মাউন্ট মঙ্গানুই থেকে ডারবান: জয়ের আনন্দ-দেয়াল

একটি ক্রিকেট ব্যাটের প্রস্থ কত? ক্রিকেট বই বলছে, সর্বোচ্চ ৪.২৫ ইঞ্চি। মাহমুদুল হাসান জয়ের ক্ষেত্রে উত্তরটি যেন একটু ভিন্ন। জয়ের ব্যাট যে তার কলিজার সমান চওড়া! বয়স মোটে ২১ পেরিয়েছে। অভিজ্ঞতা বলতে তেমন কিছু নেই। কিন্তু আছে বিশাল হৃদয়। বছরের শুরুতে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় অসাধারণ ইনিংসের পর এবার ডারবানে ইতিহাস গড়া সেঞ্চুরি। জয়ের ব্যাট যেন বাংলাদেশের দেয়াল!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 April 2022, 02:20 PM
Updated : 2 April 2022, 02:42 PM

‘দেয়াল’ শব্দটি বললে ক্রিকেটে একজনের চেহারাই চোখে ভাসে সবার। ভারতের হয়ে বছরের পর বছর যিনি ছিলেন আস্থা ও ভরসার প্রতিমূর্তি, যার চওড়া ব্যাটের প্রতিরোধে মুখ থুবড়ে পড়ত প্রতিপক্ষের সব আক্রমণ, সেই কিংবদন্তি রাহুল দ্রাবিড়কে বলা হতো ‘দা ওয়াল।’

দ্রাবিড়ের সিকি ভাগ হয়ে উঠতেও এখনও যোজন যোজন দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে জয়কে। তবে মাউন্ট মঙ্গানুই আর ডারবানে জয়ের ইনিংস দুটি যেন দ্রাবিড়ের ঘরানার ব্যাটসম্যানদের প্রতি অঞ্জলি।

নিউ জিল্যান্ড সফরে গত জানুয়ারিতে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে প্রায় ৫ ঘণ্টা উইকেটে কাটিয়ে ২২৮ বল খেলে জয় করেছিলেন ৭৮। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিল লড়িয়ে সেই ইনিংসটি। আঙুলের চোটে ওই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে আর ব্যাটিং করা হয়নি তার। খেলতে পারেননি পরের টেস্টেও। ফিরলেন এই ডারবান টেস্ট দিয়ে। এবার ছাড়িয়ে গেলেন নিজেকে। ছাড়িয়ে গেলেন বাংলাদেশের সবাইকে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরি। দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে সেঞ্চুরি। কোনোটিই বাংলাদেশের কারও ছিল না এতদিন। জয় ঘুচিয়ে দিলেন সেই খরা।

উপমহাদেশের কত গ্রেট, কত অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে উইকেট আর কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে! জয়ের এটি মাত্র তৃতীয় টেস্ট। জাতীয় দলের হয়ে প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা সফর। জয় জানিয়ে দিলেন, তিনি জিততেই এসেছেন।

এই দক্ষিণ আফ্রিকাতেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের রূপকথাময় সাফল্যের পথে জয়ের দারুণ একটি ইনিংস আছে। ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে করেছিলেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। এবার জাতীয় দলের হয়ে শ্বেতশুভ্র পোশাকে এমন এক সেঞ্চুরি করলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে যা স্থায়ী জায়গা পেয়ে গেল।

৬ ঘণ্টার বেশি উইকেটে কাটিয়ে ২৬৯ বলে সেঞ্চুরি। সংযম, ধৈর্য, উইকেট আঁকড়ে রাখা আর নিবেদনের আশ্চর্য গল্প যেন।

নিউ জিল্যান্ডে তার ৭৮ আর এবারের সেঞ্চুরি, দুটি ইনিংসের জিনগত বৈশিষ্ট্য একই। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, হার না মানা মানসিকতা, ফাঁদে পা না দেওয়ার সংযম, টেস্টের আদর্শ টেম্পারমেন্ট ও ধৈর্য, লড়াইয়ের তীব্র তাড়না এবং প্রশ্নাতীত নিবেদন। গোছানো পথে ইনিংস গড়ার শৃঙ্খলা। দুরন্ত তারুণ্যের চঞ্চলতাকে চাপা দেওয়ার আশ্চর্য পরিমিতি বোধ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সামান্য অভিজ্ঞতার পরও অসম্ভব পরিণত মানসিকতা।

তার ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্কের প্রমাণও দিয়ে ফেলেছেন এর মধ্যে। আগের দিন বাংলাদেশকে ভোগানো সাইমন হার্মার তৃতীয় দিনে আক্রমণে আসার পরপরই দারুণ শটে চার ও ছক্কা মেরে চাপে ফেলে দিলেন শুরুতেই। সেঞ্চুরির পর হার্মারকেই স্লগ সুইপে এমন এক ছক্কা মারলেন, ধারাভাষ্যকক্ষে মার্ক নিকোলাসের মুগ্ধ উচ্চারণ, “সে শুধু ভালো ক্রিকেটারই নন, তার ক্রিকেট মস্তিষ্কও দারুণ।”

আর হ্যাঁ, স্কিল তো আছেই। তার টেকনিকের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো, এখানে জটিল কিছু নেই। সিম্পল ও সলিড। কেতাবি স্টান্স ও ব্যাক লিফট, শেষ পর্যন্ত বলের দিকে চোখ রাখা, যতটা সম্ভব দেরিতে শট খেলা, প্রয়োজনের সময় সফট হ্যান্ডে খেলা, প্রয়োজনে একটু হার্ড, কেবল নিজের জোনে বল পেলেই শট খেলা, ড্রাইভে ব্যাটের মুখ উন্মুক্ত রাখা, বলের পর বল ছেড়ে দেওয়া, প্রয়োজনে শরীরে বলের আঘাত সয়ে টিকে থাকা, স্পিনারদের বলে টার্নের বিরুদ্ধে ব্যাট না চালানো, সব মিলিয়ে জয় যেন আদর্শ টেস্ট ব্যাটসম্যানের প্রতিচ্ছবি।

মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের ইনিংসটিতে তবু শুরুতে একটু নড়বড়ে ছিলেন। আত্মবিশ্বাসের খানিকটা ঘাটতি ছিল। নার্ভাস কিছু মুহূর্তও এসেছিল। অল্পের জন্য আউট হতে হতে বেঁচে গেছেন কয়েক দফায়। কিন্তু এবার ডারবানে শুরু থেকেই সাবলিল। আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর যেন। ৬৪ রানে সাইমন হার্মারের বলে শর্ট লেগে একটা হাফ-চান্সের মতো দেওয়া ছাড়া সেভাবে আর সুযোগই দেননি।

বাংলাদেশের জন্য যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আরেকপ্রান্তে একের পর এক ব্যাটসম্যানের বিদায়েও জয় ভেঙে পড়েননি। হাল ছাড়েননি। লড়াইয়ে ক্ষান্তি দেননি। এমনকি ভুল বোঝাবুঝিতে ইয়াসির আলি চৌধুরি রান আউট হয়ে যাওয়ার পরও জয়ের মনোযোগে চিড় ধরেনি।

মেহেদী হাসান মিরাজ আউট হয়ে যাওয়ার পর যখন দেখলেন স্বীকৃত ব্যাটসম্যান আর নেই, তখন জয় মেলে ধরলেন নিজের ব্যাটিংয়ের আরেকটি ছবি। চোখধাঁধানো সব শট খেললেন উইকেটের চারপাশে। হার্মারের ওভারে চার-ছক্কা, ভিয়ান মুল্ডারের ওভারে চারটি চার, শটের পসরা মেলে ধরলেন যেন।

ওই শটগুলো তার ইনিংসটিকেই যেন আরও স্পেশাল করে তুলল। এত সব শট তার হাতে আছে, এত শট তিনি খেলতে পারেন, তারপরও নিজের ওপর কত নিয়ন্ত্রণ!

তার বয়স আর অভিজ্ঞতা বিবেচনায় সবকিছুই খুব অবিশ্বাস্য। কিন্তু উইকেটে তার উপস্থিতি আর বিচরণ এমনই নির্ভরতা ছড়ায়, সবকিছুই মনে হয় খুব স্বাভাবিক!

সেঞ্চুরির পর সেখানেই না থেমে জয় এগিয়ে যান আরও। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এশিয়ার বাইরে এক ইনিংসে ৩০০ বল খেলা প্রথম ব্যাটসম্যানও হয়ে যান তিনি। সেই ২০০৪ সালে সেন্ট লুসিয়ায় খালেদ মাসুদের ২৮১ বলের ইনিংস পড়ে যায় পেছনে।

এভাবেই ছুটছে জয়ের জয়রথ। জয়ের অপেক্ষায় আরও অনেক জয়োল্লাস।

শেষ পর্যন্ত তার ইনিংস থামে ১৫ চার ও ২ ছয়ে ৩২৬ বলে ১৩৭ রান করে। আউট হন শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে, সেটিও সতীর্থদের হারিয়ে দলের রান দ্রুত বাড়ানোর চেষ্টায়। জয় তাই আউট হলেও আসলে হারেননি।

মাত্রই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরু। আরও অনেক কঠিন পরীক্ষা আসবে সামনে। প্রতিপক্ষ তার শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে, গবেষণা করবে, খুঁত বের করবে। বিভিন্ন কন্ডিশন, নানা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ আসবে। প্রত্যাশার চাপ চেপে বসবে। সামনে তাই নিশ্চিতভাবেই সময় হবে কঠিন।

তবে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় আর তৃতীয় টেস্টে নিউ জিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশনে এমন খেলতে পারেন যিনি, তার ওপর চ্যালেঞ্জ জয়ের ভরসা রাখাই যায়।

আপাতত সময়টা মুগ্ধতার। ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস যেমন বললেন, “উদ্ভাসিত এক তরুণের সাফল্য উদযাপন করতে পারে বাংলাদেশ।”