বোলিংয়ের তৃপ্তি মিলিয়ে গেল শেষ বিকেলের ব্যাটিং হতাশায়

বোলিংয়ে ‘৩’ সংখ্যাটি বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছিল স্বস্তির পরশ। ইবাদত হোসেন চৌধুরি ও মেহেদী হাসান মিরাজ দুর্দান্ত বোলিংয়ে নেন ৩টি করে উইকেট। কিন্তু দিন শেষে সেই সংখ্যাটিই এখন বিভীষিকার প্রতিশব্দ। ব্যাটিংয়ে নেমে যে ৩ উইকেট উধাও টপাটপ! ইতিহাস গড়ার রোমাঞ্চও তাই আপাতত বিলীন। বরং সঙ্গী এখন হারের শঙ্কা আর চাপা আর্তনাদ।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2022, 04:35 PM
Updated : 3 April 2022, 05:32 PM

ডারবান টেস্টের চতুর্থ দিনে দেখা গেল টেস্ট ক্রিকেটের নানা রঙ। টপ অর্ডারের সৌজন্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ভালো অবস্থানে যাওয়ার পর বাংলাদেশ বোলিংয়ে ঘুরে দাঁড়াল দারুণভাবে। ফিল্ডিংয়ে সহজ ক্যাচ যেমন পড়ল, তেমনি দারুণ কিছু ক্যাচ ও রান আউট হলো। তুমুল লড়াইয়ের দিনে শেষ বেলায় পাল্টে গেল সব সমীকরণ।

দক্ষিণ আফ্রিকার রান এক সময় ছিল ১ উইকেটে ১১৬। অপেক্ষা তখন, তারা ইনিংস ঘোষণা কখন করে। বাংলাদেশ পাশার দান উল্টে দিয়ে তাদেরকে অলআউট করে দিল ২০৪ রানে।

জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ২৭৪। টেস্টের শেষ ইনিংসে এই রান তাড়া করা যে কোনো উইকেটে, যে কোনো কন্ডিশনে কঠিন। তবে অসম্ভব তো নয়! দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম টেস্ট জয়ের সম্ভাবনা কিছুটা হলেও উঁকি দিচ্ছিল তখন।

কিন্তু ইনিংসের ৬ ওভারেই লক্ষ্যট হয়ে উঠল যেন অসম্ভরের কাছাকাছি। আলোকস্বল্পতায় যখন দিনের খেলা শেষ হলো ২০ ওভার আগেই, বাংলাদেশের রান ৩ উইকেটে ১১!

জোর হাতে ডিফেন্স করে উইকেট হারালেন সাদমান ইসলাম। প্রথম ইনিংসের নায়ক মাহমুদুল হাসান জয় বোল্ড হলেন কেশভ মহারাজের দারুণ এক ডেলিভারিতে। মহারাজের বলেই বাংলাদেশ অধিনায়ক মুমিনুল হক কী করতে চাইলেন, জানেন না হয়তো নিজেও।

কন্ডিশন কঠিন, উইকেটও সহজ নয়। তবে এভাবে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার মতোও নয়। দেশে স্পিন খেলে বড় বেড়ে ওঠা একের পর এক ব্যাটসম্যান চোখের পলকে ধরা পড়লেন হার্মার-মহারাজের স্পিন জালে।

অথচ ওই কয়েকটা ওভার দাঁতে দাঁত কামড়ে পার করে দিতে পারলেই দিনটি শেষ হতে পারত স্বস্তিতে। নতুন দিনের অপেক্ষায় থাকা যেত রোমাঞ্চ আর আশা নিয়ে।

দিনজুড়ে চালিয়ে যাওয়া বোলারদের প্রচেষ্টাকে সম্মান জানানোও তো হতো। দুর্দান্ত স্কিল, দারুণ পরিকল্পনা আর তীব্র তাড়নার মিশেলে কী অসাধারণ পারফরম্যান্সই না উপহার দিয়েছিল দল!

প্রথম ইনিংসে চার উইকেট শিকারি সৈয়দ খালেদ আহমেদ যদিও এবার উইকেটের দেখাই পাননি। তবু ভুগতে হয়নি দলকে। গতি, সুইং আর মুভমেন্ট মিলিয়ে ইবাদত হোসেন চৌধুরির শিকার ৩ উইকেট। বোলিংয়ে সাম্প্রতিক আলোর ছটা ধরে রেখে মেহেদী হাসান মিরাজেরও শিকার ৩টি।

তবে তাদেরকেও ছাপিয়ে যান যেন তাসকিন আহমেদ। উইকেট তার দুটি। তবে স্রেফ উইকেটে আটকে রাখা যাবে না তার বোলিংকে। কাঁধের চোটের কারণে এই টেস্ট শেষেই তাকে ফিরতে হবে দেশে। চোটের কারণে আক্রমণে আসেন তিনি ষষ্ঠ বোলার হিসেবে। কিন্তু ডান কাঁধে টেপ পেচিয়ে ডানহাতি পেসার বোলিং করলেন যেন নিজেকে উজাড় করে। ১৪০ কিলোমিটার গতি আর নিখুঁত নিশানায় কাঁপিয়ে দিলেন প্রোটিয়া ব্যাটিং।

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং অবশ্য এক সময় বেশ ভালোই এগোচ্ছিল। ওপেনার সারেল এরউইয়া যদিও ৫১ বল ধুঁকে আউট হয়ে যান ৮ রান করে। তবে ডিন এলগার প্রথম ইনিংসের মতোই এগিয়ে নেন দলকে।

তাকেও অবশ্য ফিফটির আগে ফেরাতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু ৩৪ রানে তার ক্যাচ ছাড়েন নাজমুল হোসেন শান্ত, ৪৩ রানে ইয়াসির আলি চৌধুরি। এই সুযোগে তিনি জুটি গড়ে তোলেন কিগান পিটারসেনকে নিয়ে।

এই পিটারসেনকেও ১৪ রানে থামানো যেত। কিন্তু খালেদের বলে আম্পায়ার এলবিডব্লিউ দেননি, বাংলাদেশ রিভিউ নেয়নি। রিপ্লেতে দেখা যায়, পরিষ্কার আউট ছিলেন তিনি।

চোট নিয়ে তাসকিন বোলিংয়ে এসে এলগারকে ফিরিয়ে থামান ৬৮ রানের জুটি। প্রোটিয়া অধিনায়ক ফেরেন ৬৪ রানে।

এরপর আসে কিছু জাদুকরী মুহূর্ত। মিরাজের বলে শর্ট লেগে পিটারসেনের (৩৬) দারুণ রিফ্লেক্স ক্যাচ নেন মাহমুদুল হাসান জয়। প্রথম ইনিংসে ৯৩ রান করা টেম্বা বাভুমা আউট হন স্লিপে ইয়াসিরের অবিশ্বাস্য এক ক্যাচে।

ইবাদতের বলে বাভুমার ব্যাট ছুঁয়ে আসা বলে সাড়া দিতে সামান্য দেরি করেন ইয়াসির। তবে পুষিয়েও দেন তা। গুলির বেগে নিচু হয়ে আসা বল অসাধারণ ক্ষীপ্রতায় এক হাতে জমান তিনি বাঁদিকে ডাইভ দিয়ে।

পাঁচে নামা রায়ান রিকেলটন এরপর লড়াই চালিয়ে যান। কিন্তু পরের ৬ ব্যাটসম্যানের কেউ টিকতে পারেননি বেশিক্ষণ। তাসকিন-মিরাজ-ইবাদত ত্রয়ীর বোলিংয়ের সঙ্গে যোগ হয় দুটি রান আউট। সীমানার কাছ থেকে দুর্দান্ত সরাসরি থ্রোয়ে স্টাম্প ভেঙে দেন বদলি ফিল্ডার নুরুল হাসান সোহান, যিনি মূলত কিপার। সিলি পয়েন্টে দারুণ ক্যাচ নেওয়ার পর সাদমান হাত বাড়ান আরেকটি রান আউটে।

শেষ ৫ উইকেট বাংলাদেশ নেয় ৩২ রানে। অভিষিক্ত রিকেলটন অপরাজিত থাকেন ৩৯ রানে।

বাংলাদেশ দল তখন ফুরফুরে। চলছিল কিছু স্বপ্নের আঁকিবুঁকি। কিন্তু সাদমান-মুমিনুলরা ব্যাট হাতে পারলেন না তাতে নতুন রঙ চড়াতে। ডারবানে সূর্য ডোবার আগেই তাদের ড্রেসিং রুমে নেমে এলো আঁধার।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ৩৬৭

বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ২৯৮

দক্ষিণ আফ্রিকা ২য় ইনিংস: ৭৪ ওভারে ২০৪ (আগের দিন ৬/০) (এরউইয়া ৮, এলগার ৬৭, পিটারসেন ৩৬, বাভুমা ৪, রিকেলটন ৩৯*, ভেরেইনা ৬, মুল্ডার ১১, মহারাজ ৫, হার্মার ১১, উইলিয়ামস ০, অলিভিয়ের ০; খালেদ ১৩-১-৩৩-০, মিরাজ ৩৫-৬-৮৫-৩, শান্ত ১-০-৩-০, ইবাদত ১৩-১-৪০-৩, মুমিনুল ১-১-০-০, তাসকিন ১১-১-২৪-২)।

বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: ৬ ওভারে ১১/৩ (জয় ৪, সাদমান ০, শান্ত ৫*, মুমিনুল ২, মুশফিক ০*; মহারাজ ৩-০-৭-২, হার্মার ৩-১-৪-১)।