‘ইবাদত যে দিন ভালো জায়গায় বল করবে, সেদিন ওই দল শেষ’

গতি সব সময়ই ছিল কিন্তু ছিল না নিয়ন্ত্রণ। বিচ্ছিন্নভাবে দুয়েকটা স্পেলে ঝলক দেখালেও বেশিরভাগ সময় ছিলেন অকার্যকর। উইকেট নেওয়ায় ব্যর্থতার সঙ্গে ছিল রান বিলানোর প্রবণতা। সব মিলিয়ে ১০ উইকেট নেওয়া বোলারদের মধ্য টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে গড় ছিল তার। স্বাভাবিকভাবেই তাকে খেলানো নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। রেকর্ড রাঙা বোলিংয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন ইবাদত হোসেন চৌধুরি।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Jan 2022, 06:24 AM
Updated : 5 Jan 2022, 10:36 AM

মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট শুরুর আগে নিউ জিল্যান্ডের পেসারদের নিয়ে শঙ্কা জানানোর সঙ্গে বাংলাদেশের পেসারদের নিয়ে রোমাঞ্চ থাকার কথা বলেছিলেন মুমিনুল হক। কিন্তু বাস্তবতা, পরিসংখ্যান বলছিল অন্য কথা। তবে শক্তি-সামর্থ্য-স্কিলে ঢের এগিয়ে থাকা কিউই পেস চতুষ্টয়কে বিস্ময়করভাবে ছাপিয়ে গেলেন বাংলাদেশের তিন পেসার। তাতে নেতৃত্ব দিলেন ইবাদত। একের পর এক অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্সের পরও সুযোগ দিয়ে যাওয়ার প্রতিদান দিলেন রেকর্ড গড়া বোলিংয়ে। 

তাদের উজ্জীবিত পারফরম্যান্সে প্রথম টেস্টে ৮ উইকেটের ইতিহাস গড়া জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। এগিয়ে গেছে দুই ম্যাচের সিরিজে।

নিউ জিল্যান্ডের যে বোলিং আক্রমণ তাতে কাজটা সহজ ছিল না। স্বাগিতকদের চার পেসারের সবাই টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ১৫ জনের মাঝে আছেন। টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট ও নিল ওয়্যাগনারের উইকেট দুইশর বেশি করে, গড় ২৬ থেকে ২৮। কাইল জেমিসন পেয়েছেন টেস্ট ইতিহাসে সেরা শুরুর একটি। সেখানে বাংলাদেশের কারো ছিল না ২০ এর বেশি উইকেট, গড় ছিল না ৫০ এর নিচে।

অথচ নিউ জিল্যান্ডের চার পেসারকে অনায়াসে পেছনে ফেলে দিলেন ইবাদত, তাসকিন ও শরিফুল। নতুন বলে সুইং করালেন, পুরান বলে রিভার্স। নিশ্চিতভাবেই ৭ পেসারের মধ্যে ম্যাচজুড়ে সবচেয়ে গতিময় ছিলেন ইবাদত। ঘণ্টা প্রতি ১৪০ কিলোমিটারে আশেপাশের গতিতে বোলিং করলেন নিয়মিত।

অথচ প্রথম ইনিংসেও তিনি ছিলেন অধারাবাহিক। তাসকিন ও শরিফুলের চমৎকার বোলিংয়ে গড়া চাপ কেটে গিয়েছিল তার কিছু আলগা বলে। সেই ইবাদত দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬ রানে নিলেন ৬ উইকেট, দেশের বাইরে যা বাংলাদেশের কোনো পেসারের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড।

নিশ্চিতভাবেই এই বোলিং জায়গা করে নেবে বাংলাদেশের ক্রিকট গল্পগাঁথা। নিউ জিল্যান্ডে এসে বোল্ট, সাউদি, ওয়্যাগনারদের ম্লান করে দেওয়ার মতো বোলিং রোজ রোজ ঘটে না। রস টেইলরের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানকেও ভুগছিলেন ইবাদতকে সামলাতে।

গতিময় বোলিংয়ের সঙ্গে মাঠে আগ্রাসনও দেখান ইবাদত। স্ট্রেট ড্রাইভে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে চমৎকার এক বাউন্ডারি মারেন টেইলর। পরের বলে এক ধরনের একটি ডেলিভারি দিয়ে ব্যাটসম্যানকে আবার একই শট খেলতে বলেন ইবাদত। দুই জনের দ্বৈরথে শেষ হাসি হাসেন বাংলাদেশের পেসারই। পঞ্চম দিন সাত সকালে বোল্ড করে দেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাধা থাকা টেইলরকে।

এমনিতে মুখে সব সময়ই লেগে থাকে হাসি। সতীর্থদের উইকেটে সবচেয়ে বেশি উদযাপন করতে দেখা যায় তাকেই। নিজে উইকেট পেলে উদযাপন করেন স্যালুট দিয়ে। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতার পর স্যালুট পেলেন সিলেটের দুই সতীর্থ আবু জায়েদ চৌধুরি ও সৈয়দ খালেদ আহমেদের কাছ থেকে।

প্রেজেন্টেশন থেকে শুরু করে সংবাদ সম্মলেন সব জায়গাতে ইবাদতকে প্রশংসায় ভাসালেন, নিউ জিল্যান্ডে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচজয়ী অধিনায়ক মুমিনুল। অনেকে অবাক হলেও সতীর্থ পেসারের এই পারফরম্যান্সে চমক হয়ে আসেনি তার জন্য।

ছবি: আইসিসি টুইটার

“ইবাদত অবিশ্বাস্য বোলিং করেছে। অসাধারণ পারফরম্যান্স করেছে। (ইবাদতকে নিয়ে) আমি বিস্মিত নই।”

“আমি জানি, দলের অনেকেই জানে, ও যে মাপের বোলার, হয়তো বল এক জায়গায় করতে পারে না, যেদিন ভালো জায়গায় বল করবে, ওই দিন ওই দল শেষ। কিন্তু ওর এটা ধারাবাহিক ছিল না। সবশেষ ২-৩ বছর ধরে আমাদের বোলিং কোচ অনেক পরিশ্রম করছে ওকে নিয়ে। এমনকি আমিও করছি। গত ১-২ বছর ধরে টানা টেস্ট ম্যাচ খেলেছে। এটার ফল কালকে আর আজকে দিয়েছে ম্যাচ জিতিয়ে।”

ম্যাচেই আগে সংবাদ সম্মলনে মুমিনুল বলেছিলেন, নিউ জিল্যান্ডে বাংলাদেশের পেসারদের বোলিং দেখতে তিনি মুখিয়ে আছেন। তার বিশ্বাস ছিল, এবার খুব ভালো কিছু উপহার দিবেন পেসাররা। অধিনায়কের কথা বাস্তব হয়েছে ইবাদত, তাসকিন, শরিফুলদের চমৎকার বোলিংয়ে।

তাসকিন ও শরিফুল নেন তিনটি করে উইকেট। প্রথম ইনিংসে উইকেটশূন্য ছিলেন তাসকিন, পরেরটিতে শরিফুল। কিন্তু দুই জনই ম্যাচ জুড়ে ছিলেন উজ্জ্বল। তাদেরও প্রশংসায় ভাসালেন মুমিনুল। 

“আমরা ম্যাচ জিতেছি বোলারদের জন্য। বোলাররা প্রথম ইনিংসে ও দ্বিতীয় ইনিংসে নিউ জিল্যান্ডকে চাপে রেখেছে। অনেক কষ্ট করেছে ওরা, ঠিক জায়গায় বল রেখেছে ও প্রক্রিয়া ধরে রেখেছে।”

“তাসকিন ছিল অসাধারণ। প্রথম ইনিংসে উইকেট পায়নি, কিন্তু রান আটকেছে। শরিফুল, তরুণ, মাত্র ২ ম্যাচ খেলেছে। কিন্তু দলের ভেতর এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যে পালন করেছে, এটা অবিশ্বাস্য। সত্যি কথা, আমার কাছে মনে হয়, এই টেস্ট জেতার পেছনে সবচেয়ে বেশি হাত ছিল বোলারদের। তার পর মিরাজ… এই উইকেটে বল ঘোরে না। তারপরও সে কোনো না কোনোভাবে উইকেট বের করেছে। এই ম্যাচ জেতায় সবচেয়ে বড় অবদান বোলারদের। চার বোলার নিয়ে টেস্ট জেতাটা অবিশ্বাস্য।”

শুধু বোলিংয়েই থেমে থাকেনি বোলারদের অবদান। পঞ্চম দিন ইবাদতের বলে নেন শূন্য ঝাঁপিয়ে জেমিসনের অসাধারণ ক্যাচ নেন শরিফুল। এমন কিছু পেসারদের কাছ থেকে আশা করেননি মুমিনুল।

“আমরা কিন্তু পেস বোলারদের কাছ থেকে আশা করি না যে, এত ভালো ক্যাচ ধরবে। আমরা যে মোমেন্টামে ছিলাম, ওই মোমেন্টামে আমরা যা কিছু করতে চাই, এই জিনিসটা ওরা করেছে। আমার কাছে মনে হয় অবিশ্বাস্য।”