অনেক ঘাম ঝরিয়ে তাসকিনের আনন্দাশ্রু

২০১৯ সালের ৭ জুন। বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পাওয়া তাসকিন আহমেদ মিরপুর একাডেমি ভবনের সামনে মুখোমুখি হন সংবাদমাধ্যমের। কথা বলতে পারেন সামান্যই। কান্নার দমকে থমকে যান বারবার। সেই তাসকিনের চোখে আবার দেখা গেল জল। এবার মাঠের ভেতরেই। ৫ উইকেট নেওয়ার পর সিজদা দিলেন মাঠে। যখন উঠলেন, চোখের কোণে তখন চিকচিক করছে অশ্রু!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2022, 05:32 AM
Updated : 24 March 2022, 07:47 AM

সেবার হতাশা, আক্ষেপ আর অসহায়ত্বগুলোই ঝরেছিল অশ্রু হয়ে। এবার তার চোখের জলে মিশে আছে গৌরব, আছে আনন্দ। কত পথ পেরিয়ে, কত ঘাম ঝরিয়ে, কত বাধা মাড়িয়ে তবে এলো এই দিনটি!

তাসকিন এ দিন ম্যাচের নায়ক। তাসকিন এবার সিরিজের নায়ক। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ের মূল কারিগর। যে দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটও। দীর্ঘশ্বাসের অনেক প্রহর পেরিয়েই তবে এলো এমন ঝলমলে হাসির দিন।

ম্যাচের পর ম্যাচে ব্যাটসম্যানদের হাতে বেদম মার খাওয়া, গতির নেশায় বলের ধার হারিয়ে ফেলা, মাঠের বাইরে শৃঙ্খলা ভুলে মাঠেও নিজেকে বিশৃঙ্খল করে তোলা, সবকিছু মিলিয়ে তাসকিন হয়ে উঠেছিলেন দেশের ক্রিকেটের হাহাকার। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে গতির ঝড় তোলা, ১৫০ কিলোমিটার গতিতে বল করার আশায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা, আবির্ভাবেই ৫ উইকেটে নেওয়ার কীর্তি গড়া অপার সম্ভাবনাময় ফাস্ট বোলার সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে ছিটকে যান অনেক দূরে।

‘আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচানোর’ মতোই তাকে জাগিয়ে তোলার প্রবল ধাক্কা ছিল বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পাওয়া। নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার অভিযানে নামেন তিনি। জিমে চলতে থাকে কসরত। তীব্র রোদ আর উত্তপ্ত সময়ের সঙ্গেই করে নেন মিতালি। তার ঘামে সিক্ত হয় বালুচর। পিছু না ছাড়া চোট-আঘাত থেকে মুক্তি পেতে আর শরীরকে পোক্ত করতে নিজেকে প্রস্তুত করেন কঠিন ফিটনেস ট্রেনিংয়ে।মনোবিদের কাছে নিতে থাকেন মাইন্ড ট্রেনিং আর কোচিং স্টাফদের সঙ্গে স্কিল ঝালাই।

এসবই বাংলাদেশের ক্রিকেটে গত এক বছরে চর্চিত হয়েছে অনেক। চর্চার সুযোগ করে দিয়েছে তাসকিনের পারফরম্যান্সই। দীর্ঘদিন সুযোগ না পেয়ে অবশেষে গত জানুয়ারিতে দলে ফেরার পর থেকে তিন সংস্করণ মিলিয়ে দলের সেরা পেসার তিনিই। ভিন্ন এক তাসকিনের দেখা মিলছে এই দফায়, অনেকের চোখে যেটি তার দ্বিতীয় সংস্করণ, অনেকের মতে তার পুনজর্ন্ম।

এই তাসকিন চোটের কাছে নত হন না, ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েন না। টেস্টে ইনিংস প্রতি ২৫-৩০ ওভার বোলিং করতে পারেন নিয়মিত। এই তাসকিন আর এলোমেলো নন। আগের মতোই আগ্রাসী, কিন্তু আগের চেয়ে অনেক গোছানো। এই তাসকিনের বোলিংয়ে স্কিলের সঙ্গে মাথাও চলে সমানে। এই তাসকিন অধিনায়কের দুর্ভাবনা নয়, বরং ভরসা।

যদিও তার বলে ক্যাচ পড়েছে সমানে। ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করেও উইকেট পাননি অনেকবার। বল অল্পের জন্য ব্যাটের কানা স্পর্শ করেনি বারবার। তিনি হতাশ হয়েছেন, তবে মুষড়ে পড়েনি। নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সাফল্য এসেছে। সাদা পোশাকে পাল্লেকেলেতে দুর্দান্ত বোলিং। জিম্বাবুয়েতে জয়ে অবদান রাখা ব্যাটিং-বোলিং। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে ঐতিহাসিক জয়ে ভূমিকা রাখা। রঙিন পোশাকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুরে ৪ উইকেট। আফগানদের বিপক্ষে ভালো বোলিং। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের হতাশার আসরেও নিজের ছাপ রাখা। সবই চলছিল। তবু ছিল একটি ঘাটতি। বুকে পুষে রাখা আশা। জয়ের নায়ক হওয়ার যে এখনও বাকি!

তাসকিনের এমন উল্লাসের ছবিই এখন নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। ছবি: বিসিবি।

পার্শ্বনায়ক বা টুকটাক অবদান নয়, মূল নায়ক হওয়া।

সেই প্রত্যাশাকে অবশেষে প্রাপ্তির বিন্দুতে মেলালেন তাসকিন। প্রথম ম্যাচের জয়ে যদিও আবারও ছিলেন আড়ালের নায়ক। সেদিন ম্যাচের সেরা সাকিব আল হাসান। অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে আলো কেড়ে নেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে তাসকিনই গড়ে দিলেন পার্থক্য। রচনা করে দিলেন জয়ের ভিত। উপহার দিলেন রেকর্ড গড়া বোলিং। দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জিতে দল লিখল নতুন ইতিহাস।

৩৫ রানে ৫ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং বিধ্বস্ত করে ম্যান অব দা ম্যাচের ট্রফি উঠল তাসকিনের হাতে। প্রায় ৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৯১ ম্যাচ খেলে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাচের নায়ক। প্রথম ম্যান অব দা ম্যাচ!

শেষের ৫ উইকেটের সঙ্গে প্রথম ম্যাচের ৩ উইকেট মিলিয়ে যোগ হলো আরও একটি প্রাপ্তি। ক্যারিয়ারে প্রথমবার ম্যান অব দা সিরিজ!

সফরে যাওয়ার আগে মিরপুরে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তাসকিন বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় এবার দলকে জেতাতে চান তিনি। যে দেশে বাংলাদেশ আগে কখনও টেস্ট-ওয়ানডে জেতেনি, সেখানে দলের জয় ও নিজের নায়ক হওয়ার আশাবাদ শোনানো বড় সাহসিকতাই বটে। সেই সাহসের উৎস ছিল নিজের সামর্থ্যে আস্থা। সেই বিশ্বাস যে ঠুনকো ছিল না, প্রমাণ করলেন তিনি মাঠেই।

ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে তাসকিনের কণ্ঠেও ফুটে উঠল তৃপ্তির সুর।

“দক্ষিণ আফ্রিকায় আসার আগে কোনো একজন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, সবশেষ যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলি, বাজে পারফরম্যান্স করে আমি চার বছরের জন্য বাইরে গিয়েছিলাম। এবার কি হবে? আমি তখন বলেছিলাম, দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যাচ জেতাতে চাই এবং আল্লাহর কাছেও মন থেকে চেয়েছিলাম, প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছি। শুকরিয়া যে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন।”

“সিরিজ জিতেছি এবং জয়ের পেছনে আমার অবদান ছিল, এটা বড় পাওয়া। গত এক-দেড় বছর ধরে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করছি কীভাবে নিজের উন্নতি করা যায় এবং এই ম্যাচেও একই প্রক্রিয়া ও মাইন্ডসেট নিয়ে নেমেছি। আমি এভাবে করেই এগোচ্ছি। আমাদের দলের প্রতিটি কোচিং স্টাফ সাপোর্ট করছে। প্রতিটি টিমমেট অনেক সাপোর্ট করছে। সবাইকে ধন্যবাদ।”

তাসকিনের এমন সাফল্যে অধিনায়ক তামিম ইকবালও দারুণ উচ্ছ্বসিত।

“আমি খুবই গর্বিত, বিশেষ করে বাংলাদেশের একজন ফাস্ট বোলার ৫ উইকেট নিয়েছে এবং আমাদেরকে সিরিজ জিতিয়েছে, প্লেয়ার অব দা সিরিজ পুরস্কার জিতেছে, এটা আমার জন্য গর্বের। তাসকিন কঠোর পরিশ্রম করেছে এবং মানসিকতার যে বদল এনেছে, সেটির ফল পাচ্ছে।”

ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ম্যান অব দা ম্যাচ ও সিরিজের ট্রফি যখন নিচ্ছেন তাসকিন, তার মুখে তখন চওড়া হাসি। হেসে হেসেই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে গেলেন। কথা শেষেও মুখে ফুটে রইল হাসি। মাঠময় বিচরণেও ঝলমল করল তার হাসিমুখ।

অনেক নীরব কান্না থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি মিলেছে। বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটাই এখন সাফল্যের ফুল হয়ে ফুটছে। তাসকিনের হাসি থামবে কেন!