ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করে শাস্তির মুখে টেইলর

বড় শাস্তির মুখে জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন টেইলর। স্পট ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর তা দীর্ঘদিন গোপন করায় আইসিসির নিষেধাজ্ঞা পেতে যাচ্ছেন তিনি।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2022, 09:51 AM
Updated : 24 Jan 2022, 01:38 PM

এক বিবৃতিতে টেইলর দাবি করেছেন, স্পন্সরশিপ ও জিম্বাবুয়েতে একটি টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা চালু করার বিষয়ে আলোচনার জন্য ২০১৯ সালের অক্টোবরে তাকে ভারতে ডেকেছিল এক ব্যবসায়ী। সেখানে ‘ব্ল্যাকমেইল করে’ তাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্পট ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

কিন্তু বিষয়টি তিনি আইসিসিকে জানান চার মাস পর। বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্তা সংস্থাটি নাকি তাকে ‘একাধিক বছরের নিষেধাজ্ঞা’ দিতে চলেছে।

গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া টেইলর সোমবার টুইটারে বিশাল বিবৃতিতে তুলে ধরেছেন পুরো বিষয়টি। তার দাবি, প্রস্তাব পেলেও তিনি কোনো ফিক্সিংয়ে জড়িত হননি।

“স্পন্সরশিপ ও জিম্বাবুয়েতে সম্ভাব্য একটি টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা চালুর বিষয়ে আলোচনা করতে ২০১৯ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী আমাকে ভারতে যেতে অনুরোধ করেন। বলা হয়, এজন্য আমাকে ১৫ হাজার ডলার দেওয়া হবে।”

“একটু দুশ্চিন্তা যে হয়নি, তা বলব না। কিন্তু সময়টা এমন ছিল যে, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট থেকে আমরা তখন ৬ মাস ধরে বেতন পাইনি এবং জিম্বাবুয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলা চালিয়ে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে ছিল সংশয়। তাই আমি রাজি হয়েছিলাম। তার (ব্যবসায়ী) কথা মতো আলোচনা হয় এবং হোটেলে আমাদের শেষ রাতে উদযাপনের জন্য ওই ব্যবসায়ী এবং তার সহকর্মীরা আমাকে নৈশভোজে নিয়ে যায়।”

“আমরা পানীয় পান করেছিলাম এবং সন্ধ্যায় এক সময় তারা আমাকে খোলাখুলিভাবে কোকেন অফার করে, তারাও কোকেন নিচ্ছিল এবং আমি বোকামি করে টোপটা গিলেছিলাম। এরপর অসংখ্যবার এটা নিয়ে ভেবেছি, সে রাতের ঘটনাপ্রবাহ মনে করে এখনও অসুস্থ বোধ করি, তারা আমাকে কীভাবে বোকা বানিয়েছিল।”

“পরের দিন সকালে সেই একই লোকগুলো আমার হোটেল রুমে আসে এবং আগের রাতের কোকেন নেওয়ার ভিডিও দেখিয়ে আমাকে বলে, আমি যদি তাদের জন্য আন্তর্জাতিক ম্যাচে স্পট ফিক্সিং না করি, তাহলে ভিডিওটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে।”

“আমি কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলাম। ওই ৬ জন তখন আমার রুমে, নিজের নিরাপত্তার জন্য ভয় পেয়ে যাই। মনে হচ্ছিল, আমি শেষ হয়ে গেছি। যেন ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে ফেলেছি, যা আমার জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছে।”

“আমাকে ১৫ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বলা হয়েছিল এটা স্পট ফিক্সিংয়ের জন্য ‘আগাম’ দেওয়া হলো এবং ‘কাজ’ শেষ হলে আরও ২০ হাজার ডলার দেওয়া হবে। আমি সেই অর্থটা নিই, যাতে প্লেনে উঠতে পারি এবং ভারত ছাড়তে পারি। আমার মনে হয়েছিল, এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, কারণ তখন না বলার কোনো সুযোগ ছিল না। তখন আমার শুধু মনে হচ্ছিল, সেখান থেকে বের হতে হবে।”

“বাড়ি ফেরার পর ওই ঘটনা আমার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছিল। আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে পড়ে। আমার শরীরে এক ধরনের দাগ দেখা যায় এবং আমাকে শক্তিশালী অ্যান্টি-সাইকোটিক ওষুধ দেওয়া হয়।”

“ওই ‘ব্যবসায়ী’ তার বিনিয়োগের বিনিময় চেয়েছিল, যা আমি দিতে পারিনি এবং দিতামও না। এই অপরাধের বিষয়ে আইসিসিতে রিপোর্ট করতে আমার ৪ মাস সময় লেগে যায়। আমি স্বীকার করি, সময়টা বেশি লেগেছিল, কিন্তু ভেবেছিলাম আমি সবাইকে রক্ষা করতে পারব, বিশেষ করে আমার পরিবারকে। আমি আমার নিজের ইচ্ছায় আইসিসির কাছে গিয়েছিলাম এবং আশা করেছিলাম, কঠিন সেই সময়ের কথা, আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে সত্যিকারে ভয়ের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারলে তারা এই দেরি করার কারণটা বুঝতে পারবে।”

“দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তারা বোঝেনি। তবে এক্ষেত্রে নিজের অজ্ঞতার কথা বলে আমি পার পাব না। দুর্নীতিবিরোধী অনেক সেমিনারে আমি ছিলাম, আমরা জানি, কখন রিপোর্ট করতে হয়।”

“আমি বলতে চাই, আমি কখনই স্পট ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি অনেক কিছু হতে পারি কিন্তু প্রতারক নই। সুন্দর এই ক্রিকেট খেলাটির প্রতি আমার ভালোবাসা অনেক বেশি।”

“আইসিসিকে জানানোর পর আমি তাদের একাধিক সাক্ষাত্কার দিয়েছি। তাদের তদন্তের সময় আমি সৎ এবং স্বচ্ছ ছিলাম। ভেতরে-বাইরে বিষয়টা আমাকে কুঁড়ে খাচ্ছে আর মনে হচ্ছে আরও আগে যদি সহায়তা চাইতাম, পরামর্শের জন্য যেতাম।”

“বলা হচ্ছে, আইসিসি আমার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে একাধিক বছরের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। আমি বিনীতভাবে তা মেনে নিয়েছি। আশা করি, আমার গল্পটা ক্রিকেটারদের আগেভাগেই এমন কোনো প্রস্তাবের বিষয়ে রিপোর্ট করার ব্যাপারে উৎসাহিত করবে।”

“আমার জন্য গত দুই বছর ব্যক্তিগত ও পেশাগতভাবে অবিশ্বাস্যরকম চ্যালেঞ্জিং ছিল এবং নিজেরই তৈরি বিশাল বড় এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি আমি। আমার পরিবার এবং বন্ধুরা আমাকে অবিশ্বাস্যভাবে সমর্থন করছে।”

“আমার জীবনকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে আসছে মঙ্গলবার, ২৫ জানুয়ারি থেকে আমি একটি পুনর্বাসনকেন্দ্রে যোগ দিচ্ছি। আমাকে এই গল্পটা বলতে হচ্ছে কারণ, আমি জানি লোকে আমার কথা শুনতে চাইবে। বুঝতে চাইবে কীভাবে এ পর্যায়ে এলো ঘটনাটি। অনেক সপ্তাহ আমি দূরে থাকব এবং ভালো হয়ে ওঠার চেষ্টা করব।”

“আশা করি, আমার গল্পটা যে শুনবে সে উৎসাহিত হবে, প্রয়োজনে সহায়তা পাবে। আমি আগে বুঝতে পারিনি যে গত কয়েক বছরে যে যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম, সামনে এসে সব খুলে বললে এতটা স্বস্তি মিলবে। ড্রাগ আর নারকোটিক্স কাউকেই ছাড়ে না। আমার যে সমস্যা আছে, এটা স্বীকার করতে আমার সবকিছু নিয়ে নিয়েছে এসব।’

সবশেষে নিজের কৃতকর্মের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চান টেইলর। 

বিষয়টি নিয়ে আইসিসি অবশ্য এখনও কোনো মন্তব্য করেনি।

২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তিন সংস্করণ মিলিয়ে টেইলর জিম্বাবুয়েকে নেতৃত্ব দেন ৭১ ম্যাচে। প্রথম দফায় জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ছিলেন ২০১১ এর মাঝমাঝি থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর তিনি জাতীয় দল থেকে সরে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট দল নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে তিন বছরের কোলপ্যাক চুক্তি করে। পরে ২০১৭ সালে আবার ফেরেন জাতীয় দলে।

জিম্বাবুয়ের হয়ে ২০৫ ওয়ানডেতে ৩৫.৫৫ গড়ে টেইলরের রান ৬ হাজার ৬৮৪, দলটির হয়ে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই সংস্করণে তার ১১ সেঞ্চুরি জিম্বাবুয়ের রেকর্ড। দলটির হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির রেকর্ডও তার (১৭টি)।

টেস্ট খেলেছেন তিনি ৩৪টি। ৩৬.২৫ গড়ে রান ২ হাজার ৩২০, জিম্বাবুয়ের হয়ে যা চতুর্থ সর্বোচ্চ। এই সংস্করণে তার ৬ সেঞ্চুরির পাঁচটিই বাংলাদেশের বিপক্ষে। ৪৫ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তার রান ৯৩৪।

আইসিসি দুর্নীতি বিরোধী বিধির বেশ কয়েকটি ধারা ভঙ্গের দায়ে গত বছরের এপ্রিলে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ৮ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় জিম্বাবুয়ের আরেক সাবেক অধিনায়ক ও বাংলাদেশের একসময়কার বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিককে।