টিম ম্যানেজমেন্টকে ‘ম্যানেজ’ করবে কে

সিরিজ শুরুর আগের দিন থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ বেশ কবার নানা প্রশ্নে বলেছেন, ‘টিম ম্যানেজমেন্ট জানে’, ‘টিম ম্যানেজমেন্ট বলতে পারবে।’ অধিনায়ক হিসেবে যদিও তিনি নিজেও টিম ম্যানেজমেন্টের অংশ হওয়ার কথা। তবু তার কথায় ধরে নেওয়া যায়, এই সিরিজে তিনি তা ছিলেন না। তাহলে যারা ছিলেন, তাদের ভূমিকা কি? নতুন পথচলার শুরুতেও কেন বারবার বেজে উঠেছে পুরনো বেতালা সুর!

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2021, 05:36 AM
Updated : 23 Nov 2021, 08:19 AM

এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চরম ব্যর্থতার পর পাকিস্তান সিরিজ দিয়ে এই সংস্করণে বাংলাদেশের নতুন যাত্রার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েকজন নতুন ক্রিকেটার দলে নিয়েই শেষ নতুন শুরুর প্রকল্প। ছিল না গোছানো আয়োজন, ফুটে ওঠেনি স্বচ্ছ পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ ভাবনা, দেখা যায়নি নিজেদের বদলানোর তীব্র তাড়না। তাই এই সিরিজেও বারবার তাড়া করেছে পুরনো ভূত।

বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর উড়তে থাকা পাকিস্তানের কাছে ৩-০তে হার বাংলাদেশের জন্য অপ্রত্যাশিত নয় মোটেও। বিশেষ করে, দলের মনোবল যখন তলানিতে এবং দলে যখন বেশ কিছু নতুন মুখ। তবে ব্যবধানে না হলেও হারের ধরনে প্রবলভাবে মিশে আছে হতাশার নানা উপকরণ। 

তিন ম্যাচের দুটিতেই বাংলাদেশ বেশ লড়াই করেছে বটে। তবে টি-টোয়েন্টিতে নতুন দিনের স্লোগান ধরতে পারেনি খুব উঁচু গলায়। সময়ের দাবি মেটানোর ছাপ তাদের অ্যাপ্রোচে বা ক্রিকেটের ধরনে দেখা যায়নি, সম্ভাব্য ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মেটানোর আভাস দেওয়া তো বহুদূর।

এই সিরিজে বাংলাদেশের ভাবনা ও কৌশলে পরিকল্পনার চেয়ে বেশি ছিল জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা। ছক কেটে ও হিসেব কষে এগোনোর চেয়ে বেশি ছিল অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে যাওয়ার আশা। মুখ থুবড়ে পড়েছে সবই।

বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর একটা ব্যাপার পরিষ্কার ছিল, বদলানো জরুরি বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টির অ্যাপ্রোচ। ২০ ওভারের ক্রিকেটকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। এই সংস্করণ প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে। প্রতিদিন নতুনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ এখনও পড়ে আছে পুরনো ধ্যান-ধারনায়। এখনও সাবধানী ব্যাটিং, উইকেট ধরে রাখা, এসব ব্যাপার দেখা যায় দলের ব্যাটিংয়ে ও মানসিকতায়।

অথচ বড় দলগুলি বা সাহসী ক্রিকেটের জন্য পরিচিতি পেয়ে যাওয়া আফগানিস্তান তো বটেই, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, নামিবিয়াও এবারের বিশ্বকাপে দেখিয়েছে, টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং কেমন কেমন হওয়া উচিত। উইকেট যতই পড়ুক, শুরুতে দ্রুত রান করা চাই-ই চাই তাদের।

হতাশায় মাঠ ছাড়ছে বাংলাদেশ দল, সাম্প্রতিক সময়ের নিয়মিত চিত্র।

বাংলাদেশের গুটিয়ে থাকা মানসিকতার ছাপ উদ্বোধনী জুটিতেই। টি-টোয়েন্টিতে যেখানে পাওয়ার প্লেতে যত বেশি সম্ভব রান করতে হয়, শরীরী ভাষা ও ব্যাটের আগ্রাসন দিয়ে প্রতিপক্ষকে পিষে ফেলার চেষ্টা করতে হয়, সেখানে বাংলাদেশ ভীষণরকম নিস্তরঙ্গ। পাকিস্তানের প্রথম ম্যাচে ৬ ওভারে রান ছিল ৩৩, পরেরটিতে ৩৬ ও শেষ ম্যাচে ২৫।

উইকেট যদিও ব্যাটিংয়ের জন্য আদর্শ ছিল না। তবে এই ধরনের উইকেটে পাওয়ার প্লে কাজে লাগানো আরও বেশি জরুরি। বল নতুন ও শক্ত থাকতেই দ্রুত কিছু রান, টপ অর্ডারের কোনো ব্যাটসম্যানের ক্যামিও ইনিংস, এসব হতে পারে কার্যকর। বাংলাদেশ ওপেনিংয়ে বেছে নেয় মোহাম্মদ নাঈম শেখ ও সাইফ হাসানকে। ঝড়ো সূচনার সম্ভাবনা সেখানেই শেষ। দুজনের কেউ তো আসলে ওই ঘরানার ব্যাটসম্যানই নন!

নাঈম টি-টোয়েন্টিতে রান মোটামুটি করে আসছেন। এই বছর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান তারই (২৬ ইনিংসে ২৩ গড়ে ৫৭৫)। তবে তাকে নিয়ে মূল প্রশ্ন তার স্ট্রাইক রেট ও সীমিত শট। প্রান্ত বদলাতে ভোগেন তিনি প্রায়ই। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যানের পায়ের কাজের দুর্বলতাও দৃশ্যমান বেশ আগে থেকেই। সব মিলিয়ে টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের সামর্থ্য তার অনেক দিন থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ এবং সেসব জায়গায় উন্নতির চিহ্নমাত্র নেই এই সিরিজেও। অথচ তাকে টি-টোয়েন্টি দলের ‘অটোমেটিক চয়েস’ হিসেবেই শুধু রাখা হচ্ছে না, এক নম্বর ওপেনারও বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নানা সময়ই শোনা গেছে, বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান স্বয়ং নাঈমকে মনে করেন টি-টোয়েন্টির জন্য দারুণ উপযুক্ত। সিদ্ধান্তের শেকড় বুঝতে তাই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। স্কোয়াড ও একাদশ নির্বাচনে হস্তক্ষেপের কথা বোর্ড প্রধান নিজেই নানা সময়ে বলেছেন বেশ গর্ব নিয়ে।

সাইফ হাসানকে নিয়ে এবার নির্বাচক কমিটি ও টিম ম্যানেজমেন্ট যে খামখেয়ালিপনা করল, সেটিই আসলে ফুটিয়ে তোলে বাংলাদেশের ক্রিকেট কতটা অগোছালো। মাত্র দু সপ্তাহ আগেও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ত্রিসীমানায় ছিলেন না তরুণ এই ওপেনার। থাকার কথাও নয়, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই তার ব্যাটিংকে মনে করা হয় বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের জন্য বেশি উপযোগী।

বিশ্বকাপের পর ‘টিম ডিরেক্টর’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া খালেদ মাহমুদের তত্ত্বাবধানে কয়েকজন ক্রিকেটারকে নিয়ে মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে অনুশীলন শুরু করেন আগেভাগেই। সেখানে বিস্ময়করভাবে জায়গা পান সাইফ। বিস্ময়ের শেষ নয় সেখানেই। সেই সাইফ ডাক পেয়ে যান চূড়ান্ত স্কোয়াডে এবং প্রথম দুটি ম্যাচ খেলেও ফেলেন! বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি হালে পানি পাননি।

নাঈম ও সাইফের ব্যাটিংয়ের বাস্তবতা বলছে, নিজেদের সেরা দিনেও তারা পাকিস্তান বা এই মানের বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ৬ ওভারে ৫০ রানের আশেপাশে তুলতে পারবেন না। এমন দুজনের ওপর নির্ভর করা মানে কি পেছন পানে হাঁটা নয়?

খালেদ মাহমুদের সেই অনুশীলন শিবিরে ছিলেন পারভেজ হোসেন ইমন। নতুন দিনের সৈনিক হতে পারেন যিনি অনায়াসেই। উঠতি ক্রিকেটারদের মধ্যে এই মুহূর্তে টপ অর্ডারে টি-টোয়েন্টির ব্যাটিংয়ের ঝাঁঝ সবচেয়ে বেশি আছে এই তরুণের ব্যাটেই। দেশের দ্রুততম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরির রেকর্ড তার। ভয়ডরহীন ব্যাটিং করেন, শট সীমিত হলেও হাতে আছে জোর। অথচ তাকে স্কোয়াডেই রাখা হলো না!

দুই ম্যাচে সাইফের ব্যর্থতার পর হুট করেই মাঝরাতে ঘোষিত দলে পারভেজ ও পেসার কামরুল ইসলাম রাব্বিকে দলে নেওয়া হলো। সাইফকে সিরিজের মাঝেই পাঠিয়ে দেওয়া হলো চট্টগ্রামে, টেস্ট দলের অন্যদের সঙ্গে অনুশীলন করতে।

অথচ টি-টোয়েন্টির এই টানাহেঁচড়ার আগে তিনি জাতীয় লিগ খেলছিলেন। সেটি খেলে ও পরে চট্টগ্রামের অনুশীলন ক্যাম্পে থেকে অনায়াসেই টেস্টের প্রস্তুতি তিনি নিতে পারতেন। মাঝের সময়টায় শুধু তার মনে সংশয় আরও বাড়িয়ে দেওয়া হলো, আত্মবিশ্বাস আরও নড়বড়ে করে দেওয়া হলো।

টিম ম্যানেজমেন্টের জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই।

প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ার পালা শেষ নয় এখানেই। শেষ ম্যাচের আগে যাকে দলে আনা হলো, সেই পারভেজকে একাদশে রাখাই হলো না। তাহলে কেন এই জরুরী তলব!

পারভেজের তো তবু এটি জাতীয় দলের স্কোয়াডে প্রথম ম্যাচ। ইয়াসির আলি চৌধুরির কততম ম্যাচ, সেই হিসাব হয়তো নিজেও করতে পারবেন না। ২০১৯ সাল থেকে ওয়ানডে ও টেস্ট স্কোয়াডে তার জায়গা হয়েছে নানা সময়ে। কিন্তু অভিষেকের সৌভাগ্য হয়নি। এবার ডাক পান টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে। এখানেও স্বাদ পেলেন না ম্যাচ খেলার। অথচ তার ঘরোয়া টি-টোয়েন্টির রেকর্ড বলে দিচ্ছে, নতুন দিনের পথে তার ওপর বিনিয়োগ করা যায় ভরসা নিয়েই।

এই দর্শকেরা হতাশ হচ্ছে বারবার।

নিজের ক্যারিয়ারে যিনি নতুন দিন এনেছেন অনেক ঘাম ঝরিয়ে, সেই তাসকিন আহমেদ শেষ টি-টোয়েন্টিতে হাতে চোট পেয়ে ছিটকে গেলেন প্রথম ম্যাচ থেকে। নিয়ম রক্ষার এই ম্যাচে তাকে বিশ্রাম দেওয়া যেত অনায়াসেই। এই বছর তিনি টানা খেলার মধ্যে আছেন। এই ম্যাচে বিরতি দিয়ে টেস্ট সিরিজের জন্য তাকে চনমনে করে তোলা যেত। অনেক আক্ষেপ ও প্রতীক্ষার পর অবশেষে যে চেহারায় পাওয়া গেছে তাসকিনকে, সেরাটা দীর্ঘসময় পেতে তো তার ওয়ার্কলোড সামলানো উচিত যত্ন নিয়ে।

তাসকিনের জায়গায় কামরুল ইসলাম রাব্বিকে বাজিয়েও দেখা যেত। গত দুটি ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে এই পেসারের পারফরম্যান্স দুর্দান্ত।

কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টের পদক্ষেপে এসব ভাবনার প্রতিফলনই পড়েনি একটুও।

স্কিলের উন্নতির জায়গায়ও ব্যর্থতা স্পষ্ট প্রতিটি ম্যাচেই। অন্যান্য সংস্করণের চেয়ে টি-টোয়েন্টিতে নিজেকে বদলাতে হয় অনেক বেশি দ্রুত। ব্যাটসম্যানের স্কোরিং অপশনগুলো বন্ধ করে দিতে চায় প্রতিপক্ষ, তাই বিকল্প প্রস্তুত রাখতে হয় সবসময়। বোলারদের শক্তির জায়গাগুলোকে দুর্বলতা বানিয়ে ফেলে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানরা। তাই তৈরি রাখতে হয় নিত্যনতুন অস্ত্র। দুর্দান্ত সব ক্যাচ-রান আউট করে আর রান বাঁচিয়ে তৈরি করতে হয় জয়ের ক্ষেত্র। এই সবকিছুতেই বাংলাদেশ এখনও টি-টোয়েন্টির মান্ধাতার আমলে।

প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ও তার কোচিং স্টাফ পারেনি স্কিলের দৃশ্যমান উন্নতি করাতে। কোচ-অধিনায়ক-নির্বাচক ও অন্যান্যদের নিয়ে গড়া টিম ম্যানেজমেন্ট পারেনি সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ রাখতে। তাই ক্রিকেটার বদল হচ্ছে, অমুকের জায়গায় তমুক আসছে। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের রঙ-রূপ বদলাচ্ছে না। দাঁড়ায়নি নিজেদের কোনো ঘরানা। অনাকর্ষনীয় এই ক্রিকেট শুধু উত্তেজনাহীনই নয়, অকার্যকর হিসেবেও প্রমাণিত এখন।

বোর্ডের ব্যর্থতা, ঘরোয়া ক্রিকেটের বাজে উইকেট, টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের স্বল্পতা, এসব তো বরাবরের মতোই বড় বাধা। তবে সীমিত যে সম্পদ আছে, তাদের যথাযথ কাজে না লাগানো এবং আরও নষ্ট করার দায়ে টিম ম্যানেজমেন্টকে কাঠগড়ায় তোলাই যায়।

টিম ম্যানেজমেন্টকে গোছাতে না পারলে কিংবা তারা নিজেদের গুছিয়ে নিতে না পারলে, টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশ রয়ে যাবে তিমিরেই। অথচ আরেকটি বিশ্বকাপের আর এক বছরও নেই!