যাযাবর জীবনেই যিনি খুঁজে নিয়েছেন ক্রিকেটানন্দ

বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে নানা ধাপ পেরিয়ে জাতীয় দলে পদার্পণ, অভিষেক ওয়ানডেতেই সেঞ্চুরি। স্বপ্নাতুর চোখে কলিন ইনগ্রাম তখন তাকিয়ে সফল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের পথে। কিন্তু ছোট্ট ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৩টি সেঞ্চুরির পরও পারলেন না থিতু হতে। হতাশা-অনিশ্চয়তার নানা প্রহর পেরিয়ে এক পর্যায়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমালেন কলপ্যাক চুক্তি করে। জীবনও বদলে গেল পুরোপুরি। স্বপ্ন-লক্ষ্য-বাস্তবতা তখন ভিন্ন, সেই দাবি মিটিয়ে নিজের খেলা ভেঙে গড়লেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে দূরে ঠেলে দিলেও ক্রমে তিনি হয়ে উঠলেন বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ব্যস্ত একজন। এবার ৩৬ বছর বয়সে প্রথম তার পা পড়ল বিপিএলে। সিলেট সানরাইজার্সে খেলতে আসা এই দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শোনালেন তার ক্রিকেট জীবনের নানা বাঁকের গল্প।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2022, 06:15 AM
Updated : 30 Jan 2022, 10:13 AM

দুনিয়া জুড়ে ক্রিকেট খেলে বেড়ান, বিপিএলে আসতে এতো দেরি হলো যে?

কলিন ইনগ্রাম: মূলত সূচি সংক্রান্ত জটিলতায়ই হয়ে ওঠেনি। এখানে যখন লিগ হয়েছে, তখন হয়তো অন্য কোনো জায়গায় ব্যস্ত হয়ে গেছি। এটা কিংবা ওটা বেছে নিতে হতো। বেশির ভাগ সময় আসলে আগেই অনেক কিছু চূড়ান্ত হয়ে গেছে।

এবার আসতে পেরে খুবই রোমাঞ্চিত আমি। অনেক জায়গায়ই খেলেছি টি-টোয়েন্টি লিগে, এখানে খেলা হয়নি। এবার সুযোগ হতেই বলা যায় লুফে নিয়েছি।

ক্রিকেটার হিসেবে আমার গড়ে ওঠার সময়ের স্মরণীয় স্মৃতিগুলোর একটি এই বাংলাদেশে, যখন দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলের হয়ে এসেছিলাম ২০১০ সালে। আমার সঙ্গে রাইলি রুশো, ডিন এলগার, ভার্নন ফিল্যান্ডার, আলভিরো পিটারসন, পল হ্যারিসরা ছিল। আমাদের মতো তরুণদের জন্য বড় শিক্ষা সফর ছিল সেটি। কী দুর্দান্ত অভিজ্ঞতাই না ছিল!

২০১১ বিশ্বকাপেও তো এসেছিলেন জাতীয় দলের হয়ে?

ইনগ্রাম:
হ্যাঁ, সেবার অবশ্য খুব ভালো অভিজ্ঞতা ছিল না। বেঞ্চে ছিলাম। অসহনীয় ওই ম্যাচটিতে খেলার সুযোগ হয়নি। নিউ জিল্যান্ডের কাছে বাজেভাবে হেরে গিয়েছিলাম আমরা (কোয়ার্টার-ফাইনালে)।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বা অন্যান্য বেশির ভাগ জায়গায় যেখানে খেলেছেন, এখানকার উইকেট একটু ভিন্ন। মিরপুরের মতো উইকেটে হয়তো জীবনে খেলেছেন কমই। বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছিল আসার আগে?

ইনগ্রাম: অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছি, যারা এখানে খেলেছে। উইকেট ধীরগতির, বল ব্যাটে আসবে না, বাউন্স নিচু, এরকমই বলেছে সবাই। চট্টগ্রামে ভালো উইকেট পাব, এরকমও বলেছে অনেকে। ওদের কাছ থেকে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেছি এবং গেম প্ল্যান ভাবার চেষ্টা করেছি। এখানে আসার পর চেষ্টা করেছি সবার কাছ থেকে জানতে। টুর্নামেন্ট নিয়ে এমনিতে নানা জনের কাছ থেকে ভালো ভালো কথাই শুনেছি।

আপনার দেশেরই গ্রেট ও এবার খুলনা টাইগার্সের কোচ ল্যান্স ক্লুজনার টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বলছিলেন, সফরকারী ক্রিকেটারদের জন্য গোটাবিশ্বেই বাংলাদেশ সবচেয়ে কঠিন জায়গা!

ইনগ্রাম: হতে পারে। আমার গত কয়েক বছরে নানারকম কন্ডিশনে, বিভিন্ন উইকেটে খেলার সৌভাগ্য হয়েছে। যেমন সিপিএলে ক্যারিবিয়ানের কিছু উইকেটও খুব কঠিন। খুবই ধীরগতির উইকেট, বল হাঁটুর ওপরে ওঠে না। কিছু অভিজ্ঞতা তাই আছে। এছাড়াও আমি বেড়ে উঠেছি পোর্ট এলিজাবেথে, যেখানে উইকেট দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে মন্থর, নিচু বাউন্সের। টার্নও করে অনেক সময়। সব মিলিয়ে, কিছু অভিজ্ঞতা তাই আছে।

অবশ্যই, তার পরও চ্যালেঞ্জিং তো বটেই।

যেটা বললেন, দুনিয়াজুড়ে নানা কন্ডিশনে খেলছেন আপনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে গিয়ে আপনি হয়ে উঠেছেন ক্রিকেটের যাযাবর। কেমন লাগে এই জীবন?

ইনগ্রাম: সত্যি বলতে, আমার কাছে এটা স্বপ্নের জীবন! আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার আমার দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। জাতীয় দলের হয়ে নানা দেশে যাওয়া ও ওই পর্যায়ে টানা খেলার সুযোগ হয়নি। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আমাদের সেই সুযোগটা করে দেয়। বিশ্বজুড়ে খেলা, অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া, নতুন নতুন বন্ধু বানানো, বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মেশা, এসব অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

আপনি আমাকে যাযাবর বলেছেন, আমার খুব ভালো লাগল। কারণ, নিজেও আমি এরকমই মনে করি। বেশির ভাগ সময় ছুটোছুটিই করতে হয় আমাকে, একটির পর একটি চলতেই থাকে। বেড়ে ওঠার সময় আমি এরকমই চেয়েছি, নানা দেশে ক্রিকেট খেলে বেড়াব। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে, আমি দুহাতে আলিঙ্গন করেছি। এর চেয়ে ভালো কিছু জীবনে আর চাইতে পারতাম না হয়তো।

ইতিবাচক অনেক দিক আপনি বললেন, চ্যালেঞ্জিং আর প্রতিকূল অনেক কিছুও তো থাকার কথা!

ইনগ্রাম: উমমম… জানি না… আছে অবশ্যই, সব পেশায়ই থাকে। তবে আমি ওসব ভাবতে চাই না, ওই দিকগুলোয় তাকাতে চাই না। আমার ধরনই হলো, সবসময় ইতিবাচক ভাবি ও থাকার চেষ্টা করি।

তিন-চার বছর আগে একটা সময় ছিল, আমার মনে হয় বছরের প্রতিদিনই ক্রিকেট খেলছিলাম। সেটাও অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। শরীর আর মনের ওপর ধকল গেছে। কোভিড মহামারীর সময়টায় যখন খেলা বন্ধ হয়ে গেল, তখন আবার অনুভব করেছি, এই খেলাটা কত তীব্রভাবে খেলতে চাই। ওই বিরতিতে খেলার প্রতি অনুরাগ আরও অনেক বেড়ে গেছে।

খুব বড় নাম না হলেও নানা টি-টোয়েন্টি লিগে আপনার বেশ চাহিদা। অথচ আপনি শুরুতে ছিলেন অনেকটা প্রথাগত ঘরানার ব্যাটসম্যান। এরপর টি-টোয়েন্টি বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন কিভাবে?

ইনগ্রাম: ভালো প্রশ্ন, কারণ আসলে এটিই হয়েছে। আমি যে সময়টায় বেড়ে উঠেছি, সেই যুগে সবাই টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখত। চার দিনের ম্যাচ খেলতাম আমরা, ওই সংস্করণে প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান ছিল অন্যরকম। তবে সময়ের সঙ্গে অনেকের বাস্তবতা বদলায়।

আমি শুরু থেকেই সীমিত ওভারের ক্রিকেট বেশি ভালো খেলতাম। যদিও তা ছিল মূল ৫০ ওভারের সংস্করণ। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কিছু সময় কাটিয়ে এবং সেখানে টিকতে না পেরে, আমি ভিন্ন বিকল্প নিয়ে ভাবছিলাম। ততদিনে টি-টোয়েন্টি লিগগুলো জেঁকে বসেছে। আমার মনে হলো, এই সংস্করণে চেষ্টা করে দেখি!

আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল মূলত, বিগ ব্যাশে নিয়মিত হওয়া। টিভিতে এই লিগ দেখে মনে হতো, এটা আমার জন্য আদর্শ। কারণ উইকেট ও কন্ডিশন অনেকটা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো, বাউন্স সমান, খেলার ধরন একরকম।

নিজেকে ভেঙে গড়তে সময় লেগেছে বছর দুয়েক। নিজের টি-টোয়েন্টি খেলা নিয়ে অনেক কাজ করেছি। শটের রেঞ্জ বাড়ানো, হিটিং পাওয়ার বাড়ানো, এই সংস্করণে মানিয়ে নিতে টেকনিকে কিছুটা বদল আনা, অনেক কিছুই করতে হয়েছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায়নি কিছু, অনেক চিন্তাভাবনা করে ও খাটুনির পরই এসব হয়েছে। সৌভাগ্যবশন, আমার ক্ষেত্রে এসব কাজে দিয়েছে অনেকটা। 

ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে ও এই বয়সে এসে, বড় দৈর্ঘের ক্রিকেট কিছুটা মিস করি বটে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলি না চার বছর ধরে প্রায় (চার বছর পর গত জুলাইয়ে স্রেফ একটি ম্যাচ খেলেছেন), ৫০ ওভার খেলি না সাড়ে ৩ বছর ধরে। তবে টি-টোয়েন্টি খেলেও জীবন বেশ চলে যাচ্ছে। উপভোগ করছি সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও তো অনেকটা আপনার মতো প্রথাগত ব্যাটসম্যান হিসেবে শুরু করে। তুমুল পেশিশক্তির ব্যাটসম্যান তারা নন। তারা কিভাবে আপনার মতো কার্যকর হতে পারে?

ইনগ্রাম: দেখুন, আমি কিছু নিজেকে আমূল বদলে ফেলিনি। প্রথাগত ঘরানার ব্যাটিংই আমার মৌলিকত্ব, এটা স্বাভাবিকভাবেই রয়ে গেছে। সঙ্গে হিটিং যোগ করেছি। দুটোকে আমি আলাদাভাবে দেখি, আলাদাভাবেই অনুশীলন করি এবং ম্যাচে সংযোগ ঘটাই। টেকনিক একটু এদিক-সেদিক করতে হয়েছে, ‘বেইজ’ শক্তিশালি করতে হয়েছে।

আর হ্যাঁ, গায়ের জোরও কিন্তু বাড়িয়েছি। হয়তো গেইল-পোলার্ড-রাসেলদের মতো পেশিবহুল ও বিশালদেহী মনে হয় না আমাকে, তবে গায়ের জোর কিন্তু কম নেই (হাতের পেশী দেখিয়ে)।

সবকিছুর সমন্বয় দরকার। এখানকার ক্রিকেটারদের জন্য বলতে পারি, সবসময় শুধু উড়িয়ে, তেঁড়েফুঁড়ে মারার ভাবনা রাখলে চলবে না। ওদের অনেকেরই হ্যান্ড-আই কো অর্ডিনেশন ভালো। দু-এক করে নিয়ে রান বাড়িয়ে ফাঁকে ফাঁকে শট খেলতে পারে। আমি অনেক জায়গায়ই তরুণ ব্যাটসম্যানদের বলি, ৩টি ছক্কা মেরেও খুব দ্রুত ৭০ রান করা যে পারে। অনেক পথ আছে, অনেক শট আছে। নিজের খেলায় সৃষ্টিশীলতা যোগ করতে হবে, উদ্ভাবনী হতে হবে। নিজের খেলাটা বুঝতে হবে এবং সেই ধরনের সঙ্গে মিল রেখে নতুন কিছু যোগ করতে হবে। সবার ক্ষেত্রে সবকিছু একইরকম কার্যকর হবে না।

আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা বেশ সম্ভাবনাময় ছিল। তার পর অন্য পথ বেছে নিলেন, কলপ্যাক চুক্তি করে ফেললেন, শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি ২৮ বছর বয়সেই, এখন পেছন ফিরে তাকালে কিভাবে দেখেন?

ইনগ্রাম: ফিরে তাকিয়ে… কোনো আক্ষেপ নেই আমার। আমি সবসময়ই চেয়েছি এমন এক ক্রিকেটার হতে, যে দলের জয়ে অবদান রাখবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, আমাকে ঘনঘন দলে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। থিতু হতে পারিনি বা সেই সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ৩১ ওয়ানডে ও ৯ টি-টোয়েন্টি খেলেছি আমি ৩ বছর ধরে। একটা জায়গায় থিতু হতেও পারিনি। অভিষেকে তিন নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি করেছি, পরের ম্যাচেই সাতে নামানো হয়েছে। পরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছি তিনে নেমে, এক ম্যাচ পরই আবার ছয়ে খেলেছি।

শেষদিকে ৩টি ওয়ানডেতে টানা শূন্য করেছি। কিন্তু ওপেনিংয়ে নেমে, যেটা আমার পছন্দের পজিশন ছিল না। এক থেকে সাত, সব পজিশনে মনে হয় খেলেছি আমি। খুব ভালো কিছু বোলিং আক্রমণের সামনেও পড়ে গেছি।

তবে, আমারও নিশ্চয়ই ঘাটতি কিছু ছিল। আর দক্ষিণ আফ্রিকা দলে ওই সময় জায়গা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও অনেক। দারুণ সব ব্যাটসম্যান ছিল। দলের জন্য ভালো তা, কিন্তু ক্রিকেটারদের জন্য বড় পরীক্ষা। আমার খেলাকেও সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে হতো। একটা সময় নিজেকে সেই লড়াইয়ের বাইরে দেখতে পেলাম। আমাকে বিকল্প ভাবতেই হতো।

পরে কাউন্টি ক্রিকেটে গেলাম, বিগ ব্যাশে সুযোগ পেলাম, নিজের খেলায় নতুন মাত্রা যোগ হলো। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেটা পারিনি, নানা চ্যালেঞ্জে জয়, সারা দুনিয়ায় ঘুরে খেলা, সবই হলো এই অধ্যায়ে।

আমার তাই কোনো আক্ষেপ নেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ে। ক্যারিয়ারে যা হওয়া সম্ভব ছিল, তার প্রায় পুরোটাই পেরেছি বলে মনে করি। ক্যারিয়ারের শুরুতে কেউ যদি বলত যে, ‘তুমি এতদিন ধরে খেলবে এবং এত দেশ ঘুড়ে এত ম্যাচ খেলবে’, আমি তা দুহাতে লুফে নিতাম। যে কাজটা করছি আমি, এখনও তা দারুণ উপভোগ করি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জীবনে এটিই।

ছোট্ট আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে স্মরণীয় স্মৃতি নিশ্চয়ই অভিষেক ওয়ানডের সেঞ্চুরি?

ইনগ্রাম: স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মুহূর্ত ছিল সেটি। এরকম কিছু কেবল লোকের স্বপ্নেই হয়ে থাকে! আমি জুনিয়র পর্যায় থেকেই সাদা বলের ক্রিকেট উপভোগ করতাম। বেড়ে ওঠার সময়ে প্রচুর ৫০ ওভারের ক্রিকেট খেলেছি। ওই সময়টায় মনে হয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়তো কখনোই খেলতে পারব না।

সেখান থেকে যখন দলে ঢুকলাম, গ্রায়েম স্মিথ, হাশিম আমলা, জেপি ডুমিনি, এবি ডি ভিলিয়ার্সরা তখন ব্যাটিং লাইন আপে। ওই দলে জায়গা পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। দলে এমন কয়েকজন ছিল, যারা আমার কাছে ছিল স্বপ্নের নায়কের মতো। তাদের সঙ্গে খেলতে পারা ও প্রথম ইনিংসেই সেঞ্চুরি করতে পারা ছিল অবিশ্বাস্য এক অনুভূতি।

এরপর চতুর্থ ইনিংসেই সেঞ্চুরি পাকিস্তানের বিপক্ষে। একটা সময় বাদ পড়া ও আবার ফেরা। বছর দুয়েক পর পাকিস্তানের বিপক্ষে আরেকটি সেঞ্চুরি। অমন বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর তো আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ার কথা…

ইনগ্রাম: আপনি ফিরে তাকানোর কথা বলছিলেন একটু আগে, এই ইনিংস দুটিতে আমি অনেকবারই ফিরে যাই। অনেক তৃপ্তি পাই। আর সত্যি বলতে, একটু আগে যে বললাম আক্ষেপ নেই, আসলে এখানেই সামান্য কিছু আক্ষেপ হয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির সময়টায়।

পাকিস্তানের দারুণ বোলিংয়ের সামনে দুটি সেঞ্চুরি আমাকে আসলে বিশ্বাস জুগিয়েছিল যে, এই পর্যায়ের ক্রিকেটে আমি খেলতে পারি। শোয়েব আক্তার, আব্দুল রাজ্জাক, ওয়াহাব রিয়াজ, সাঈদ আজমল, শহিদ আফ্রিদিরা ছিল প্রথমটিতে, প্রচণ্ড গরমে (আবু ধাবিতে) প্রতিকূল উইকেটে সেঞ্চুরিটি আমাকে বুঝিয়েছিল, আমিও পারি।

তবে ক্রিকেটে বা খেলায় ‘তুমি পারো কিনা’ এটির চেয়ে বড় ব্যাপার হলো ‘তুমি কতটা ঘনঘন বা ধারাবাহিকভাবে পারো।’ কিংবা ‘কতটা পার্থক্য গড়তে পারো।’ সেটি আমি পারিনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই সেঞ্চুরির পর যেমন আরেকটি সেঞ্চুরি পেয়েছি বেশ বিরতির পর। পর্যাপ্ত সুযোগ বা ব্যাটিং অর্ডারে নড়াচড়ার কথা বলা যায়। তবে দিনশেষে পারিনি, সেটিই তো বাস্তব।

যেটি বলছিলাম, ওপেন করতে পছন্দ করিনি ওই সময়টায় আর ভালো কিছু বোলারের সামনেও পড়ে গেলাম নতুন বলে। লাসিথ মালিঙ্গা প্রথম বলেই নরকের মতো এক ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কার করলেন, মোহাম্মদ ইরফান শুরুতেই ভয়ঙ্কর বাউন্সার দিলেন, আমার আত্মবিশ্বাসও তখন ছিল তলানিতে। সব মিলিয়ে হয়ে ওঠেনি।

তবে জীবনে সবই শিক্ষা। আমিও শিখেছি। কাজে লাগিয়েছি ক্রিকেটে ও জীবনে। সাফল্য-ব্যর্থতার এসব উপাখ্যানের কারণেই আমরা ক্রিকেট ভালোবাসি এত তীব্রভাবে, মাঠে বা টিভির সামনে বসে দেখি।

আমি আক্ষেপ আসলেই খুব একটা করি না। তবে এটা সত্যি যে, কখনও কখনও মনে হয়, যদি আরেকটু লম্বা সময় সুযোগ পেতাম, আরেকটি আস্থা পেতাম, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হয়তো থিতু হতে পারতাম। এই তো। এর বেশি কিছু নয়।

বেড়ে ওঠার সময়ে টেস্ট খেলার স্বপ্ন দেখতেন বলে জানালেন একটু আগে। সেই টেস্ট ক্রিকেটই খেলা হলো না। আক্ষেপ এখানেও নেই?

ইনগ্রাম:  কখনও কখনও জীবনে সামনে যা আসে, সেটিকে আলিঙ্গন করতে ও মানিয়ে নিতে হয়। কী হতে পারত, এই ভাবনা খুব কাজে দেয় না। আমি চেষ্টা করেছি আমার সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে বের করতে।

অবশ্যই টেস্ট খেলার স্বপ্ন দেখেছি একসময়। বেড়ে ওঠার সময় অনেকেরই অনেক স্বপ্ন, লক্ষ্য, চাওয়া থাকে। সময়ের পরিক্রমায় জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়।

টেস্ট ক্রিকেট কি খেলতে পারতাম আমি? কে জানে! তবে এটা জানি, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট আমার জীবনে এসেছে একদম সঠিক সময়ে। জীবন নতুন করে সাজাতে, খেলার মজাটা আবার খুঁজে পেতে, নিজের ক্যারিয়ার নতুনভাবে গড়ে তুলতে এই ফরম্যাট আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আমি যা করতে চেয়েছি, দুনিয়া ঘুরে ক্রিকেট খেলা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করা, আমাকে সেসব সুযোগ করে দিয়েছে টি-টোয়েন্টি।

আমি এমন ধরনের মানুষ নই যে আক্ষেপ করে কাতর হব। প্রাপ্তি নিয়ে আনন্দে ডুবে থাকতেই পছন্দ করি।

বেড়ে ওঠার সময় আপনার নায়ক কে ছিল?

ইনগ্রাম: আমার নায়ক ছিলেন গ্যারি কার্স্টেন।

খুব ‘গাটসি’ ব্যাটসম্যান ছিলেন…

ইনগ্রাম: তার এই দিকটাই তো সবচেয়ে ভালো লাগত! তার মতো কখনও টেস্ট ক্রিকেটে খেলতে পারিনি। তবে তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। সবুজ উইকেট, কঠিন পরিস্থিতি, চ্যালেঞ্জিং বোলিং আক্রমণ, এসব সময়ই তার সেরাটা দেখা যেত। তার খেলার এই দিকটা আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল।

প্রিয় নায়কের সঙ্গে সব অভিজ্ঞতাই অবশ্য সুখকর নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা দলে যখন আমি জায়গা পাকা করতে ধুঁকছিলাম, তখন তিনি ছিলেন কোচ। অনেক সময়ই অনেক কিছু তাকে করতে হয়েছে, আমার তা ভালো লাগেনি। পরিস্থিতিটা কঠিন ছিল।

অবশ্যই তিনি নিজের জায়গা থেকে নিজের কাজই করছিলেন। আমি স্রেফ নিজের জায়গা থেকে বললাম। মানুষ হিসেবে তিনি দারুণ। নিজের নায়কের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য সবার হয় না। পেছন ফিরে তাকালে এখানে নিজেকে সৌভাগ্যবানই বলি আমি। দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান ছিলেন এবং দারুণ একজন মানুষ। এখনও তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয় আমার, সবসময়ই তা উপভোগ্য ও ফলদায়ক। দারুণ ইতিবাচক মানুষ। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে নয়, বিশ্বজুড়ে অনেক ক্রিকেটারের এবং ক্রিকেট খেলাটায় অনেক ছাপ তিনি রেখেছেন।

টি-টোয়েন্টির সঙ্গে আপনি এখন টি-টেন ক্রিকেট খেলছেন। নিজেকে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার আরেকটি চ্যালেঞ্জ!

ইনগ্রাম: একদম! অসাধারণ অভিজ্ঞতা সত্যি বলতে। আপনি বিশুদ্ধ ক্রিকেটপ্রেমী হলে নাক সিঁটকাতে পারেন। আমি সেই বিতর্কেই যাচ্ছি না। ক্রিকেটার হিসেবে চ্যালেঞ্জগুলোর কথা বলছি, নতুন একটা ফরম্যাটের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কতটা মনস্তাত্ত্বিক ও টেকনিক্যাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়!

শুরুতে যখন টি-টেন খেলতে গেলাম, জানতাম না কীভাবে খেলা উচিত। শুরুতেই স্রেফ তাল মেলানোর চেষ্টা করেছি। সত্যি বলতে, নিজেকে বিস্মিত করার অনেক উপকরণ মজুদ ছিল। অনেক সময় লোকে নিজেও জানে না তার ক্ষমতার সীমা কতদূর। নতুন কোনো চ্যালেঞ্জ নিলে হয়তো সেটা নিজে আবিষ্কার করে।

শুরুতে বুঝে উঠতে পারিনি, কোন ধরনের শট খেলা উচিত, কীভাবে ইনিংস গড়া উচিত। সময়ের সঙ্গে যেসব রান আমরা করেছি, যে ধরনের রান তাড়া করে জিতেছি, অবিশ্বাস্যরকমের আনন্দ দিয়েছে তা। নিজেকে নতুনভাবে দেখার তৃপ্তি অন্যরকম।

এতদিন ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন না, দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটে আপনার বেড়ে ওঠার সময়ের সঙ্গী-বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়?

ইনগ্রাম: অবশ্যই। আমি তো মনেপ্রাণ দক্ষিণ আফ্রিকান। দারুণ সব স্মৃতি আছে, ঘনিষ্ঠ অনেক বন্ধু আছে। জাতীয় দলে যখন এসেছি, আমাদের প্রজন্মের অনেকেই দলে জায়গা থিতু করতে লড়ছিল। একসঙ্গ সেই লড়াইটা বন্ধন পোক্ত করে।

এছাড়া ‘এ’ দলের হয়েও, যেটা আগে বললাম, অল্প বয়সেই আমাদেরকে এশিয়া সফরে পাঠানো হয়েছিল যাতে স্পিন খেলাটা শিখতে পারি। একসঙ্গে আমরা অনেকে সেই পথচলার সঙ্গী ছিলাম। ওই সময়ের অনেকেই এখন স্পিন ভালো খেলে, নিশ্চয়ই তা কাজে লেগেছে।

রুশো, মিলারদের সঙ্গে নিয়মিতই কথা হয় আমার। বিপিএলের আসার আগে রুশোর সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। এখানে সে অসাধারণ খেলে গেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরেও, নানা দেশে খেলে অনেক বন্ধু বানানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি সবসময়ই মাঠের ভেতরে-বাইরের সম্পর্ক উপভোগ করি এবং তা ধরে রাখি।

শেষ প্রশ্ন, প্রথমবার বিপিএলে খেলছেন, টুর্নামেন্ট শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

ইনগ্রাম: এমন কিছু পারফরম্যান্স দিতে চাই, যা দলকে জেতাবে। আমি নিজেকে বিচার করি এটা দিয়েই যে দলের জয়ে কেমন অবদান। সেটা করতে পারছি মানে রান করছি ও ভালো করছি। আমি যদি তা পারি ও দলের অন্য কয়েকজন পারে, অবশ্যই দল ভালো করবে।