রোমাঞ্চকর জয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ‘প্রথম’

চার ওভারে নেই কোনো উইকেট। তবুও তিনিই নায়ক, মুস্তাফিজুর রহমান। তার অসাধারণ ওভারগুলোই গড়ে দিল ব্যবধান। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের কাঁটা ঘুরিয়ে দিলেন বাংলাদেশের দিকে। নখকামড়ানো উত্তেজনার ম্যাচে জিতে দল পেল অনির্বচনীয় স্বাদ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়!

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2021, 06:01 PM
Updated : 6 August 2021, 06:22 PM

মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শুক্রবার তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে ১০ রানে জিতেছে বাংলাদেশ। স্বাগতিকদের ১২৭ রান তাড়ায় অস্ট্রেলিয়া থামে ১১৭ রানে।

চার দিন আগে যা হয়তো ছিল কল্পনার বাইরে, সেটিই এখন বাস্তব। বাংলাদেশের ক্রিকেট গল্পগাঁথার অংশ। টানা তিন জয়ে ৫ ম্যাচের সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে মাহমুদউল্লাহর দল।   

তিন ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের কঠিন পরীক্ষা নিয়েছেন মুস্তাফিজ। এই ম্যাচে যেন তিনি ছিলেন রীতিমত দুর্বোধ্য। ৪ ওভারে রান দেন কেবল ৯, নেই কোনো বাউন্ডারি।

বাঁহাতি পেসারের ১৫ ডট বলের পাঁচটিই আসে ম্যাচের ১৯তম ওভারে। যখন শেষ ২ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল ২৩ রান। উইকেটে ছিলেন অ্যালেক্স কেয়ারি ও ড্যানিয়েল ক্রিস্টিয়ানের মতো দুই বিস্ফোরক ব্যাটসম্যান। সেই সময়ে কেবল ১ রান দিয়ে ম্যাচ বাংলাদেশের মুঠোয় নিয়ে আসেন মুস্তাফিজ।

আগের তিন ম্যাচের মতোই উইকেট ছিল মন্থর, বোলারদের জন্য ছিল প্রবল সুবিধা। দলের বিস্ফোরক ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মাহমুদউল্লাহও একজন। তবুও দলের প্রয়োজনে গুটিয়ে রাখলেন নিজেকে। খেললেন না অনেক শট। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের মন্থরতম ফিফটিতে দলকে ১২৭ পর্যন্ত নিয়ে গেলেন অধিনায়ক (৫৩ বলে ৫২)।

বল হাতে মুস্তাফিজ পরের ধাপে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিলেও দলকে লড়াকু পুঁজি এনে দেওয়া মাহমুদউল্লাহই ম্যাচ সেরা।

ইনিংসের শেষ ৩ বলে মাহমুদউল্লাহ, মুস্তাফিজ ও মেহেদি হাসানকে ফিরিয়ে প্রথম বোলার হিসেবে অভিষেকে হ্যাটট্রিকের কীর্তি গড়েন ন্যাথান এলিস।

বেন ম্যাকডারমট ও মিচেল মার্শের চমৎকার জুটিতে একটা সময় পর্যন্ত ভালোভাবেই ম্যাচে ছিল অস্ট্রেলিয়া। এই জুটি ভাঙার পর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে সব সংস্করণ মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়ের আনন্দে ভাসে বাংলাদেশ।

জয়রথে থাকলেও উদ্বোধনী জুটি নিয়ে বাংলাদেশের দুর্ভাবনা কাটেনি। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে ৩ রানের ভেতর বিদায় নেন দুই ওপেনার। জশ হেইজেলউডের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন মোহাম্মদ নাঈম শেখ। অ্যাডাম জ্যাম্পার বলে এলবিডব্লিউ হয়ে শেষ হয় সৌম্য সরকারের ভোগান্তি।

সাকিব আল হাসান খেলছিলেন নিজের মতো করেই। আগের দুই ম্যাচে রান না পাওয়া মাহমুদউল্লাহ ছিলেন সাবধানী। অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যানের জুটিতে শুরুর ধাক্কা সামাল দেয় বাংলাদেশ।

থিতু হয়ে গিয়েছিলেন সাকিব। বাড়াতে শুরু করেছিলেন রানের গতি। এমন সময়ে জ্যাম্পার বলে ছক্কার চেষ্টায় ক্যাচ দিয়ে থামেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। ভাঙে ৩৬ বল স্থায়ী ৪৪ রানের জুটি।

আগের ম্যাচের মতো এবারও সাকিব করেন ২৬।

আগের ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক আফিফ হোসেন শুরু থেকেই ছিলেন আক্রমণাত্মক। ক্রিজে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর অ্যাশটন অ্যাগারকে মারেন ছক্কা। অধিনায়কের সঙ্গে জমে উঠছিল জুটি। বাড়ছিল রানের গতি।

ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টায় কেয়ারির সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট হয়ে ফিরেন আফিফ। এরপর প্রায় একার চেষ্টায় দলকে লড়াই করার মতো পুঁজি এনে দেন মাহমুদউল্লাহ।

দ্রুত ফিরেন শামীম হোসেন। জ্যাম্পাকে চমৎকার এক ছক্কায় দারুণ কিছুর আভাস দিলেও নুরুল হাসান সোহানকে থামতে হয় আরেকটি সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট হয়ে।

শেষের দিকে রানের গতি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেন মাহমুদউল্লাহ। শেষ ওভারে ন্যাথান এলিসকে চার মেরে ৫২ বলে স্পর্শ করেন ফিফটি। টি-টোয়েন্টিতে যা বাংলাদেশের মন্থরতম ফিফটি। আগেরটি ছিল ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বুলাওয়ায়োতে শামসুর রহমানের ৪৭ বলের ফিফটি।

পরের তিন বলে তিন উইকেট নিয়ে অভিষেকে হ্যাটট্রিকের কীর্তি গড়েন এলিস। মাহমুদউল্লাহ বোল্ড হওয়ার পর ছক্কার চেষ্টায় ক্যাচ দিয়ে ফিরেন মুস্তাফিজ ও মেহেদি হাসান।

উদ্বোধনী জুটিতে পরিবর্তন এনে রান তাড়া শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় ওভারেই অধিনায়ককে ফিরিয়ে দেন নাসুম আহমেদ।

এরপরই নিজেদের সেরা জুটি পায় সফরকারীরা। জশ ফিলিপির জায়গায় সুযোগ পেয়ে নিজেকে মেলে ধরেন ম্যাকডারমট। ছন্দে থাকা মার্শের সঙ্গে জমে যায় তার জুটি। বেশ কিছু বাজে বল করে তাদের কাজ সহজ করে দিচ্ছিলেন বোলাররা।

দুই ছক্কায় ৪১ বলে ৩৫ রান করা ম্যাকডারমটকে বোল্ড করে ৬৩ রানের জুটি ভাঙেন সাকিব। মোইজেস হেনরিকেসকে দ্রুত ফেরান শরিফুল ইসলাম।

শেষ ৪ ওভারে প্রয়োজন ৩৮ রান, ক্রিজে মার্শ, হাতে ৭ উইকেট। ম্যাচে ভালোভাবেই ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু দুর্দান্ত বোলিংয়ে দুই ওভারে স্রেফ ৫ রান দিয়ে ম্যাচ তাদের জন্য ভীষণ কঠিন করে তোলেন মুস্তাফিজ।

আগের দুই ম্যাচে ৪৫ রানে ফেরা মার্শ এবার ফিফটি করেন ৪৫ বলে। এরপর যেতে পারেননি বেশিদূর। শরিফুলের বলে ধরা পড়েন লং অফে। অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের ৪৭ বলে খেলা ৫১ রানের ইনিংসে ৬ চারের পাশে একটি ছক্কা।

শেষ ওভারের প্রথম বলে ছক্কা মেরে অস্ট্রেলিয়ার আশা বাঁচিয়ে রাখেন কেয়ারি। পরের দুই বলে আসে কেবল ১। চতুর্থ বলটি মেহেদি করে বসেন ‘নো’, ভাগ্য ভালো তার দিতে হয়নি চড়া মাশুল। ফ্রি-হিটসহ শেষ তিন বলে আসে কেবল ২।

নিজেদের ইতিহাসে এই প্রথম টি-টোয়েন্টিতে টানা চার জয়ের খুশিতে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। আগের ম্যাচগুলোর মতো সাদামাটা ছিল না এবারের উদযাপন। সিরিজ জয়ের খুশি ছিল বাঁধন হারা।

শনিবার চতুর্থ টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি হবে দুই দল।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১২৭/৯ (নাঈম ১, সৌম্য ২, সাকিব ২৬, মাহমুদউল্লাহ ৫২, আফিফ ১৯, শামীম ৩, সোহান ১১, মেহেদি ৬, মুস্তাফিজ ০, শরিফুল ০*; টার্নার ১-০-২-০, হেইজেলউড ৪-০-১৬-২, জ্যাম্পা ৪-০-২৪-২, অ্যাগার ৪-০-২৩-০, এলিস ৪-০-৩৪-৩, মার্শ ১-০-১৫-০, ক্রিস্টিয়ান ২-০-৯-০)।

অস্ট্রেলিয়া: ২০ ওভারে ১১৭/৪ (ম্যাকডারমট ৩৫, ওয়েড ১, মার্শ ৫১, হেনরিকেস ২, কেয়ারি ২০*, ক্রিস্টিয়ান ৭*; মেহেদি ৩-০-২৯-০, নাসুম ৪-১-১৯-১, সাকিব ৪-০-২২-১, মুস্তাফিজ ৪-০-৯-০, শরিফুল ৪-০-২৯-২, সৌম্য ১-০-৯-০)।

ফল: বাংলাদেশ ১০ রানে জয়ী

সিরিজ: ৫ ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ ৩-০তে এগিয়ে

ম্যান অব দা ম্যাচ: মাহমুদউল্লাহ