধিনায়ক। ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশকে বলছিলেন ‘অর্ডিনারি দল।’
বাংলাদেশ ‘অর্ডিনারি’ দল ছিল বটে। তবে সাধারণত ক্রিকেটীয় ভদ্রতা বা ভব্যতা থেকে কেউ এভাবে সরাসরি বলেন না। শেবাগ ব্যতিক্রম।
ভারতীয় সংবাদকর্মীরা তখন বাংলাদেশের সংবাদকর্মীদেরকে বলেছিলেন যে, শেবাগ এরকমই। মনে যা আসে, তা বলে দিতে পরোয়া করেন না।
সেই ঘটনাটিই মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো তাকে, “মনে আছে, ২০১০ সালে আপনি বাংলাদেশকে অর্ডিনারি দল বলেছিলেন? আমার প্রশ্নের জবাবেই ওই মন্তব্য করেছিলেন…”, কথাটি শেষও করতে দিলেন না শেবাগ, “দেখলেন তো, বাংলাদেশ এখনও অর্ডিনারি!”
১৩ বছর আগে তার সেই মন্তব্য নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। এবার এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যা খেলেছে, তাতে শেবাগের সঙ্গে দ্বিমত করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।
কেন বাংলাদেশের এমন ‘অর্ডিনারি’ পারফরম্যান্স, একটি কারণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে ছোট্ট আলাপচারিতায় তুলে ধরলেন শেবাগ। আফগানিস্তানের উদাহরণ টেনে আনলেন তিনি।
“বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা একদমই ভালো খেলেনি। যে কোনো বড় টুর্নামেন্টে ব্যাটসম্যানদেরই সুর বেঁধে দিতে হয়। ব্যাটিং এত বাজে হলে দল তো বাজে করবেই। আফগানিস্তানের দিকে তাকান, তারা কেন ভালো করেছে? কারণ তাদের দুই ওপেনার ও তিন-চার নম্বর ব্যাটসম্যানরা রান করেছে। দলগতভাবে তারা ধারাবাহিকভাবে ২৮০-২৯০ রান করতে পেরেছে। এরপর তাদের বোলিং তো আছেই।”
“তাদের কাছ থেকে শেখার আছে বাংলাদেশের। তাদের বোলারদের জন্য তো কোনো সুযোগই করে দিতে পারেন না ব্যাটসম্যানরা। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দেখে মনে হয়েছে, তারা বিভ্রান্ত। নিজেদের করণীয় জানে না।”
বাংলাদেশ দল ও পারফরম্যান্স নিয়ে নানা সময় নানারকম মন্তব্য করলেও এদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে খুব গভীর ধারণা শেবাগের নেই। ঘরোয়া কাঠামো, ক্রিকেটের মান ও সিস্টেম খুব ভালো তিনি জানেন না। ‘অর্ডিনারি’ থেকে বাংলাদেশের ভালো বা খুব ভালো দল হয়ে ওঠার সম্ভাব্য সেরা পথ বা পথগুলো তার সেভাবে জানা নেই।
তবে তার সময়ের ভারতের অভিজ্ঞতা নিয়ে, সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বের উদাহরণ টেনে সম্ভাব্য পথ তিনি বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
“আমি জানি না আপনাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের কী অবস্থা বা কত সংখ্যক ভালো ক্রিকেটার দলের বাইরে আছে। যদি থাকে, আমার মনে হয়, সব পজিশনের জন্য উপযুক্ত ক্রিকেটার বাছাই করে তাদেরকে নিজেদের ভূমিকা পরিষ্কার করে দিতে হবে। তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে দল গড়তে হবে এবং তাদেরকে একটা প্রক্রিয়া ধরে এগিয়ে নিতে হবে। সময় লাগবে। তবে সময় তো আছে, মাত্রই এই বিশ্বকাপ শেষ হলো! দল গড়ার সময় আছে।”
“সৌরভ গাঙ্গুলি অধিনায়ক হওয়ার পর কিন্তু এই কাজটিই করেছে। নির্বাচকদের নিয়েই নিজের মতো করে দল গড়েছে। অভিজ্ঞদের যে ভূমিকা দেওয়া দরকার, দাদা তা দিয়েছেন। আবার ভরসা রেখেছেন আমার ওপরও। আমার মতোই ইউভরাজ সিং, ভাজ্জি (হরভজন সিং), জাহির খানদের ওপর ভরসা রেখেছেন তিনি। আমরা সবাই একসঙ্গে খুব ভালোভাবে মিশতে পেরেছি। এজন্যই ২০০৩ ও ২০১১ বিশ্বকাপে ভালো ফল পেয়েছি। ২০০৭ ব্যতিক্রম ছিল বিশেষ কারণে। এছাড়া আমরা ধারাবাহিক ছিলাম। বাংলাদেশেরও এমন কিছুর চেষ্টা করা উচিত লম্বা পরিকল্পনা নিয়ে।”
তার ছেলের প্রসঙ্গ এলো। গত মাসেই ১৬ পূর্ণ করেছে আরইয়াভি শেবাগ। দিল্লি অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলছে নিয়মিত। গত আইপিএলের আগে তিনি বলেছিলেন, “আমার ১৫ বছর বয়সী ছেলেও আইপিএল খেলতে চায়…।”
ছেলেকে নিয়ে মন খুলেই কথা বললেন শেবাগ। সাধারণত তার যে কোনো কথায় যেরকম মজা, কৌতূক, খোঁচা, সবই মিশে থাকে, ছেলেকে নিয়ে বলতে গিয়েও একই রূপে আবির্ভূত হলেন।
বরাবরই তার ব্যাটিং দর্শন ছিল, ‘বল দেখো আর মারো।’ এবার জানালেন, ছেলেকেও একই দীক্ষা তিনি দিচ্ছেন।
“ও তো এটাই স্রেফ বোঝে! ওকে আমি স্রেফ তিনটা ব্যাপার বলে থাকি- কোন বল মারতে হবে, কোনটা ছাড়তে হবে, কোনটা ঠেকাতে হবে। ক্রিকেট ব্যাটিংয়ে আমি ওকে সিম্পল কিছুর চেয়ে একটু বেশি কিছুও বলতে চাই না। টেকনিক-টুকনিক, এসব সে কোচদের কাছ থেকে শিখছে। মাইন্ডসেট শিখবে আমার কাছ থেকে।”
“এই বাড়তি সুবিধা তার আছে। অন্যদের চেয়ে সে এই সুবিধাটা বেশি পাচ্ছে। অন্যদের তো ভিরেন্দার শেবাগের মতো বাবা নেই! কিংবা সাচিন টেন্ডুলকার বা রাহুল দ্রাবিড়ের মতো বাবা নেই। আমরা এত ক্রিকেট খেলেছি যে, সেই মাইন্ডসেট আমাদের আছে, আমরা ওদেরকে বলতে পারি সাফল্য পাওয়া যায় কীভাবে। অবশ্যই তাদের প্রতিভা থাকতে হবে, চেষ্টা থাকতে হবে, সঙ্গে আমাদের মতো মাইন্ডসেট থাকলে ওরা সফল হবে।”
দর্শনের দীক্ষা তো চলছেই। ব্যাটিংয়ের ধরনেও নিশ্চয়ই বাবাকে অনুসরণ করে ছেলে?
বাবা বললেন, এরকম কিছুর চেষ্টা করাও হবে পণ্ডশ্রম।
“এটা তো ও জবাব দিতে পারবে, ওকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তবে আমি সবসময় ওকে বলি, ‘আমাকে কপি করিস না, তোর বাবা আলাদা জিনিস, এরকম একজনই হয়।”
ক্রিকেট ইতিহাসও এটার স্বাক্ষী। শেবাগের মতো আর কেউ নেই। একজনও নয়।