চোট আর সমালোচনা জয়ী 'আবেগী' তামিম

পাকিস্তান সিরিজের আগে ছিলেন তোপের মুখে; এখন ভাসছেন স্তুতির বন্যায়। একগাদা রেকর্ড গড়েছেন পাকিস্তান সিরিজে। আগের আরও কিছু কীর্তি মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের মূল ব্যাটিং রেকর্ডগুলোর প্রায় সবই তার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তামিম ইকবাল ফিরে তাকিয়েছেন ক্যারিয়ারের পথচলায়। কথা বলেছেন তার অর্জন, গত কিছুদিনের সমালোচনার স্রোত, সেসব সামলানো আর ভবিষ্যৎ স্বপ্ন-লক্ষ্য নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2015, 12:38 PM
Updated : 21 May 2015, 12:45 PM

চোটের কি অবস্থা?

তামিম ইকবাল:
বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ায় যখন অস্ত্রোপচার হয়েছিল আমার, তখন মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বকাপ খেলা। তবে ডাক্তার তখনই বলেছিলেন, ব্যথাটা ফিরে আসার শঙ্কা সামান্য হলেও আছে। আর ফিরে এলে বড় একটা অস্ত্রোপচার করাতে হতে পারে, যেটি করলে ৩-৪ মাস মাঠের বাইরে থাকতে হবে। বিশ্বকাপে ব্যথা হয়নি; কিন্তু পাকিস্তান সিরিজের শুরুর দিকেই ব্যথাটা ফিরে আসে। ব্যথা নিয়েই ওই সিরিজ খেলেছি হাঁটুতে টেপ পেঁচিয়ে। ব্যথাটা সারিয়ে তুলতেই এখন রিহ্যাব করছি।

ব্যথা থাকলে তো বড় অস্ত্রোপচার করাতেই হবে। কিন্তু এ বছর ঠাসা সূচি…

তামিম: আসলে পাকিস্তান সিরিজের আগে রিহ্যাবের খুব বেশি সময় পাইনি। এ জন্যই হয়ত ব্যথাটা ফিরে এসেছে। এখন যেহেতু একটু রিহ্যাব করার সময় আছে, এজন্যই মেডিকেল স্টাফদের পরামর্শে বিসিএলের শেষ রাউন্ডে খেলছি না। আসলে এখন যে ব্যথা, সেটা নিয়ে হয়ত কষ্ট করে খেলা যায়। কিন্তু আরও বাড়লে সম্ভব হবে না। যাই হোক, আশা করছি, রিহ্যাব করলে সেরে যাবে। আর না সারলে তখন পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পাকিস্তান সিরিজের শেষ দিনে যখন মাঠে নামলেন, তখন কি জানতেন যে হাবিবুল বাশারকে ছাড়িয়ে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট রানের রেকর্ডের হাতছানি আপনার সামনে?

তামিম:
জানতাম। আগের দিন যে ৩ হাজার রান হয়েছে, এটাও জানতাম। পরদিন মনে হয় ১৬ রান দরকার ছিল। ব্যাটিংয়ে নেমে মনে মনে রানও গুণছিলাম যে ৪৯ করলে সুমন ভাইকে ছাড়িয়ে যাব। অল্পের জন্য পারলাম না। খারাপ লেগেছে বেশ। সিরিজটি আমার জন্য খুব ভালো কেটেছে। রেকর্ডটি তখনই হয়ে গেলে শেষটাও খুব ভালোভাবে করা যেত। আশা করি, পরের সিরিজেই হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের কতগুলো ব্যাটিং রেকর্ড এখন আপনার, জানা আছে সেটা?

তামিম: সব জানা নেই। জানতেও চাই না। এসব ব্যাপার আমি মাথায় ঢোকাতে চাই না। মিডিয়ায় বা ফেইসবুকে মাঝে-মধ্যে দেখি, অনেকে বলে। তবে আমি ওসব নিয়ে ভাবি না।

তারপরও; দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান, সেঞ্চুরি, চার, সর্বোচ্চ ইনিংস, সিরিজের সেরা, অনেকগুলো জুটির রেকর্ড - আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যাটিং রেকর্ডই আপনার। এসব অর্জনে গর্ব হওয়ার কথা।

তামিম:
ভালো লাগে। তবে খুব বেশি উচ্ছ্বাসের কিছু দেখি না। আমার কাছে মনে হয় না, এমন কিছু করে ফেলেছি যে অনেক আলোচনা হওয়া উচিত। যদি আমার রান ৮ হাজার বা ওইরকম হতো, তাহলে হয়ত বড় অর্জন হতো। কিন্তু যেহেতু আমাদের সাবেকরা খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি আমাদের মতো, এজন্য রেকর্ডগুলো খুব কঠিন কিছু নয়। সুমন ভাই যদি এত ঘন ঘন ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতেন, উনার রান অবশ্যই ৬-৭ হাজার হতো। ওই রান ছাড়িয়ে যেতে পারলে বলতাম বড় অর্জন। এখন আমি বা সাকিব-মুশফিকরা যদি ৭-৮ বা ১০ হাজার বা আরও বেশি রান করে যেতে পারি, ভবিষ্যতে যখন কেউ তা ছাড়িয়ে যাবে, সে অবশ্যই বেশি তৃপ্তি পাবে।

এই যে দেশের প্রায় সব ব্যাটিং রেকর্ড আপনার, অথচ আপনার সমালোচনাই সবচেয়ে বেশি হয়। পাকিস্তান সিরিজের আগে গত কিছুদিনে যা প্রবল ভাবে হয়েছে; এত অর্জনের পাশেই এত সমালোচনা, কেমন লাগে?

তামিম:
খারাপ তো লাগেই; প্রচণ্ড খারাপ লাগে। এক ধরণের মানুষ আছে যারা এসব নিয়ে বেশি ভাবে না। আবার আরেক ধরনের আছে আমার মতো, একটু ইমোশনাল। এসব আমার গায়ে লাগে, খুব খারাপ লাগে। এত এত রেকর্ড আছে বলেই সমালোচনা করা যাবে না, তা নয়। খারাপ খেললে অবশ্যই সমালোচনা হবে। কিন্তু সেটা হওয়া উচিত সুনির্দিষ্ট, এবং অবশ্যই ক্রিকেটিং ইস্যুতে। ২-৩ ম্যাচে রান না পেলেই যখন এত বেশি আলোচনা হয়, তখন নিজের সামর্থ্যের প্রতিও সংশয় জন্মায়। মনে হয়, ‘আমি আসলেই এত বাজে ক্রিকেটার’ বা ‘আমি কি পারব?’

আপনার ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা ক্রিকেট ও মাঠ ছাড়িয়ে ঘরে, পরিবারে চলে গেছে। ফেইসবুকে এত বাজে সব 'ট্রল' বা টুইটারে এত কথা, এসব আপনি দেখেছেন বা দেখেন?

তামিম: চেষ্টা করি, যতটা সম্ভব না দেখতে। নিজের ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে আমি খুব কমই যাই। গেলেও একটু থেকে বের হয়ে যাই। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে দেখতে না চাইলেও চলে আসত। হয়ত আমার চোখে পড়ে যাচ্ছে বা পাশেই কেউ দেখছে বা নানা ভাবে কানে এসে যাচ্ছে। বিশ্বকাপের সময় একটা পর্যায়ে আমি অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভেট করে রাখতে বাধ্য হয়েছি। পরে বুঝেছি এসব ভাবলে আসলে লাভ নেই। নিজেরই ক্ষতি। চেষ্টা করেছি তাই মানসিকভাবে শক্ত হতে। আমি এমন একটা ছেলে, হয়ত মাঠে ১ হাজার লোক আমাকে গালি দিচ্ছে, আমার কিচ্ছু যায়-আসছে না। কিন্তু কোনো ছোট ছেলে বা কেউ একজন এমন কিছু বলল, হঠাৎ যা খুব গায়ে লেগে যায়। এতটা ইমোশনাল আসলে হওয়া উচিত না। চেষ্টা করছি কাটিয়ে উঠতে।

আমি জানি এখন ভাল খেলছি বলে অনেক ভাল ভাল কথা লেখা বা বলা হচ্ছে। কিন্তু লিখে দিতে পারি, একটা সিরিজ বা ২-৩টা ম্যাচ খারাপ খেললে আবার শুরু হয়ে যাবে যাচ্ছেতাই সমালোচনা। লোকে বলবে, দুইটা সেঞ্চুরি করেই মাথায় উঠে গেছে। তো এসব নিয়েই চলতে হবে। চেষ্টা করছি, মানিয়ে নিতে। আমার স্ত্রীকেও মাঝেমধ্যেই বলি, ‘এখন দেখবে কত প্রশংসা, সব জায়গায় কত সমাদর। কিন্তু শুধু মনে রাখবে, দুই এক মাস আগে কী অবস্থা ছিল..।’

কি অবস্থা ছিল তখন? আপনার স্ত্রীর জন্য কতটা কঠিন ছিল?

তামিম: আয়েশার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই যখন অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট খেলছি তখন থেকে। ও কিন্তু জানত না যে, আমি ক্রিকেটার হব বা তারকা ক্রিকেটার হব। ও কিন্তু আমার নামকে বিয়ে করেনি, আমাকেই করেছে। ওর কাছে আমি সেই তামিমই। কিন্তু ক্রিকেটে আমার বাজে সময়ের যন্ত্রণাটা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ওকেও সইতে হয়েছে।

আপনার কাজটা তো তাতে আরও কঠিন হয়ে উঠেছে, ঘরে-বাইরে কোথাও শান্তি নেই অবস্থা!

তামিম: নাহ, ও আমাকে কখনো ওর যন্ত্রণার কথা জানতে দেয়নি। ওর অনেক খারাপ লেগেছে, কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু আমাকে বুঝতে না দিয়ে সবসময় পাশে থেকেছে। একটা পর্যায়ে ব্যাপারটা অতিরিক্ত হয়ে গেছে, সহনশীলতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তখন কিছু কিছু বলেছে। আমি বিস্তারিত সব জেনেছি পরে। বিশ্বকাপ থেকে ফেরার পর জেনেছি, ওকে মাঝেমধ্যেই গভীর রাতে ফোন করে লোকে অকথ্য গালিগালাজ করেছে। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। লোকজন কোন পর্যায়ে নামতে পারে! আমি রান না পেলে ওই মেয়েটার দোষ কোথায়!

আরেকটা মজার কথা বলি। আমাকে নিয়ে একটা ট্রল বানানো হয়েছিল ম্যাগি নুডুলস সংক্রান্ত। যে লোক প্রথম এটি বানিয়েছিল, সে পরে আমার স্ত্রীকে ফেইসবুকে বিশাল এক চিঠি লিখেছে। সরি-টরি বলে লিখেছে, ‘আমিই এই ট্রল প্রথম বানিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ভুল বুঝবেন না। আমরা ইচ্ছা করেই এমনটা করেছি যেন তামিম ক্ষেপে গিয়ে আসল রূপে ফিরে আসে।’ আমি শুনে হেসেছি, একটা লোক কোন পর্যায়ে নামতে পারে! আমাকে অপমান করে অনুপ্রেরণা দেওয়ার তো দরকার নেই!

আরও অনেক বাজে খোঁচা ছিল...

তামিম:
অনেকগুলোই আমার চোখে পড়েছে। এসব নিয়ে আমি অনেকবারই ভেবেছি যে কিছু বলব মিডিয়ায়। আজ আপনাকে বলছি। এই ‘মজা লস’ বা এই ধরনের আরও অনেক ফেইসবুক পেইজ আছে যারা ট্রল করে বা বানায়। শুধু আমাকে নিয়ে নয়, সব ক্ষেত্রের অনেককে নিয়েই, এসব হয়ত দেখতে এমনিতে মজা লাগে। সবাই মজা পায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এসব খুবই সস্তা ও কুরুচিপূর্ণ হয়। আর এসব করলে নিজেদেরও সৎ সাহস থাকা উচিত।

আমার বলার উদ্দেশ্য হলো যে, এতটা ব্যক্তিগত আক্রমণ যারা করে, তারা কখনও কারও ভালো চায় না। ক্রিকেটের সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্ক নেই। যে কোনো ক্রিকেটিং সমালোচনা আমি ওয়েলকাম করি। কিন্তু বক্তিগত আক্রমণ হলো স্টুপিডিটি।

আপনার ক্ষেত্রেই কেন এমন হয়? কেন আপনাকেই এত বেশি টার্গেট করা হয়?

তামিম: আমি জানি না। আসলেই জানি না। হ্যাঁ, কিছু কিছু ব্যাপার আমি মেনে চলি। আমি মনে করি, ক্রিকেটার ও সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকদের মধ্যে একটা দূরত্ব বা একটা সীমারেখা থাকা দরকার। আমরা পেশাদার ক্রিকেটার, আপনারা পেশাদার সংবাদকর্মী। সবাই নিজেদের জায়গা থেকে পেশাদারিত্ব দেখিয়ে নিজেদের কাজটা করে যাব। ভালো সম্পর্ক বা ভালো ভাবে কথা বলা, এসব অবশ্যই থাকবে। তবে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থাকা উচিত। এটা অনেকে ভালভাবে নেয় না। এজন্য অনেকে ভুল বুঝতে পারে।

আমজনতার মাঝেও একটা প্রচার আছে আপনি উদ্ধত, অহংকারী…

তামিম:
ওই একই কারণ। অনেক সময় শুনেছি, লোকে মনে করে আমি খুব অহংকারী। আমার বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতরা এসব শুনলে হাসে। দেখুন, একেকটা মানুষের ধরন একেকরকম। আমার ধরনটা হলো, আমি নিজে যেচে গিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলি না। সাংবাদিক বলুন বা কোনো ফ্যান বা অন্য যে কেউ, আমি হয়ত নিজে থেকে গিয়ে গলাগলি ধরে বা কাঁধে হাত রেখে কথা বলি না। তার মানে এই নয়, আমি অহংকারী। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে আসলে কথা বলিনি বা খারাপ ব্যবহার করেছি, এমন কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আপনারা যারা আমাকে দেখেছেন, দেখছেন, আপনারাও জানেন, আমি কতটা আন্তরিক। লোকে দূর থেকে দেখে কেন ভুল ধারণা করে, কেন ভুল বোঝে, আমি সেটা বুঝি না!