বিশ্রাম নয়, ‘বাদ’ ধরে নিয়েই টি-টোয়েন্টিতে ফেরার চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন মুশফিক

প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন জোর দিয়েই বলেছেন ‘বিশ্রাম।’ তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের দলে না থাকাকে বাদ হিসেবেই নিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। এই লুকোচুরি অবশ্য ভালো লাগেনি তার। কোচ-নির্বাচকদের কাছে তিনি চান পরিষ্কার বার্তা। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার কথা বললেন তার দলে না থাকার নানা দিক, নিজের ও দলের হতাশার বিশ্বকাপ, তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ ও আরও অনেক কিছু নিয়ে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Nov 2021, 03:52 PM
Updated : 17 Nov 2021, 03:53 PM

টি-টোয়েন্টি দলে আপনার না থাকাকে কীভাবে নিচ্ছেন? নির্বাচকদের ব্যাখ্যা কীভাবে দেখছেন?

মুশফিকুর রহিম: স্বাভাবিক…ক্রিকেটার হিসেবে উত্থান-পতন থাকবেই ক্যারিয়ারে। আর এটাই তো প্রথমবার নয়। হ্যাঁ, অনেক দিন পর বাদ পড়লাম। আমার কাছে নরম্যালই মনে হয়েছে। বিশ্বকাপে নিজের কাছে আমার যে প্রত্যাশা ছিল, সত্যি বলতে সে অনুযায়ী খেলতে পারিনি। এই কারণেই যদি বাদ দিয়ে থাকে, ক্রিকেটার হিসেবে আমি ভালোভাবেই নিচ্ছি।

দিনশেষে আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। সামনে যেহেতু টেস্ট সিরিজ আছে, সেটার প্রস্তুতি নেওয়ার বড় ব্যাপার ছিল আমার জন্য। টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেললে হয়তো মাত্র দুদিন পেতাম। অনেক দিন পর বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেট খেলব। এখন ১০-১২ দিন পাচ্ছি টেস্টের আগে। উপযুক্ত প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ থাকছে।

আপনি নিজে থেকেই বিশ্রাম চেয়েছিলেন বলে একটি গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল…

মুশফিক: নাহ, এখনও আমি ওই পর্যায়ে যাইনি যে, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কাউকে বলতে হবে। যদি কখনও মনে করি… কোভিড পরিস্থিতিতে টানা ৫-৬ মাস খেলা খুব কঠিন, শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে, বিশেষ করে বায়ো-বাবলে থেকে। এখনও ওই পর্যায়ে যাইনি আমি।

তবে যেহেতু হতাশাজনক বিশ্বকাপ ছিল, শুধু আমার নিজের জন্য নয়, দল হিসেবেও, সেদিক থেকে মুখিয়ে ছিলাম যে, এই তিনটি টি-টোয়েন্টিতে সুযোগ পেলে চেষ্টা করতাম ভুল শুধরে নেওয়ার এবং ভালো করার। বিশ্বকাপের আগে ঘরের মাঠে বাংলাদেশ যে দুটি সিরিজ জিতেছে, সেই মোমেন্টাম যেন আবার ফিরিয়ে আনতে পারি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি হয়নি। তবে দলের সবার জন্য শুভ কামনা। সবারই সামর্থ্য আছে। তাদের খেলা দেখার জন্য মুখিয়ে আছি।

এই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দিয়ে বিচার করাকে কীভাবে দেখছেন?

মুশফিক: বিশ্বকাপ অবশ্যই অনেক বড় ইভেন্ট। বড় ইভেন্টে কেউ ভালো করে, কেউ খারাপ, কোনো দল ভালো করবে, কোনোটি খারাপ… ভারতের মতো দল সেমি-ফাইনাল খেলবে না, কেউ ভাবতেও পারেনি। সত্যি বলতে, আমি যতগুলি বিশ্বকাপ খেলেছি এবারই সবচেয়ে ভালো খেলেছি। তবে যে প্রত্যাশা ছিল, সেটির ধারেকাছেও হয়নি। যে কোনো সময় অনেক ক্রিকেটার এসব কারণে বাদ পড়েন। আমি তাদের মধ্যে একজন। এই তো।

সমস্যা নেই, আমার কাছে এটা নেতিবাচক মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য যেভাবে চেষ্টা করেছি সবসময়, এখনও সেভাবেই করছি। অনেক সময় পারফরম্যান্স হয়, অনেক সময় হয় না। কিন্তু এটাই দুনিয়ার শেষ নয়। আমার কাছে মনে হয়, সামনে সুযোগ এলে আমি চেষ্টা করব।

আমি কখনেই নিজেকে বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য বা সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন মনে করি না। সবসময় নিজেকে প্রস্তুত রাখি যেন পরের সিরিজটা খেলতে পারি এবং দলের জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারি। গত ১৫-১৬ বছরে এভাবেই নিজেকে প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করি।

নির্বাচকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই দল দিয়ে নতুন পথচলা শুরু। আপনি এখানে কোনো বার্তা পাচ্ছেন?

মুশফিক: আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছি। টেস্ট-ওয়ানডের তুলনায় টি-টোয়েন্টিতে আমি নিজের প্রতি সুবিচার করতে পারিনি। মাঝেমধ্যে কয়েকটা ইনিংস বা সিরিজ হয়তো ভালো খেলেছি। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে আরও অনেক ধারাবাহিক হওয়ার জায়গা আমার আছে। এটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।

আমি পারফর্ম করতে না পারলে অন্য কেউ আসবে, এটা স্বাভাবিক। যদি পারফরম্যান্সই কারণ হয় (বাইরে রাখার), তাহলে মোর দ্যান ওয়েলকাম।

সামনে বিপিএল আছে, এরপর আরও খেলা আছে, আগামী বছর বিশ্বকাপ… আমি জোর দিয়েই চেষ্টা করব টি-টোয়েন্টি সেট আপে আবার ফিরতে। নির্বাচক-টিম ম্যানেজমেন্টের চিন্তা তো… আমার কাছে কেউ কিছু বলেনি এখনও। আমার ভাবনায় থাকবে পারফরম্যান্স দিয়েই দলে ফেরা।

নির্বাচকরা বা টিম ম্যানেজমেন্ট কি কথা বলেছে আপনার সঙ্গে এটা নিয়ে?

মুশফিক: নাহ, সেভাবে কথা হয়নি। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই সিরিজে আমি অ্যাভেইলঅ্যাবল কিনা। আমি বলেছি, ‘অবশ্যই।’ দলে নেওয়া বা না নেওয়া তো আমার হাতে নেই। তারা মনে করেছেন, টি-টোয়েন্টি দলে আমার হয়তো ওরকম প্রয়োজন নেই। এটা অ্যাবসলিউটলি ফাইন।

পরে নান্নু ভাই (প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন) বলেছেন যে, তারা এই সিরিজে আমাকে বিশ্রাম দিচ্ছেন, কারণ সামনে অনেক খেলা আছে টেস্টে।

তবে বাংলাদেশে এমন কোনো ক্রিকেটার সম্ভবত নেই যে, বলতে পারে, পরপর চারটি টেস্ট খেলতে পারবেই। আমি তাই জানি না, কী যুক্তিতে (এই বিশ্রাম)…।

অবশ্যই যে কোনো ক্রিকেটারের জন্য প্রস্তুতি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। হয়তো তারা ওভাবেই চিন্তা করেছেন। গতবার টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে যেহেতু দল অনেক খারাপ করেছে, এবার হয়তো তারা চ্যাম্পিয়ন হতে চায় বা এক-দুইয়ে থাকার জন্য লড়াই করতে চায়। হয়তো এজন্য বাদ দিয়েছে।

আপনি নিজে বারবার বলছেন আপনাকে ‘বাদ’ দিয়েছে। নির্বাচকরা বলেছেন, ‘বিশ্রাম।’ পরিষ্কার একটি বার্তা কি দেওয়া উচিত নয়?

মুশফিক: অবশ্যই, সত্যিকারের সৎ ও সত্যি ভাবনাটাই বলা উচিত। দলের আগে, দেশের আগে তো কেউ না। সেখানে আমি তো নগণ্যতম একজন সদস্য।

পারফরম্যান্সে উঠা-নামা থাকবে এবং একজন ক্রিকেটারকে অবশ্যই পারফরম্যান্স ও ফিটনেস দিয়ে বিচার করবেন। সেটা পরিস্কার করে বললেই হতো যে, ‘আমরা অন্যরকম চিন্তা করছি, এই সিরিজে না, সামনে যদি পারফর্ম করে আসতে পারো…”, যেটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আর কী।

এই ব্যাপারগুলো পরিষ্কার করে বললে আমার কাছেও অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করত যে, তারা আমাকে এতটুকু হলেও সম্মান করেছে। যদি সামনের চারটি টেস্ট ম্যাচের (পাকিস্তান ও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে) কথাই সত্যি ভেবে থাকে, তাহলে বিশ্বকাপের আগেও তাহলে বলতে পারত যে, ‘সামনে এই টেস্টগুলো আছে, টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকে তুমি বিরতি নিতে পারো’, তাহলে হয়তো আরও উপযুক্ত হতো, মানসিকভাবে তৈরি থাকতাম। আমি নিজেও হয়তো সেভাবে পরিকল্পনা করতাম যে বিশ্বকাপ থেকে ফিরে জাতীয় লিগে একটি-দুটি ম্যাচ খেলতাম। আমাকে এত দেরিতে জানিয়েছে যে, (টেস্টের) প্রস্তুতির সেরকম কিছু পাচ্ছি না।

একটু খোলামেলা কথা বললে ভালো হয়। তারা যদি আমাকে বলতেন যে ‘আমরা এরকম চিন্তা করছি’, তাহলে আরেকটু প্রস্তুতি নিতে পারতাম (টেস্টের জন্য)। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে অ্যাভেইলঅ্যাবল কিনা, এরপর হুট করে … (বিশ্রাম)। তখনও যদি তারা বলতেন যে বাইরে রাখার চিন্তা করছে, তাহলে অন্যভাবে পরিকল্পনা করতে পারতাম। কিন্তু সবকিছু শেষে হুট করেই বলা হলো, প্রস্তুতি নেওয়া এখন কঠিন।

এখন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে ইতিবাচকভাবেই নিতে হবে এসব এবং নিচ্ছি। টি-টোয়েন্টি আমার জন্য এখন অন্যরকম চ্যালেঞ্জ এবং এখানে ফিরে আসতে চাই। আপাতত টেস্ট সিরিজটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সেরা ফরম্যাট এটি। সেটার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছি।

নির্বাচকদের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বললেন। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগেও যোগাযোগের ঘাটতির কারণে আপনি খেলতে পারেননি। অনেক সময়ই শোনা যায় যে, আপনাকে তারা অনেক কিছু বলতে সঙ্কোচ করেন…

মুশফিক: আমি কি খাঁচার বাঘ, আমাকে ছেড়ে দিয়েছে, এখন আমি তাদেরকে বা অন্যদেরকে খেয়ে ফেলব?

আমার অভিষেক হয়েছে সুমন ভাইয়ের (নির্বাচক ও সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার) অধিনায়কত্বে। এখন উনি যদি বলতে না পারেন ছোট ভাইকে কোনো কথা… শুধু উনি কেন, আকরাম ভাই, নান্নু ভাই, উনারা বিকেএসপিতে খেলতে গিয়েছিলেন, আমরা বল থ্রো করেছিলাম, তখন আমাদের জন্য স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল। এখন তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারছি। এখানে যদি উনারা কথা বলতে না পারেন আমার সঙ্গে… আমি তো সবসময়ই ওয়েলকাম করি।

কিছু ক্রিকেটার আছে, যাদেরকে অন্যভাবে বলতে হয়। সেটা তো তাদের জানতে হবে। আমারও বুঝতে হবে।

অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগে নান্নু ভাই ফোন করে আমার বাবা-মায়ের খোঁজখবর নিয়েছে। আমি বলেছিলাম যে উন্নতি হচ্ছে অবস্থার। এর কদিন পর আমি নিজেই নান্নু ভাইকে ফোন করে বলেছি যে, মা-বাবার অবস্থা ভালো এখন, আমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি (অস্ট্রেলিয়া সিরিজের জন্য)। তার পরও উনারা আমাকে কিছু বলতে না পারলে আমার দিক থেকে কিছু করার নেই।

আমাকে ছাড়াই তো অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জিতেছে। তারা হয়তো ভেবেছেন যে আমাকে দলে আর দরকারও নেই।

আপনাকে নির্বাচকরা যখন বললেন যে বিশ্রাম দিচ্ছে, তখন কি জানিয়েছে, এটা কাদের সিদ্ধান্ত? মানে নির্বাচকদের নাকি টিম ম্যানেজমেন্টের?

মুশফিক: আমাকে বলেছে, নির্বাচক কমিটি, ম্যানেজমেন্ট, হেড কোচ ও টিম ডিরেক্টর, সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে রাখা হবে না আমাকে।

কোচিং স্টাফের সঙ্গেও কি সেই যোগাযোগে ঘাটতি আছে? আপনি কতটা কমফরটেবল এই কোচিং স্টাফের সঙ্গে?

মুশফিক: আমার জন্য সত্যি বলতে, একটু চ্যালেঞ্জিংই। আগেও অনেকবার নানা ঘটনা হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, কমিউনিকেশন গ্যাপের সমস্যা আছে। জানি না আমি বাঘ নাকি সিংহ! খোলামেলাভাবে সবকিছু বললে, আমার জন্য ভালো হয়, দলের জন্য ভালো হয়। সবার জন্যই ভালো।

এমন তো নয়, এটা আমার দল! এটা দল ও দেশের ব্যাপার। টেবিলে আলোচনায় বসলে কথা হবে, তর্ক-বিতর্ক হবে যুক্তি দিয়ে। এটাই তো উচিত।

একটা উদাহরণ দেই। ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে চার নম্বরে আমার রেকর্ড দুর্দান্ত ছিল। হুট করে একদিন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বললেন, ‘বিশ্বকাপে তোমাকে ছয় নম্বরে খেলতে হবে।’ আমি তখন মেনে নিতে পারিনি শুরুতে। বললাম, ‘তুমি আমার গত তিন-চার বছরের পারফরম্যান্স জানো চার নম্বরে?’ তিনি বললেন, সব জানেন।

তিনি তখন আমাকে খুব ভালোভাবে সব বুঝিয়ে বললেন যে কেন ছয়ে আমাকে দরকার। যুক্তি, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তার পর আমরা একমত হয়েছি। নিজেই পরে বলেছি, ‘এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত। দলের জন্য খুশি মনেই করব।’ আমি খেললাম ছয়ে। ভালো খেললাম। চারে রিয়াদ ভাই খেললেন, ভালো করলেন। দলের লাভ হলো।

এভাবেই তো হওয়া উচিত আলোচনা। এখন কেউ যদি বলে, ‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, দলের দরকার।’ আর কিছু নেই। ওই ক্রিকেটার কিছু জানে না, কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড জানা নেই, কারণ জানে না, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানে না, তাহলে তো তা অন্যরকম হয়ে গেল। এসব আরেকটু পরিস্কার করে বলা দরকার।

নিউ জিল্যান্ড সিরিজের আগে যখন আপনাকে ও সোহানকে দুই ম্যাচ করে কিপিং করানোর কথা বললেন কোচ, তখনও কি যোগাযোগের ঘাটতি ছিল?

মুশফিক: সেটাই বললাম যে, আমাকে বললেই তো হয়! আমি তো জানি যে, আমি এখন শেষের দিকে। আমি তো আরও ১৫-২০ বছর খেলব না! যে কয়টা দিনই খেলি, আমার একটা প্রস্তুতি ছিল যে যখন ছাড়ব, আমার জায়গায় যে আসবে, সে যেন আমার চেয়েও আরও পোক্ত ও প্রস্তুত হয়ে আসে। আমি নিজেকে এখন সবসময় শুধু ক্রিকেটারই ভাবি না, মনে করি যে, এই দলে মেন্টরও হতে পারি। আমি তাই নিশ্চিত করে চাই, যেখানে আমি শেষ করব, সেখান থেকে যেন ওরা শুরু করতে পারে। আমি মনে করি, এটা আমার দায়িত্ব।

সোহানের কথা বলি… দলের পরিবেশ যদি এমন অন্যরকম হয়ে যায়, তখন ওই ছেলেটা আমার দিকে তাকাতে সঙ্কোচ করছে, আমারও ওর দিকে তাকাতে খারাপ লাগছে। এটাই স্বাভাবিক। এজন্যই বলছি যে, এই ব্যাপারগুলি আরেকটু মসৃণভাবে করতে পারত। আমাকে বললেই হতো।

আমার এমনিতেই পরিকল্পনা ছিল, বিশ্বকাপের পর আমি সহজেই ছেড়ে দিতে পারি (কিপিং)। আমার কাছেই মনে হয়, আমার চেয়ে ওর (সোহান) সামর্থ্য বেশি এখানে। আমিই এটা করতে পারতাম ও নিজের ওর হাতে তুলে দিতে পারতাম।

কেন সেটা হলো না, কেন অন্যরকম হলো, এটা তো আসলে জানি না। নতুন কিছু না অবশ্য। মাশরাফি-সাকিব-তামিম-রিয়াদ বলেন, এটা নতুন কিছু না।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল এবার অনেক অভিজ্ঞ ছিল। তার পরও ব্যর্থতার কারণ কি?

মুশফিক: বিশ্বকাপের আগেও আমরা তিনটি সিরিজ জিতেছি। যদিও উইকেটের কথা বলা হচ্ছে যে এখানে ভিন্ন উইকেট ছিল। কিন্তু সেই উইকেটে তো প্রতিপক্ষও দলও খেলেছে! বিশ্বকাপের আগে তাই প্রস্তুতি যেরকম দরকার, সেরকমই ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপে নির্দিষ্ট দিনে আমরা ডেলিভার করতে পারিনি। সুনির্দিষ্ট কারও দায় নেই। আমার কারণেও… দু-একটি ম্যাচে আমি আরেকটু ভালো খেললে দল বের হয়ে আসতে পারত।

স্কটল্যান্ডের কাছে হারটা অবশ্যই অনেক বাজে ছিল। তবে এরকম কিন্তু নয় যে আমরা টি-টোয়েন্টিতে অনেক ফেভারিট বা ফাইনাল খেলব। ভালো খেলতে পারলে হয়তো সুযোগ থাকত।

এই সংস্করণে টানা ভালো খেলতে হলে আমাদের ভালো বা স্পোর্টিং উইকেটে খেলতে হবে। সেখানে অভ্যস্ত হতে পারলে আরেকটু ভালো হতে পারত আমাদের ফল।

ব্যর্থতা কি শুধু ক্রিকেটীয় কারণেই? নাকি অন্যান্য কিছুও ছিল? মাঠের বাইরে অনেক কিছু হয়েছে, বোর্ড প্রেসিডেন্ট ও আপনাদের অনেক কথা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। এসবের প্রভাবও কি পারফরম্যান্সে পড়েছে?

মুশফিক: বাইরে কথা তো হয়েই। আমার বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের অনেকের কাছ থেকে জেনেছি যে, অনেক কথা হয়েছে। আমরা যেসব কথা বলেছি, সেগুলোর অনেক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আমরা আসলে ওই সময়টায় এত চাপের মধ্যে থাকি, বিশ্বকাপ এত বড় ইভেন্ট, সেখানে বাইরে কে কী বলল, সেসব দেখে বা শুনে কিংবা ওসব ধরে রেখে পাল্টা প্রতিক্রয়া দেখানো, ওসব করা কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনও করিনি।

আমার কথায় যদি ফিরে আসেন, আসলে আমি ইঙ্গিত দিতে চেয়েছি, মানুষ হিসেবে শুধু আমি নই বা যারা বলেছেন, তারাই নয়, জাতি হিসেবে যদি আমরা সবাই নিজেদের একটু যদি আয়নার সামনে দেখতে পারি, সেটা মানুষ হিসেবেই উচিত। আজকে আমি খারাপ খেলছি দেখে আমাকে বলবেন, কালকে ভালো খেললে তালি দেবেন, এটা এসবের অংশ নয়। সেদিক থেকে বলেছি। এখন কেউ যদি এটা ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে থাকেন বা অন্যভাবে বলে থাকেন, তাহলে আমি মনে করি… আমি যেহেতু ওভাবে বলিনি, সেক্ষেত্রে কে কী মনে করল, এটায় আমার কিছু করার নেই।

আমরা খারাপ করায় মিডিয়া বা দেশের মানুষ, সবারই খারাপ লেগেছে। তবে আপনারাও কিন্তু একটা অংশ। সবারই ব্যর্থতার অংশ এটি। এই উপলব্ধি থাকা উচিত। আমাদের যতটা খারাপ লেগেছে, অন্যদের হয়তো অতটা থাকবে না। তবে এটা সামগ্রিক একটা ব্যর্থতা।

আমার কাছে মনে হয়, ব্যর্থতার জায়গাটায় যদি আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারি, পরস্পরের পাশে থাকি, তাহলে সময়টা দ্রুত পার হবে।

খেলায় কেউ হারতেই পারে। কিন্তু বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে খুব উজ্জীবিত মনে হয়নি। শরীরী ভাষা খুব ভালো মনে হয়নি বাইরে থেকে দেখে। ড্রেসিং রুমের আবহ কি ঠিক আছে?

মুশফিক: আসলে ক্লোজ ম্যাচ যদি হারতে হয়, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জেতা উচিত ছিল, কাছে গিয়ে জিততে না পারলে যে কোনো ড্রেসিং রুমের একটু খারাপ অবস্থা থাকে। ক্রিকেটারদের সাহস কমে যায়। বিশ্বাসে ঘাটতি থাকে। সবার মধ্যে নার্ভাসনেস থাকে।

আমরাও জানি, টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ এখনও ভারত-পাকিস্তান-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলির কাতারে যায়নি। এটা তো স্রেফ বললেই হবে না। আমাদের দরকার ছিল মোমেন্টাম। সুপার টুয়েলভে যদি শুরুতে জিতে যেতাম, তাহলে চিত্র হয়তো ভিন্ন হতো। সেখানে আমরা যখন ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি, বিশেষ করে আমি, সাকিব ও রিয়াদ ভাই, আমরা চেষ্টা করেও যখন পারিনি, তখন একটা সংশয় ঢুকে যায় যে, আমাদের দিয়ে হয়তো হচ্ছে না।

আমাদের অ্যাপ্রোচ বলেন বা অ্যাপ্লিকেশন, ওই জায়গাটায় ঘাটতি ছিল। নার্ভাসনেস ও বিশ্বাসের ঘাটতি থাকলে টি-টোয়েন্টিতে হয় না। মাইন্ড সেট আপ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আমাদের ঘাটতি ছিল।

যদি আমরা আরেকটু সাপোর্ট পাই, আরেকটু ফ্রিডম পাই, দল হিসেবে বা ব্যক্তিগতভাবে যদি রোল সবাইকে পরিষ্কার করা হয়, তাহলে সবাই আরেকটু ফ্রি হয়ে ও দায়িত্ব নিয়ে খেলতে পারবে।

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের উন্নতির পথ কি?

মুশফিক: উইকেট ভালো করতে হবে। মিরপুরের উইকেটে ঘরোয়া ক্রিকেটেও খেলা কঠিন। শুধু আমাদের জন্য নয়, বাইরের যারা আসেন ব্যাটসম্যানরা, সবার জন্যই এখানে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলা কঠিন। বিপিএল ও অন্যান্য সময় দেখেছেন। তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেও জানতে পারবেন। চট্টগ্রাম-সিলেটে খেলতে বেশি পছন্দ করে তারা।

উইকেট যদি আরেকটু স্পোর্টিং হয়, বোলারদের জন্যও কিন্তু চ্যালেঞ্জিং হয়। মিরপুরে স্পিনারদের জন্য কাজ সহজ। বিশ্বকাপে বা অন্যান্য দেশে ওরকম টার্ন থাকে না বা বল উঠা-নামা হয় না। মিরপুরেও সেরকম উইকেট হলে বোলাররা চ্যালেঞ্জর মুখে পড়বে, নতুন স্কিল শিখবে সারভাইভ করার জন্য।

নেটে ভালো ব্যাটিং করে সেই আত্মবিশ্বাস মাঠে নিয়ে যেতে হয়। আমরা তা পারি না। টি-টোয়েন্টির ব্যাটিংয়ের সেইরকম উইকেট ও পরিবেশ না পেলে ম্যাচে তা করে দেখানো কঠিন। একটা সেট-আপ করা বা রেঞ্জ হিটিং করতে হলে তো উইকেটে সেই সহায়তা থাকতে হবে। উইকেট স্পোর্টিং হলে সেখানে খেলে সবাই অভ্যস্ত হবে, ব্যাটসম্যানদের শটের রেঞ্জ বাড়বে, সেটা ম্যাচে নিয়ে আসতে পারলে এবং দুই-একবার ক্লিক করলে, সেই বিশ্বাস ও ফ্রিডম নিয়ে খেলতে পারবে, তার পর আস্তে আস্তে উন্নতি হবে।

২০১২ এশিয়া কাপের আগে যে বিপিএল হয়েছিল, ওই সময়ের উইকেট ছিল সেরা। সেখানে খেলার পর এশিয়া কাপে রানার্স আপ হই। ম্যাচগুলিতে ধারাবাহিক ছিলাম আমরা, ভারতের বিপক্ষে ২৯০ তাড়া করলাম। এটা সম্ভব হয়েছে কেন? শেষ ২০ ওভারে আমাদের ১৬০ রানের বেশি দরকার ছিল। তখনও আমাদের বিশ্বাস ছিল, কারণ কিছুদিন আগেই বিপিএলে আমরা ২০ ওভারে ১৬০ করেছি। সেই বিশ্বাস থেকেই ওই রান তাড়া করেছি। উইকেটের প্রভাব তাই অনেক বড়।

আরেকটা ব্যাপার, টি-টোয়েন্টিতে রোলগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিকেটারদের যা ভূমিকা, তা যদি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়, তাহলে খুব ভালো হয়। আমার মতো ব্যাটসম্যান, যারা হয়তো পাওয়ার হিটিং বা রেঞ্জ হিটিং পারি না, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, রানই করতে পারি না। অন্য পথ আছে আমার রান করার। পাওয়ার হিটিংই একমাত্র পথ হলে বাংলাদেশ কখনোই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতত না (জিতেছে ২০১৮ সালে)।

টি-টোয়েন্টির অন্য স্কিলও আছে। আমাদের দেশে হয়তো ওসবের কদর হয় না অতটা। কিন্তু অনেক স্কিল আছে।

সেরকমই একটি শট তো স্কুপ। কিন্তু আপনার এই শট নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। অনেক সময়ই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই শটে আউট হয়েছেন…

মুশফিক:  গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আউট হলে… আউটের অনেক ধরন থাকতে পারে। আমার এটা ‘গো টু’ শটগুলির একটি। এটা বলতে পারেন যে, ওই সময় হয়তো অমন খেলা উচিত হয়নি। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, নিজেদের ‘গো টু’ শট যদি খেলতে হয়, আমি চেষ্টা করলে আমারই সুযোগ বেশি থাকবে। আমার যদি ‘গো টু’ শট থাকত জস বাটলারের মতো ডাউন দা উইকেট গিয়ে সোজা ছক্কা মারা, তাহলে আমি সেটাই চেষ্টা করতাম।

বাটলের মতো ব্যাটসম্যান যদি সেমিফাইনালে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে আউট হয়, তাহলে তো তাকে দলে রাখাই উচিত না! সে চাইলেই তো মিচেল স্টার্কের মতো বোলারকে ১০০ মিটার লম্বা ছক্কা মারতে পারে। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল একবার শামসির বলে বোল্ড হলো রিভার্স খেলে, তার পর আবার পাকিস্তানের বিপক্ষে ডিপে ফিল্ডার দেখার পরও একই শট খেলতে গিয়ে আউট হলো। ওর তো দরকার ছিল না!

এটা একটা সংস্কৃতিরও ব্যাপার। কেউ ওই শটে অনেক রান করবে, আবার অনেক আউটও হবে। তার মানে এই নয় যে, ওই শট খেলা যাবে না বা আউট হলে পরেরবার খেলা যাবে না। ড্রেসিং রুমের ভেতরে-বাইরের সংস্কৃতি এখানে বড় ব্যাপার। ওই নিজেদের ‘গো টু’ শটে তাদের আস্থা আছে। লেগে গেলে ভালো, না লাগলেও সমস্যা নেই। কারণ, সে জানে, অনুশীলনে সে এটা হাজার-লাখ-কোটিবার খেলেছে স্রেফ ম্যাচে করার জন্যই।

এত আলোচনার পর এখন কি উইকেট পরিবর্তন হবে বলে মনে হয়?

মুশফিক: আমরা তো চাই। কিন্তু… এই যে দেখেন, জাতীয় লিগে প্রথম কয়েকটা রাউন্ডে কত রান হয়েছে? দেড় দিন, দুই দিনে চারটা ইনিংস শেষ। আমি তো খেলা দেখি লাইভ ইউটিউবে। আর কি বলব!