দ. আফ্রিকাকে গুঁড়িয়ে অবিস্মরণীয় সিরিজ জয়

এবারের আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় কখনও ওয়ানডে জেতেনি বাংলাদেশ। এবার হয়ে গেল প্রথম ম্যাচেই। এই সফরের আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫ উইকেট ছিল না বাংলাদেশের কোনো বোলারের, তাদের মাঠে শতরানের উদ্বোধনী জুটি ছিল না একটিও। এবার শেষ ওয়ানডেতে কেটে গেল সেই খরাও। শুরু আর শেষ ম্যাচের প্রাপ্তির সম্মিলনে দল পৌঁছে গেল এমন ঠিকানায়, কদিন আগেও যা ছিল অচেনা এক জগৎ। দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জয়!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2022, 02:28 PM
Updated : 23 March 2022, 05:29 PM

যে সিরিজে একটি জয়ও হতে পারত বড় প্রাপ্তি, সেটিতেই অভাবনীয় সাফল্য উপহার দিল বাংলাদেশ। শেষ ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৯ উইকেটে উড়িয়ে দেখা পেল স্বপ্নের সিরিজ জয়ের।

সেঞ্চুরিয়নের ২২ গজে তাসকিন আহমেদের আগুন ঝরা বোলিংয়ে পুড়ে খাক হলো দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং। প্রতিপক্ষের সেই ধ্বংসস্তুপেই যেন ব্যাট হাতে আনন্দ নৃত্যে মেতে উঠলেন তামিম ইকবাল। চোখধাঁধানো সব স্ট্রোকে রচনা করলেন জয়ের সৌধ।

ছবি: আইসিসি

সেই অভিষেক ওয়ানডেতে ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন তাসকিন। প্রায় ৮ বছর পর আবার পেলেন ভুলে যাওয়া সেই স্বাদ। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা দক্ষিণ আফ্রিকা দারুণ শুরুর পরও শেষ ১৫৪ রানে।

রান তাড়ায় বাংলাদেশ ছুটে গেল দারুণ গতিতে। দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রোটিয়া বোলারদের শাসন করলেন তামিম ইকবাল, আরেক প্রান্ত থেকে লিটন দাস তা উপভোগ করলেন সঙ্গ দিয়ে। গড়ে উঠল শতরানের জুটি। লিটনের বিদায়ে ১০ উইকেটের জয় শেষ পর্যন্ত হলো না, তবে জয় ধরা দিল ১৪১ বল বাকি রেখেই।

বল বাকি রেখে জয়ের হিসেবে দেশের বাইরে এটিও বাংলাদেশের রেকর্ড।

এই সফরের আগে দেশের বাইরে বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজ জয় ছিল স্রেফ জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে। এবার যোগ হলো দক্ষিণ আফ্রিকা, উপমহাদেশের দলগুলির জন্য যেখানে খেলা মনে করা হয় সবচেয়ে কঠিন। দুই মাস আগেই যেখানে হোয়াইটওয়াশড হয়ে এসেছে ভারতের মতো দল।

তাসকিনের দুর্দান্ত বোলিংয়ের পাশাপাশি আলাদা করে এ দিন বলতে হবে তামিমের নেতৃত্বের কথাও। মাঠে তার বোলিং পরিবর্তনগুলো কাজে লেগে যায় দারুণভাবে। ব্যাট হাতে তো নেতৃত্ব দেন সামনে থেকেই।

অথচ ম্যাচ শুরুর চিত্র বাংলাদেশের জন্য ছিল ভিন্ন। টস হেরে মন একটু ভার ছিল তামিমের। এই মাঠেই প্রথম ম্যাচে আগে ব্যাট করে তিনশ ছাড়ায় দল, এই ম্যাচেও তার চাওয়া ছিল আগে ব্যাটিং। কিন্তু এবার টস ভাগ্যকে পাশে পাননি।

এরপর বোলিংয়ের শুরুটাও ভালো করতে পারেননি মুস্তাফিজুর রহমান ও শরিফুল ইসলাম। তা কাজে লাগিয়ে দ্রুত রান তোলেন ইয়ানেমান মালান। পঞ্চম ওভারেই তাই মেহেদী হাসান মিরাজের স্পিন আক্রমণে আনেন তামিম।

৬ ওভারে ৪০ রান তুলে ফেলা দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ধাক্কা খায় সপ্তম ওভারে। মিরাজের স্পিনেই আসে প্রথম সাফল্য। তাকে একটি বাউন্ডারি মারার পরের বলেই ছক্কায় ওড়ানোর চেষ্টায় লং অফে ধরা পড়েন কুইন্টন ডি কক (১২)।

কে জানত, ৪৬ রানের উদ্বোধনী সেই জুটিই হয়ে থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকার সেরা জুটি! পরের ৪০ রান যোগ না হতেই তারা উইকেট হারায় আরও ৪টি।

দ্বিতীয় উইকেটে মালান ও কাইল ভেরেইনা জুটি গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। এই জুটি থামিয়েই দৃশ্যপটে আবির্ভাব তাসকিনের। দায় যদিও ব্যাটসম্যানেরই বেশি। বাইরের বল কাট করার চেষ্টায় স্টাম্পে টেনে আনেন ভেরেইনা।

এরপর উইকেট ধরা দিতে থাকে একের পর এক। থিতু হয়ে যাওয়া মালানকে (৫৬ বলে ৩৯) বাড়তি বাউন্সে ফেরান তাসকিন। পরের ওভারে সাকিব আল হাসানকে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ টেম্বা বাভুমা। শরিফুল ইসলাম নতুন স্পেলে ফিরে প্রথম ডেলিভারিতেই বাড়তি বাউন্সে বিদায় করে দেন দক্ষিণ আফ্রিকার বড় ভরসা রাসি ফন ডার ডাসেনকে।

বিনা উইকেটে ৪৬ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার রান তখন ৫ উইকেটে ৮৩।

ডেভিড মিলার আর ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস চেষ্টা করেন ধ্বংসস্তুপ থেকে দলকে উদ্ধারের। কিন্তু আবারও তামিমের দারুণ বোলিং পরিবর্তন। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরেই তাসকিনের আরেকটি উইকেট। তার শিকার এবার প্রিটোরিয়াস।

শেষ বাধা হয়ে থাকা মিলারকেও (৩১ বলে ১৬) একটু পর থামান তাসকিন। ওই ওভারেই রাবাদাকে ফিরিয়ে পূর্ণ করেন ৫ উইকেট।

দেশের বাইরে বাংলাদেশের মাত্র চতুর্থ পেসার হিসেবে তিনি পেলেন ৫ উইকেট।

দেশে মা ও সন্তানদের হাসপাতালে রেখে এই ম্যাচ খেললেন যিনি, সেই সাকিব আল হাসানও দারুণ বোলিংয়ে নেন দুই উইকেট।

শেষ দিকে কেশভ মহারাজের (২৮) লড়াইয়ে দেড়শ পার হতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা। রান আউটে তার বিদায়েই শেষ হয় প্রোটিয়া ইনিংস।

ছোট রানের ম্যাচে নাটকীয়তার উদাহরণ ক্রিকেটে কম নেই। আগের ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিং ধসের স্মৃতিও টাটকা। তবে ইতিহাস গড়ার হাতছানির ম্যাচে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান তামিম। শঙ্কাগুলো দূর হয়ে যায় দ্রুতই।

একটু দেখেশুনে শুরুর পর তামিমের ব্যাট হয়ে ওঠে উত্তাল। লুঙ্গি এনগিডিকে টানা দুটি চারের পর প্রতিপক্ষের সেরা বোলার কাগিসো রাবাদার এক ওভারে মারেন দাপুটে চারটি বাউন্ডারি!

তামিমকে বিধ্বংসী চেহারায় দেখে নিজের করণীয় বুঝে যান লিটন। শুরুতে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যাওয়ার পর তিনি স্রেফ সঙ্গ দিয়ে যান অধিনায়ককে। এই দুজনের ব্যাটে ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা।

নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথমবার ১০ উইকেটে জয়ের সম্ভাবনাও জেগে ওঠে একটা সময়। কিন্তু ৫৭ বলে ৪৮ রান করে লিটনের বিদায়ে জুটি থামে ১২৭ রানে।

ওই এক উইকেট যেন ছিল ‘চাঁদের কলঙ্ক।’ জয়ের সৌন্দর্য বা মহিমা, কমেনি তাতে কিছুই। তামিম আর সাকিব দলকে নিয়ে যান ইতিহাসের ঠিকানায়। ৮২ বলে ৮৭ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন তামিম, ১৮ রানে অপরাজিত সাকিব।

ম্যাচ শেষে সেঞ্চুরিয়নে যখন সূর্য অস্ত যাওয়ার ছবি ফুটে উঠল টিভি পর্দায়, বাংলাদেশ ক্রিকেটে তখন নতুন সূর্যোদয়।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

দক্ষিণ আফ্রিকা: ৩৭ ওভারে ১৫৪ (মালান ৩৯, ডি কক ১২, ভেরেইনা ৯, বাভুমা ২, ফন ডার ডাসেন ৪, মিলার ১৬, প্রিটোরিয়াস ২০, মহারাজ ২৮, রাবাদা ৪, এনগিডি ০, শামসি ৩*; শরিফুল ৭-০-৩৭-১, মুস্তাফিজ ৭-০-২৩-০, মিরাজ ৫-০-২৭-১, তাসকিন ৯-০-৩৫-৫, সাকিব ৯-০-২৪-২)

বাংলাদেশ: ২৬.৩ ওভারে ১৫৬/১ (তামিম ৮৭*, লিটন ৪৮, সাকিব ১৮*; রাবাদা ৫.৩-০-৩৭-০, এনগিডি ৫-০-২৪-০, মহারাজ ৭-০-৩৬-১, শামসি ৭-০-৪১-০, প্রিটোরিয়াস ২-০-১৮-০)

ফল: বাংলাদেশ ৯ উইকেটে জয়ী

সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-১ ব্যবধানে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: তাসকিন আহমেদ

ম্যান অব দা সিরিজ: তাসকিন আহমেদ