মাশরাফির ৪ উইকেট, চিরাগ-তানবীরের নৈপুণ্যে রূপগঞ্জের জয়

লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের উইকেট চারটি পড়ার পর থেকে ড্রেসিং রুমের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে কোচ আফতাব আহমেদ ও বোলিং কোচ নাজমুল হোসেন। একেকজন ব্যাটসম্যান উইকেটে যাওয়ার সময় তারা সাহস জোগান  আর সেই ব্যাটসম্যান ফিরে আসেন একটু পরই। টেনশন, উত্তেজনা, শঙ্কা, সবকিছুর রেশ কোচদের চোখেমুখে। ওপরের গ্যালারি থেকে চেঁচামেচি করছেন দলের কর্মকর্তারা। ১৯৯ রান তাড়াতেই যে ভজকট অবস্থা দলের! শেষ পর্যন্ত আফতাবদের মুখে হাসি ফুটে উঠল শেষ ওভারে। নাটক জমিয়ে, রোমাঞ্চ ছড়িয়ে সহজ ম্যাচ কঠিন করে রূপগঞ্জ জিতল তিন বল বাকি রেখে।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2022, 12:12 PM
Updated : 6 April 2022, 04:06 PM

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের লড়াইয়ে যে কয়টি ম্যাচে জয় সম্ভাব্য ধরে রেখেছে রূপগঞ্জ, সেগুলোর মধ্যে নিশ্চিতভাবেই ছিল খেলাঘর সমাজ কল্যান সংঘের বিপক্ষে ম্যাচ। সেই ম্যাচেই পা হড়কানোর জোগাড় হয়েছিল তাদের। মাশরাফির ৪ উইকেট ও চিরাগ জানির দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সও যথেষ্ট হচ্ছিল না। পরে সাতে নেমে তানবীর হায়দারের অপরাজিত ফিফটি দলকে এনে দেয় স্বস্তির জয়।

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বুধবার খেলাঘরকে ১৯৮ রানে আটকে রেখে রূপগঞ্জ দুই উইকেটে জেতে।

উইকেট এ দিন ব্যাটিংয়ের জন্য কঠিন ছিল খানিকটা। বল কিছুটা থমকে আসে, বাউন্স ছিল একটু অসমান। বিশেষ করে নিচু হচ্ছিল প্রায়ই। দুই দলের বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানকেই ধুঁকতে হয় সেখানে। সেই উইকেটেই ৭৮ বলে ৭২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন ভারতীয় অলরাউন্ডার চিরাগ। ব্যাটিংয়ের আগে বল হাতে সৌরাষ্ট্রের এই ক্রিকেটার নেন ৩ উইকেট।

ম্যাচের সেরা যদিও মাশরাফি। শেষ দিকে এক ওভারে তিনটিসহ রুপগঞ্জ অধিনায়কের শিকার ৩৮ রানে ৪ উইকেট।

লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে এই স্বাদ পেলেন তিনি ১৫ বার। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার ৪ উইকেটের রেকর্ডে ছড়িয়ে গেলেন সাকিব আল হাসানকে (১৪)। সঙ্গে মাশরাফির ৫ উইকেটও আছে আরও ৬ বার।

টস জিতে বোলিংয়ে নেমে রূপগঞ্জ বড় উইকেটের দেখা পায় দ্রুতই। অভিজ্ঞ লঙ্কান ব্যাটসম্যান উপুল থারাঙ্গাকে ৩ রানে থামান আল আমিন হোসেন।

আরেক ওপেনার হাসানুজ্জামান স্বভাবসুলভ আগ্রাসী খেলে রান বাড়াতে থাকেন। প্রথম ওভারেই নাবিল সামাদকে তিনটি চার মারেন তিনি। মাশরাফিকে স্বাগত জানান ছক্কায়। এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে ছক্কা মারেন আল আমিনের বলেও।

অভিজ্ঞ মাশরাফি শোধ তুলতে সময় নেননি। বোল্ড করে দেন তিনি হাসানুজ্জামানকে (২২ বলে ২৯)।

খেলাঘরকে সেখান থেকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করেন অমিত মজুমদার ও অমিত হাসান। দুই অমিতের জুটিতে রানের গতি অবশ্য কমে আসে অনেকটা।

এই মৌসুমে ও এবারের লিগে দারুণ ফর্মে থাকা অমিত হাসানকে ১৬ রানে ফিরিয়ে ৪২ রানের জুটি ভাঙেন চিরাগ। বারবার বাইরে বল তাড়া করতে গিয়ে একটিতে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন অমিত। পরে চিরাগের সোজা বল থার্ডম্যানে খেলতে গিয়ে বোল্ড হন সালমান হোসেন (৯)।

তিনে নেমে দীর্ঘক্ষণ এক প্রান্ত আগলে রেখে ফিফটি করেন অমিত মজুমদার। তবে কাজ শেষ করতে পারেননি বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যানও। নাঈম ইসলামের সোজা বল আলগাভাবে পুল করার চেষ্টায় বোল্ড হয়ে যান ৮৮ বলে ৫৯ করে।

এরপর অভিজ্ঞ নাদিফ একটি করে চার ও ছক্কায় ২৫ রান করে বোল্ড হন চিরাগের বলে। শেষ দিকে মাসুম খান ২৪ রান করে দলকে নিয়ে যান দুইশর কাছে।

৪৮তম ওভারে তিন উইকেট নিয়ে মাশরাফি খেলাঘরকে আটকে রাখেন দুইশর নিচে। ইফতেখার সাজ্জাদ উড়িয়ে মেরে ধরা পড়েন মিড উইকেটে, পরের বলে অফ কাটারে উড়িয়ে মারার চেষ্টায় মাসুম ক্যাচ দেন মিড অফে। একটুর জন্য মাশরাফির হাটট্রিক না হলেও পরের বলেই মিড অফে সহজ ক্যাচ দেন নূর আলম সাদ্দাম।

রান তাড়ায় মাসুম খানের প্রথম ওভারেই ইরফান শুক্কুর ধরা পড়েন উইকেটের পেছনে। আরেক ওপেনার সাব্বির হোসেন বোল্ড হন বাঁহাতি স্পিনার টিপু সুলতানকে স্লগ করার চেষ্টায়। ষষ্ঠ ওভারে তখন রূপগঞ্জের রান ২ উইকেটে ১৫।

দুর্দান্ত ফর্মে থাকা চিরাগ ও নাঈম ইসলাম সেখান থেকে টেনে নেন দলকে। যদিও রান বাড়ানোর কাজটি করছিলেন মূলত চিরাগই। নাঈম ধুঁকছিলেন শুরু থেকেই। তবে আউট না হয়ে সঙ্গ দিয়ে যান চিরাগকে।

চিরাগ যেন ব্যাট করছিলেন ভিন্ন কোনো উইকেটে। নিজের জোনে বল পেলেই উড়িয়ে মারছিলেন লং অন, লং অফ বা এক্সট্রা কাভার দিয়ে। দারুণ কয়েকটি স্ট্রেট ড্রাইভও খেলেন।

এই জুটিতেই একশ পেরিয়ে যায় রূপগঞ্জ। জয় মনে হচ্ছিল তখন স্রেফ সময়ের ব্যাপার। হুট করেই ম্যাচের চিত্র বদলে দেন সালমান হোসেন। শুরুতে তার জেন্টল মিডিয়াম পেস বলে, এরপর দুর্দান্ত ক্যাচে।

তার একটি বল আচমকা বাড়তি লাফিয়ে চিরাগের ব্যাটে চুমু দিয়ে আশ্রয় নেয় কিপারের কাছে। ব্যাটসম্যানের করার ছিল সামান্যই। ৭ চার ও ২ ছক্কার দারুণ ইনিংস থামে ৭২ রানে। শেষ হয় ৯০ রানের জুটি।

এবারের লিগে চিরাগের রান এখন ৭ ইনিংসে ৬৮.৩৪ গড় ও ৯০.৯০ স্ট্রাইক রেটে ৪১০।

সালমানের পরের ওভারে অনেক নিচু হওয়া বলে বোল্ড নাঈম। লিগের প্রথম ৬ ম্যাচে তিনটি নব্বই, দুটি সেঞ্চুরি ও একটি ফিফটির পর এবার অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান আউট হলেন ৬১ বলে ২৪ করে।

এরপর সালমানের শিকার সাব্বির রহমান,তবে ফিল্ডিংয়ে। মাসুম খানের বলে কাভারে ডান দিকে ফুল লেংথ ডাইভ দিয়ে দর্শনীয় ক্যাচ নেন তিনি।

২ উইকেটে ১০৫ থেকে রূপগঞ্জ তখন ৫ উইকেটে ১১১!

রকিবুল হাসান ও তানবীর হায়দার সেখান থেকে দলকে টানেন কিছুক্ষণ। সালমান বাগড়া দেন সেখানেও। নিজের বলে সামনে ডাইভ দিয়ে ক্যাচ নিয়ে ফেরান রকিবুলকে (১৪)।

এরপর লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে তানবীরের লড়াই। এক-দুই করে রান বাড়াতে থাকেন তিনি। অধিনায়ক মাশরাফি কিছুটা সঙ্গ দিয়ে আউট হন ১২ রানে। আসিফ হাসান গিয়ে একটি ছক্কা মেরে আউট হন ৮ রানে।

তবে তানবীর লক্ষ্যে অটল থেকে দলের জয় সঙ্গে নিয়েই ফেরেন ৬১ বলে অপরাজিত ৫২ রান করে। শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে তিন রানের। প্রথম তিন বলেই তিনটি সিঙ্গেল নেন তানবীর ও নাবিল।

৭ ম্যাচে রূপগঞ্জের এটি ৫ম জয়, ৮ ম্যাচে খেলাঘরের সপ্তম হার।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

খেলাঘর: ৪৮ ওভারে ১৯৮ (থারাঙ্গা ৩, হাসানুজ্জামান ২৯, অমিত মজুমদার ৫৯, অমিত হাসান ১৬, সালমান ৯, নাদিফ ২৫, সানি ১, মাসুম ২৪, ইফতেখার ১৪, সাদ্দাম ০, টিপু ০*; নাবিল ১০-৩-২৯-১, আল আমিন ৭-২-৩৩-১, মাশরাফি ৮-১-৩৮-৪, নাঈম ৭-০-২৫-১, আসিফ ৭-১-১৮-০, চিরাগ ৯-০-৫১-৩)।

রূপগঞ্জ: ৪৯.৩ ওভারে ১৯৯/৮ (ইরফান ০, সাব্বির হোসেন ৩, চিরাগ ৭২, নাঈম ২৪, রকিবুল ১৪, সাব্বির রহমান ২, তানবীর ৫১, মাশরাফি ১২, আসিফ ৮, নাবিল ৪*; মাসুম ৯.৩-২-২৬-২, টিপু ৮-০-৩২-১, সাদ্দাম ১০-০-৪১-১, সানি ৯-০-৩২-১, ইফতেখার ৪-০-১৯-০, সালমান ৯-০-৪৫-৩)।

ফল: লিজেন্ডস অপ রূপগঞ্জ ২ উইকেটে উইকেটে জয়ী।

ম্যান অব দা ম্যাচ: মাশরাফি বিন মুর্তজা।