সাকিবময় ম্যাচে বাংলাদেশের সিরিজ জয়

এই ইনিংসের জন্য কত অপেক্ষা! মহাদেব সাহার কবিতার মতো ‘কোটি কোটি মঙ্গল-বুধবার’ বা ‘লক্ষ লক্ষ শীত-বর্ষা’ পার হয়নি যদিও, তবে অপেক্ষা রূপ নিয়েছিল কাতর প্রতীক্ষায়। অবশেষে সেই ইনিংস উপহার দিলেন সাকিব আল হাসান। এমন এক দিনে, যেদিন ভীষণ জরুরি ছিল। এমন এক ক্ষণে, যখন তিনি না দাঁড়ালে ভেঙে পড়ত দল। রানে ফেরার দিনটি সাকিব রাঙালেন ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ইনিংসে। হারের চোখরাঙানি থামিয়ে বাংলাদেশ পেল সিরিজ জয়ের স্বাদ।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2021, 11:41 AM
Updated : 18 July 2021, 04:13 PM

দ্বিতীয় ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় ৩ উইকেটে। তিন ম্যাচের সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচেই হয়ে গেল সিরিজের ফয়সালা।

দুর্দান্ত খেলেও সাকিব ম্যাচ শেষ করেন সেঞ্চুরির চার রান দূরত্বে থেকে। তাতে আক্ষেপ খুব বেশি থাকার কথা নয়, দলকে জয়ের ঠিকানায় পৌঁছে দিলেন যে প্রায় একার হাতে!

গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে ফিফটির পর আইপিএল, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ, এমনকি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও ফিফটি দেখা যায়নি সাকিবের ব্যাটে। সেই খরা কাটিয়ে তার প্রত্যাবর্তন হলো রাজসিক।

৮ চারে ১০৯ বলে অপরাজিত ৯৬ রানের ইনিংসটির আগে বল হাতে দুটি উইকেটও আছে তার। বাংলাদেশের এই জয় তাই সত্যিকার অর্থেই সাকিবময়।

সাকিবের আলোয় অবশ্য অন্যদের খানিকটা আভাও আছে। বোলিংয়ে চার উইকেট নেন শরিফুল ইসলাম। বল হাতে ভালো না করলেও মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন পার্শ্বনায়ক ব্যাট হাত।

সাকিবের সঙ্গে যখন উইকেটে যোগ দেন সাইফ, বাংলাদেশের জয় তখনও ৬৮ রান দূরে। উইকেট বাকি মোটে তিনটি। দুজনের একজন আউট হলেও ডুবতে পারত দল। কিন্তু অষ্টম উইকেটে প্রতিকূল স্রোতে দারুণভাবে হাল ধরে দুজন পাড়ি দেন বাকি পথটুকু।

রান তাড়ার শুরুটা খারাপ ছিল না দলের। সাবধানী ব্যাটিং আর দারুণ কিছু শট মিলিয়ে তামিম ইকবাল ও লিটন দাস উদ্বোধনী জুটিতে তোলেন ৩৯ রান। এরপরই দলের হঠাৎ উল্টো যাত্রা।

গালিতে সিকান্দার রাজার দুর্দান্ত ক্যাচে বিদায় নেন তামিম। রিচার্ড এনগারাভার লেংথ বল পুল করতে গিয়ে সহজ ক্যাচ দেন লিটন। শরীর থেকে দূরে বাজে শট খেলেন মোহাম্মদ মিঠুন, পয়েন্টে ডাইভিং ক্যাচ নেন ওয়েসলি মাধেভেরে।

বিনা উইকেটে ৩৯ থেকে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে ৫০।

সাকিব যখন ধীরেসুস্থে শুরুর পর দুটি চার মেরে জমে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছেন, আরেকটি জুটি তখন জমে ওঠার আগেই শেষ। এবার আত্মঘাতী দৌড়ে রান আউট মোসাদ্দেক হোসেন।

এপর সাকিবের সঙ্গী বিপদে দলের বরাবরের ত্রাতা মাহমুদউল্লাহ। প্রতিরোধের জুটিতে পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ।

কিন্তু আগের ম্যাচের মতোই থিতু হয়ে আলগা শটে আউট মাহমুদউল্লাহ (২৬)। একটু পর যখন দলকে আরও বিপদে ঠেলে উইকেট ছুঁড়ে এলেন মেহেদী হাসান মিরাজ, বাংলাদেশের রান তখন ৬ উইকেটে ১৪৫। জয় তখনও বহু দূরের পথ।

সাকিব ততক্ষণে ফিফটি পেরিয়ে গেছেন। খুঁজছিলেন তিনি সঙ্গী। হাত বাড়িয়ে দেন আফিফ হোসেন। পাশাপাশি কিছুটা এগিয়ে আবার হাত গুটিয়েও নেন তরুণ ব্যাটসম্যান।

জয় অভিযানে এরপর সাকিবের সঙ্গী সাইফ। তার লড়াইও শেষ হতে পারত শুরুতেই। ২ রানেই সাইফকে রান আউটের সহজ সুযোগ হাতছাড়া করে জিম্বাবুয়ে। এরপর কঠিন একটি ক্যাচ দারুণ চেষ্টার পরও অল্পের জন্য নিতে পারেননি রেজিস চাকাভা। টিকে গিয়ে সাকিবকে শুধু সঙ্গই দেননি তিনি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু রানও করেন।

সাকিব পুরা সময়টাই ছিলেন দলের ভরসা হয়ে। ৫৯ বলে ফিফটি করেন। ৩০ ওভারের পর টানা ১৩ ওভারে আসেনি কোনো বাউন্ডারি। কিন্তু রান রেটের চাপে দলকে পড়তে হয়নি এক-দুই করে রান বাড়ানোয়। শেষ ওভারের প্রথম বলে তার বাউন্ডারিতেই ধরা দেয় জয়।

সকালে জিম্বাবুয়ে ব্যাটিংয়ে নামে টস জিতে। প্রচণ্ড বাতাসে তখন হাড়কাঁপানো শীত। আগে বোলিং নিতেন হয়তো অনেক অধিনায়কই। জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ব্রেন্ডন টেইলরের চাওয়া ছিল, তরুণ দলটি একটু নির্ভার হয়ে ব্যাটিং করুক।

কিন্তু তিনি নিজে আর সতীর্থদের বেশ কজন বুঝি একটু বেশিই নির্ভার হয়ে গিয়েছিলেন। থিতু হয়েও উইকেট বিলিয়ে আসেন বেশ কজন ব্যাটসম্যান।

মিডল অর্ডারে পাঁচ ব্যাটসম্যান পেরিয়ে যান ২৫। কিন্তু ফিফটি করতে পারেন কেবল একজন। সেই একজন, ওয়েসলি মাধেভেরে আউট হয়ে যান ৫৬ রানেই।

উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য ছিল বেশ ভালো। কিন্তু জিম্বাবুয়ে পায়নি ভালো শুরু। প্রথম ওভারেই বাংলাদেশ পায় উইকেটের দেখা। যেটি মূলত উপহার।

তাসকিন আহমেদের অফ স্টাম্পের বাইরের শর্ট বল, যেটির প্রাপ্য ছিল বাউন্ডারি, সেটিই পয়েন্টে আফিফ হোসেনের হাতে তুলে দেন টিনাশে কামুনহুকামউই।

আরেক ওপেনার টাডিওয়ানাশে মারুমানি পঞ্চম ওভারে আউট হতে পারতেন তিনবার। তাসকিনের ওভারে দ্বিতীয় বলে মিড অনে ক্যাচ নিতে পারেননি, পরের বলে থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে বল হাতে নিয়েও ফেলে দেন সাইফ উদ্দিন। ওই ওভারেই আরেকবার বল অল্পের জন্য যায়নি বোলার তাসকিনের কাছে।

তবে পরের ওভারে নিজের পতন ডেকে আনেন মারুমানি নিজেই। মেহেদী হাসান মিরাজের সোজা একটি বলে বাজেভাবে স্লগ করে বোল্ড।

সেই ধাক্কা অনেকটাই সামাল দেন দুই অভিজ্ঞ রেজিস চাকাভা ও ব্রেন্ডন টেইলর। যথারীতি টেইলর এগোতে থাকেন ইতিবাচক ব্যাটিংয়ে। সাকিবকে মাথার ওপর দিয়ে চার মারেন, শরিফুলকে বাউন্ডারির পর ছক্কা মারেন অসাধারণ এক শটে।

৪৭ রানের এই জুটি ভাঙেন সাকিব। বলের লাইন মিস করে চাকাভা বোল্ড হন ২৬ রান করে।

জিম্বাবুয়ের জন্য বড় হতাশা হয়ে আসে পরের উইকেট। অনায়াস ব্যাটিংয়ে ফিফটির দিকে এগোচ্ছিলেন টেইলর। শরিফুলকে লফটেড শটে বাউন্ডারি মারার পরের বলে তিনি চেষ্টা করেন র‌্যাম্প শট খেলার। ব্যাটে-বলে হয়নি। শ্যাডো করার মতো করে আয়েশি ভঙ্গিতে ব্যাট দোলাতে গিয়ে পেছনে ফেলে দেন বেলস।

৫ চার ও ১ ছক্কায় ৫৭ বলে ৪৬ করে ফেরেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক।

ডিওন মায়ার্স ও মাধেভেরে এরপর দলকে এগিয়ে নেন একটু। এরপর উইকেট ছুঁড়ে আসার পালা এখানেও। সাকিবের শর্ট বলটি ছিল মারার মতোই। কিন্তু মায়ার্স (৩৪) না পারেন নিচে রাখতে, না পারেন সীমানা ছাড়া করতে। লং অনে ক্যাচ নেন মাহমুদউল্লাহ।

জিম্বাবুয়ের রান তখন ৫ উইকেটে ১৪৬। ইনিংসের একমাত্র ফিফটি জুটি আসে এরপরই। অভিজ্ঞ সিকান্দার রাজাকে নামানো হয় সাতে। তার সঙ্গে জুটিতে দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন মাধেভেরে।

তরুণ মাধেভেরে আরও একবার তার প্রতিভার ঝলক দেখান দারুণ কিছু শটে। অষ্টম ওয়ানডেতে তৃতীয় ফিফটিতে পা রাখেন ৫২ বলে। শেষ দিকে যখন দ্রুত রান তোলার পালা, তখনই তার বিদায়। শরিফুলের স্লোয়ার উড়িয়ে মারেন তিনি, লং অফ থেকে অনেকটা সামনে ছুটে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ নেন তামিম ইকবাল।

শরিফুল শেষ দিকে উইকেট পান আরও দুটি। ফুল টসে ক্যাচ দেন লুক জঙ্গুয়ে, শর্ট বলে ব্লেসিং মুজারাবানি।

ওয়ানডে ক্যারিয়ারে আগের তিন ম্যাচে তার উইকেট ছিল তিনটি। চতুর্থ ম্যাচে শিকার চারটি।

সিকান্দার রাজাও ব্যর্থ শেষটা ভালো করতে। সাইফ উদ্দিনের বলে দুটি বাউন্ডারির পর আউট হয়ে যান ৪৪ বলে ৩০ করে।

শেষ ১০ ওভারে জিম্বাবুয়ে করতে পারে মাত্র ৫৫ রান।

তারপরও তারা বিপাকে ফেলতে পেরেছিল বাংলাদেশকে। কিন্তু দিনটি তো সাকিবের রানে ফেরার দিন, বাংলাদেশের বিপক্ষে তাই জয়ে ফেরা হলো না জিম্বাবুয়ের।

জিম্বাবুয়েতে সবশেষ দুই ওয়ানডে সিরিজে হারের পর এবার জিততে পারল বাংলাদেশ।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

জিম্বাবুয়ে: ৫০ ওভারে ২৪০/৯ (কামুনহুকামউই ১, মারুমানি ১৩, চাকাভা ২৬, টেইলর ৪৬, মায়ার্স ৩৪, মাধেবেরে ৫৬, রাজা ৩০, জঙ্গুয়ে ৮, মুজরাবানি ০, চাতারা ২*, এনগারাভা ০; তাসকিন ১০-০-৩৮-১, সাইফ ১০-০-৫৪-১, মিরাজ ৭.২-০-৩৪-১, শরিফুল ১০-০-৪৬-৪, সাকিব ১০-০-৪২-২, মোসাদ্দেক ১.৪-০-৭-০, আফিফ ১-০-১১-০)।

বাংলাদেশ: ৪৯.১ ওভারে ২৪২/৭ (তামিম ২০, লিটন ২১, সাকিব ৯৬*, মিঠুন ২, মোসাদ্দেক ৫, মাহমুদউল্লাহ ২৬, মিরাজ ৬, আফিফ ১৫, সাইফ ২৮*; মুজারাবানি ৯.১.-১-৩১-১, চাতারা ৭-১-৫২-০, জঙ্গুয়ে ৮-০-৪৬-২, এনগারাভা ৯-১-৩৩-‌১, মাধেভেরে ১০-০-৩৯-১, রাজা ৬-০-৩৩-১)।

ফল: বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী।

সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-০তে এগিয়ে।

ম্যান অব দা ম্যাচ: সাকিব আল হাসান।