ফুল ফোটে, গাঁথা হয় না জয়ের মালা

ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরি, দলের বিপর্যয়ে নেমে আগুনে বোলিংয়ের বিপক্ষে কী অসাধারণ এক ইনিংস লিটন দাসের! তাইজুল ইসলামও কম যান না। ধ্রুপদী বাঁহাতি স্পিনের অনুপম প্রদর্শনী। পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের সেরা বোলিংয়ের কীর্তি। লিটন ও তাইজুল চট্টগ্রাম টেস্টকে ভুলবেন না কখনোই। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট কি মনে রাখবে? বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে আলাদা কোনো জায়গা নিশ্চিতভাবেই থাকবে না এই টেস্টের।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিচট্টগ্রাম থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2021, 01:58 PM
Updated : 30 Nov 2021, 01:58 PM

অথচ ম্যাচটি হয়ে থাকতে পারত স্মরণীয়। লিটন ও তাইজুলের দারুণ পারফরম্যান্সই শুধু নয়, মুশফিকের দুর্দান্ত ইনিংস, ইবাদত হোসেনের কয়েকটি স্পেল, ইয়াসির আলি চৌধুরির ব্যাটে আশার ঝিলিক, প্রথম ইনিংসে দলের লিড, উল্লেখ করার মতো এরকম অনেক কিছুই আছে। প্রয়োজন ছিল স্রেফ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আর দু-একজনের দাঁড়িয়ে যাওয়া আর এই সবকিছুকে এক সুতোয় গাঁথা। জয়ের হাসি তাহলে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মুখেই থাকত। 

কিন্তু টুকরো টুকরো ছবিগুলো বিচ্ছিন্নই রয়ে যায়। জোড়া আর লাগে না। কাঙ্ক্ষিত সেই জয়ের হাসিও তাই হাতছানি দিয়ে যায় মিলিয়ে।

এমনিতে দেশের ক্রিকেটের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট জয় অনেকটা অভাবনীয়ই। টেস্ট না টি-টোয়েন্টি, বাংলাদেশ কোনটি বেশি খারাপ খেলে, তা নিয়ে জোর লড়াই হতে পারে। টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের কাছে হোয়াইটওয়াশড হওয়ার পর টেস্টে সাকিব-তামিম-তাসকিনদের ছাড়া পাত্তা পাওয়ার কথা নয়।

কিন্তু বাংলাদেশ পাত্তা আদায় করে নিয়েছিল। চমকে দিয়ে জয়ের আশাও জাগিয়েছিল। সেই আশা জিইয়ে রাখতে পারেনি। বাজেভাবে হারলে স্রেফ হতাশাই থাকে। সম্ভাবনা জাগিয়ে হারলে সঙ্গী হয় আক্ষেপও। চট্টগ্রাম টেস্ট বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরেকটি আক্ষেপের অধ্যায় হয়ে রইল।

ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মুমিনুল হককে বিষন্ন মনে হলো হয়তো এ কারণেই। এমনিতে অনেক ম্যাচ শেষেই বাংলাদেশের অধিনায়কদের আতিপাতি করে খুঁজে ইতিবাচকতা বের করতে হয়। সেখানে চট্টগ্রাম টেস্টে ইতিবাচক দিক বেশ কিছু। কিন্তু অধিনায়ক তো জানেন, কত বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে!

ম্যাচের ফলে অবশ্য বাংলাদেশের লড়িয়ে ক্রিকেট খেলার প্রমাণ খুব বেশি নেই। পঞ্চম দিনের প্রথম সেশনে খেলা শেষ। পাকিস্তানের জয় ৮ উইকেটে। সুস্পষ্ট ব্যবধান। তবে এই ম্যাচেরই তৃতীয় দিন তৃতীয় সেশন শুরুর সময় বাংলাদেশ ছিল এগিয়ে।

পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ লিড নেবে, কজন ভাবতে পেরেছিলেন টেস্ট শুরুর আগে! ৪৪ রানের লিড দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত এই ম্যাচের প্রেক্ষাপটে। সেখান থেকে স্রেফ প্রয়োজন ছিল লাগামটা ধরে রাখা। বাংলাদেশ তা হারিয়ে ফেলে স্রেফ ১১ ওভারের মধ্যে। ২৫ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেললে ৪৪ রানের লিডের তো আর মূল্যই থাকে না!

প্রথম চার জুটির একটিতেই যদি ৭০-৮০ রানের একটি বন্ধন গড়ে উঠত, কিংবা ৩০-৪০ রানের ছোট দুটি জুটি থাকত, ম্যাচের চিত্র হতে পারত অন্যরকম। এরকম একটি-দুটি জুটি হতে পারত ম্যাচের প্রথম ইনিংসেও। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশ ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল ৪৯ রানেই।

অথচ এই টেস্টেই পাকিস্তানের ওপেনার আবিদ আলি খেলেন ১৩৩ ও ৯১ রানের ইনিংস। আরেক ওপেনার আব্দুল্লাহ শফিক, মাত্র তিনটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে যার অভিষেক, তিনি দুই ইনিংসে করেন ৫২ ও ৭৩।

পাকিস্তানের দুই ওপেনারের রান ৩৪৯। বাংলাদেশের প্রথম চার ব্যাটসম্যানের সম্মিলিত রান ৬৭!

লেজের ব্যাটসম্যানরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন! তাদের কাছে বড় ইনিংস প্রত্যাশা করে না দল। আশা করে কিছুটা প্রতিরোধ। কিন্তু প্রথম ইনিংসে লিটন ও মুশফিকের দ্বিশতক রানের জুটির পর পরের পাঁচ জুটির একটিও ছুঁতে পারেনি ৩০।

দ্বিতীয় ইনিংসের চিত্র আরও করুণ। শেষ ৪ উইকেট পড়েছে ৪ রানের মধ্যেই! লিটন দাসের সঙ্গে নুরুল হাসান সোহানের জুটি যখন জমে গেছে প্রায়, ব্যাখ্যাতীত এক আত্মঘাতী শটে উইকেট ছুঁড়ে আসেন সোহান। এই জুটি যদি আর ৪০-৫০ রান বেশি করতে পারত, কিংবা পরের জুটিগুলো একটু দাঁড়াতে পারত, বদলে যেতে পারত ম্যাচের চিত্র।

হারের মূল দায় ব্যাটিং ব্যর্থতা। তবে বোলিংয়েও দেখা যায়নি ইউনিট হিসেবে নিজেদের মেলে ধরা। তাইজুল যখন দুর্দান্ত বোলিং করছেন, মেহেদী হাসান মিরাজ তখন পারেননি চাপ ধরে রাখতে। ইবাদত যখন প্রতিপক্ষকে চেপে ধরেছেন, আবু জায়েদ চৌধুরি তখন আলগা করে দিয়েছেন ফাঁস।

ম্যাচ শেষে তাই বরাবরের মতোই হাহুতাশ ‘আরেকটুর’ জন্য। যদি এমন হতো, যদি অমন হতো! জ্বলে ওঠা দু-একজনের পাশে যদি দেখা যেত কিছু স্ফুলিঙ্গ।

তা আর হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাই ফুল ফোটে। ফুল ঝরে। শুকিয়েও যায়। জয়ের মালা আর গাঁথা হয় না।