বিশেষ তো বটেই। দিনের শুরুটা যেমন ছিল, তাতে শেষবেলার এমন ছবি অভাবনীয় কিছুও। প্রথম সেশনে ৪৯ রানে প্রথম ৪ ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ফেলা দল দিন শেষ করবে ওই ৪ উইকেটেই আড়াইশ ছাড়িয়ে, কজন ভাবতে পেরেছিলেন!
চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম দিন শেষে বাংলাদেশের রান ৪ উইকেটে ২৫৩। আলোকস্বল্পতায় খেলা শেষ হয় ৫ ওভার আগে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক দুঃসময় আর এই ম্যাচের শুরুর বিপর্যয় মাথায় রাখলে বলতে হবে, স্বপ্নময় একটি দিন।
ক্যারিয়ারের আগের ২৫ টেস্টে যার সেঞ্চুরি ছিল না একটিও, টানা বাজে পারফরম্যান্সের কারণে টি-টোয়েন্টি দলে যিনি জায়গা হারান পাকিস্তানের এই সফরেই, সেই লিটন দিন শেষে অপরাজিত ১১৩ রানে।
যে কর্তৃত্ব আর স্কিল তিনি দেখিয়েছেন, অনায়াস ব্যাটিংয়ে যেভাবে ছুটে গেছেন নানা শটের রথে চড়ে, তার প্রতিভা আর জাতও ফুটে উঠেছে তাতে। ব্যাটিং কত সহজই মনে হয় তাকে দেখলে! সঙ্গে সেই পুরনো আক্ষেপ, কেন এই লিটনকে পাওয়া যায় না নিয়মিত!
সেঞ্চুরিয়ান লিটনের পাশে আপাতত তাকে মনে হতে পারে পার্শ্ব-নায়ক। তবে ভূমিকা তার নায়কোচিতই ছিল। অনেকটা সময় নিয়েছেন শুরুতে। চেষ্টা করেছেন সুর-তাল ধরার। যখন তা খুঁজে পেয়েছেন, এগিয়ে গেছেন ছন্দময় ব্যাটিংয়ে। দিনশেষে তিনি অপরাজিত ৮২ রানে।
পঞ্চম উইকেটে দুজনের অবিচ্ছিন্ন জুটির রান ২০৪। পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা জুটি এটি, পঞ্চম উইকেটে প্রথম দ্বিশতক জুটি।
প্রথম সেশন শেষে এই সংখ্যাগুলি ছিল অকল্পনীয়। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা দল উইকেট হারাতে থাকে একের পর এক।
পিচে ঘাসের ছোঁয়া থাকলেও দিনজুড়েই ছিল পুরোপুরি ব্যাটিং সহায়ক। তবে পাকিস্তানিদের দারুণ বোলিং আর বাংলাদেশের টপ অর্ডারের আলগা ব্যাটিং মিলিয়ে আসে বিপর্যয়।
শাহিন শাহ আফ্রিদি প্রথম ডেলিভারিতেই নাড়িয়ে দেন সাদমান ইসলামকে। উইকেটও পেতে পারতেন তিনি প্রথম ওভারে। ম্যাচের পঞ্চম ডেলিভারি সাদমানের ব্যাট হালকা ছুঁয়ে কিপারের গ্লাভসে আশ্রয় নিলেও আবেদন করেননি কেউ। টিভি রিপ্লেতে ধরা পড়ে ব্যাটে বলের স্পর্শ।
সাদমান আরেক দফায় বেঁচে যান হাসান আলির বলে। জোরাল আবেদনে আম্পায়ার আউট দেননি, পাকিস্তানও রিভিউ নেয়নি। এবারও টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, আউট ছিলেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
সাদমানের বেঁচে যাওয়ার পালার মধ্যেই বিদায় নেন তার সঙ্গী সাইফ। তার শরীর তাক করে গতিময় এক বাউন্সার দেন আফ্রিদি। কোনো জবাবই পাননি সাইফ, তার ব্যাটের ওপরের দিকে লেগে সহজ ক্যাচ যায় শর্ট লেগে।
এরপর সাদমানও টেকেননি বেশিক্ষণ। রাউন্ড দা উইকেটে স্টাম্পের বেশ দূর থেকে ডেলিভারি করেন হাসান। অ্যাঙ্গেল বুঝতে না পেরেই হয়তো লাইন মিস করে এলবিডব্লিউ হন সাদমান।
শান্তর শুরুটা ছিল দারুণ। উইকেটে যাওয়ার পরপরই দারুণ ফ্লিকে বাউন্ডারি মারেন আফ্রিদিকে। ফাহিম আশরাফকে চার মারেন দৃষ্টিনন্দন স্ট্রেট ড্রাইভে। কিন্তু তিনিও আটকা পড়েন ওই ১৪ রানেই। ফাহিমের বলেই কাট করে ক্যাচ নেন পয়েন্টে।
বাংলাদেশে রান তখন ৪ উইকেটে ৪৯।
লিটন ও মুশফিকের ব্যাটিং মাস্টারক্লাস সেখান থেকেই। পাকিস্তানি বোলাররা খুব একটা বিপাকে ফেলতে পারেননি দুজনকে।
টি-টোয়েন্টিতে এই বছর এত বাজে পারফরম্যান্স লিটনের যে তার টেস্ট পারফরম্যান্স ভুলে যেতে পারেন অনেকে। অথচ টেস্টে তিনি দারুণ ধারাবাহিক এবছর। আগের ৫ টেস্টে গড় ছিল ৪৬.২৫, আগের টেস্টেই খেলেন ৯৫ রানের ইনিংস। এই সংস্করণে ফিরতে তার আত্মবিশ্বাসও যেন ফিরে এলো।
৯৫ বলে তিনি স্পর্শ করেন ফিফটি। ৬৭ রানে বেঁচে যান একবার। আফ্রিদির বলে মিড উইকেটে সহজ ক্যাচ ছাড়েন সাজিদ খান। এরপর আর পিছু ফিরে তাকাননি।
আগে ৯৪ ও ৯৫ রানে আউট হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তার, দুবারই আউট হয়েছেন বড় শট খেলতে গিয়ে। এজন্যই হয়ত এ দিন সেঞ্চুরির কাছাকাছি গিয়ে সাবধানী হয়ে যান অনেকটা।
সেঞ্চুরি ছোঁয়ার রানে অবশ্য বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেন দ্রুত রান করার চেষ্টায়। থ্রো সরাসরি স্টাম্পে লাগলে আউটও হতে পারতেন। তা হয়নি। লিটনের মুখে তাই ফুটে ওঠে সেঞ্চুরির হাসি।
তিনি বড় রান পাওয়া মানে বরাবরই দারুণ সব শটের পসরা মেলে ধরা। তবে এ দিন আলাদা করে বলতে হবে দুর্দান্ত কয়েকটি কাট শটের কথা।
মুশফিক শট খেলায় ছিলেন অনেক সতর্ক। ঝুঁকিপূর্ণ শট একদমই খেলেননি। দারুণ কিছু ড্রাইভ অবশ্য খেলেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অপরাজিত থেকে মাঠ ছেড়েছেন।
লিটন-মুশফিকের সৌজন্যে অভিষিক্ত ইয়াসির আলি চৌধুরিকে ব্যাটিংয়ে নামতে হয়নি এ দিন। তিনি নিশ্চয়ই তাতে অখুশী নন!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৮৫ ওভারে ২৫৩/৪ (সাদমান ১৪, সাইফ ১৪, শান্ত ১৪, মুমিনুল ৬, মুশফিক ৮২*, লিটন ১১৩*; আফ্রিদি ১৮-৪-৫০-১, হাসান ১৩-৪-৩৮-১, ফাহিম ১০-২-৩৮-১, সাজিদ ২২-৩-৬৮-১, নুমান ২২-৫-৫১-০)।