পুলিশের বরাত দিয়ে এবিসি নিউজ জানিয়েছে, শনিবার রাতে উত্তর কুইন্সল্যান্ডের টাউন্সভিলের কাছে দুর্ঘটনায় পড়ে সাইমন্ডসের গাড়ি। অবসরের পর ওই এলাকাতেই থাকছিলেন ৪৬ বছর বয়সী সাবেক এই তারকা ক্রিকেটার।
টাউন্সভিলের পুলিশ বলেছে, স্থানীয় সময় রাত ১১টার পরপর এলিস রিভার ব্রিজ থেকে বাঁদিকে যাওয়ার সময় উল্টে যায় সাইমন্ডসের গাড়ি। উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়।
তবে কেন এই দুর্ঘটনা ঘটল, তা এখনও জানতে পারেনি পুলিশ।
২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার শিরোপা জয়ে বড় অবদান ছিল সাইমন্ডসের। ওই দশকে টেস্ট দলেও বছর দুয়েক তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
প্রায় ১১ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১৯৮ ওয়ানডে খেলে তার রান ৫ হাজার ৮৮। সেঞ্চুরি ৬টি, ফিফটি ৩০টি। ব্যাটিং গড় ৩৯.৭৫। তবে তিনি ‘স্পেশাল’ ছিলেন যে কারণে, তা খানিকটা ফুটে ওঠে তার স্ট্রাইক রেটে, ৯২.৪৪। বল হাতে উইকেট ১৩৩টি।
টেস্ট খেলেছেন ২৬টি। ২ সেঞ্চুরি ও ১০ ফিফটিতে ১ হাজার ৪৬২ রান করেছেন ৪০.৬১ গড়ে। উইকেট নিয়েছেন ২৪টি। টি-টোয়েন্টির তখনও কেবল শুরুর সময়। ম্যাচ খেলতে পেরেছেন ১৪টি। ৪৮.১৪ গড় ও ১৬৯.১৪ স্ট্রাইক রেটে রান তার ৩৩৭, উইকেট ৮টি।
তবে এসব রেকর্ড-পরিসংখ্যান সাইমন্ডসকে বোঝাতে পারবে সামান্যই। তিনি ছিলেন ‘আল্টিমেট’ অলরাউন্ডার। টি-টোয়েন্টির জমানায় এখন ‘ইম্প্যাক্ট’ ক্রিকেটারদের যে জয়গান, সাইমন্ডস সেসব দেখিয়েছেন বহু বছর আগেই। ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে কার্যকর ক্রিকেটারদের একজন মনে করা হয় তাকে।
ব্যাট হাতে সাইমন্ডস ছিলেন বিধ্বংসী, ভয়ডরহীন। পেশিশক্তি আর শরীরী ভাষায় গুঁড়িয়ে দিতেন প্রতিপক্ষকে। বোলিংয়ে তিনি বুদ্ধিদীপ্ত মিডিয়াম পেস ও অফ স্পিন, দুটিই করতেন। দলের ভারসাম্যের জন্য যা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ফিল্ডিংয়ে তো তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের একজন।
সেই ১৯৯৫ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে কাউন্টি ক্রিকেটে গ্লস্টারশায়ারের হয়ে ২০৬ বলে ১৫৪ রানের ইনিংসের পথে ১৬টি ছক্কা মেরেছিলেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড ছিল যা অনেকদিন।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের শুরুর দিকেই কেন্টের হয়ে মিডলসেক্সের বিপক্ষে ৩৪ বলে করেন সেঞ্চুরি। ২০১৩ সালে ক্রিস গেইল ৩০ বলে সেঞ্চুরি করার আগ পর্যন্ত সেটিই ছিল এই সংস্করণে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড।
সাইমন্ডসের জন্ম ১৯৭৫ সালের ৯ জুন, ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে। তিন মাস বয়সে তাকে দত্তক নেন এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি। অস্ট্রেলিয়া হয় তার নতুন ঠিকানা। ক্রিকেট পাগল বাবার হাত ধরেই তার ক্রিকেটে আসা। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সিস্টেমেই তিনি বেড়ে ওঠেন। তবে জন্মভূমি ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটেও খেলতেন নিয়মিত।
ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট মাতিয়ে ইংল্যান্ড ‘এ’ দলে ডাকও পান। তবে তার স্বপ্ন ছিল অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা। তাই উপেক্ষা করেন ইংল্যান্ডের দেওয়া সুযোগ।
তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৯৮ সালে। পাকিস্তানের বিপক্ষে লাহোরে ওয়ানডে দিয়ে অভিষেক হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ক্যারিয়ারের তৃতীয় ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে ৬৮ বলে ৬৮ রানের ইনিংস খেলেন শ্রীলঙ্কায় ত্রিদেশীয় ক্রিকেটে। তবে ওই সময়ের শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া দলে আসা-যাওয়া করতেই কেটে যায় অনেকটা সময়।
দলে থিতু ও নিজেকে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার শুরু তার ২০০৩ বিশ্বকাপ থেকে। আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৬ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারিয়ে ভীষণ বিপদে ছিল অস্ট্রেলিয়া। ছয়ে নেমে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতার, আব্দুল রাজ্জাকদের বিপক্ষে ১২৫ বলে ১৪৩ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন সাইমন্ডস।
আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ক্রমে হয়ে ওঠেন তিনি দলের ‘নিউক্লিয়াস।’ স্বপ্নের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ পান ২০০৪ সালে। তবে যথারীতি টেস্টেও পায়ের নিচে জমিন খুঁজে পেতে তার সময় লাগে অনেকটা। ২০০৬-০৭ অ্যাশেজে বক্সিং ডে টেস্টে ১৫৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে অবশেষে টেস্টেও নিজের ছাপ রাখেন।
২০০৮ সালে ভারতের বিপক্ষে সিডনিতে খেলেন তার টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা ১৬২ রানের ইনিংস। ওই টেস্টই পরে তুমুল বিতর্ক ছড়ায় বর্ণবাদের অভিযোগ দিয়ে, ক্রিকেটে যা পরিচিত হয়ে আছে ‘মাঙ্কিগেট’ কেলেঙ্কারি নামে। সাইমন্ডস ছিলেন সেই বিতর্কের কেন্দ্রীয় চরিত্রদের একজন।
মাঠের বাইরে বিতর্ক তার নিত্যসঙ্গী ছিল। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের দিন সকালে তিনি হাজির হন মাতাল হয়ে। তখনই তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। কার্ডিফে সেদিন বড় অঘটন ঘটিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের সময়ই ডারউইনে টিম মিটিং বাদ দিয়ে তিনি চলে যান মাছ ধরতে। সেবারও দল থেকে প্রত্যাহার করা হয় তাকে। ২০০৯ সালে আবার মদ্যপানের ঝামেলায় জড়িয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে দল থেকে বাদ পড়েন এবং এবার বোর্ডের চুক্তিও হারান। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে যায় এই দফায়।
একের পর এক বিতর্কে না জড়ালে তার ক্যারিয়ার আরও দীর্ঘ হতো নিশ্চিতভাবেই। রেকর্ড-পরিসংখ্যান-অর্জনের ভাণ্ডারও হতো সমৃদ্ধ।
প্রথম আইপিএলের নিলামে তাকে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ডলারে দলে নেয় ডেকান চার্জাস, তার কার্যকারিতা ও চাহিদার একটি প্রমাণ। দ্বিতীয় আইপিএলে ডেকানের শিরোপা জয়ে তার ছিল বড় অবদান।
২০০৯ সালের পর শুধু টি-টোয়েন্টি খেলছিলেন। ২০১২ সালে সেই অধ্যায়ও চুকিয়ে দেন। এরপর অবসর জীবন। গত কয়েক বছর ধরে ক্রিকেটের সঙ্গে তার সংযোগ ছিল ধারাভাষ্য দিয়ে। এবার সবকিছুর অবসান।
স্ত্রী লরা ও দুই শিশু সন্তান ক্লোয়ি ও বিলিকে রেখে গেছেন সাইমন্ডস।