সিরিজ জয়ে সুপার লিগের শীর্ষে বাংলাদেশ

দুঃসময়ের বলয়ে ছিল দেশের ক্রিকেট। সেই আঁধার ফুঁড়ে উঁকি দিল অনন্য এক সাফল্যের সূর্যমুখ। টানা ১০ ম্যাচে জয়বিহীন থেকে সিরিজ শুরু করা দল দুই ম্যাচেই সিরিজে হারিয়ে দিল শ্রীলঙ্কাকে। ধরা দিল লঙ্কানদের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়ের স্বাদ। মুশফিকুর রহিমের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে গড়ে ওঠা এই জয়ের সৌধ বাংলাদেশকে পৌঁছে দিল আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগের পয়েন্ট তালিকার চূড়ায়ও।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2021, 12:27 PM
Updated : 25 May 2021, 07:04 PM

প্রথম ওয়ানডেতে তবু লড়াই জমেছিল বেশ। সেই ম্যাচের চেয়ে কম পুঁজি নিয়েও দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ জিতল অনেক বড় ব্যবধানে। ১০৩ রানের এই জয়ে নিশ্চিত হলো সিরিজ জয়।

ম্যাচের শুরুতেই তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানকে হারানো দলকে অসাধারণ এক ইনিংস খেলে উদ্ধার করেন মুশফিক। এরপর মেহেদী হাসান মিরাজ ও মুস্তাফিজুর রহমানের দারুণ বোলিংয়ে দাঁড়াতেই পারেনি লঙ্কান ব্যাটিং।

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ অলআউট হয় ২৪৬ রানে। শ্রীলঙ্কা ৩৮ ওভারে ৯ উইকেটে ১২৬ রান তোলার পর বৃষ্টিতে বন্ধ হয় ম্যাচ। পরে তাদের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪০ ওভারে ২৪৫। বাকি দুই ওভারে তারা যোগ করতে পারে ১৫ রান।   

মুশফিক আগের ম্যাচেও ছিলেন দলের ত্রাতা। সেদিন আউট হয়ে যান ৮৪ রানে। এই ম্যাচে চ্যালেঞ্জ ছিল আরও কঠিন। তাকে উইকেটে যেতে হয় দ্বিতীয় ওভারেই। সেখান থেকে দলকে টেনে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন আউট হন, তার নামের পাশে তখন ১২৭ বলে ১২৫ রান।

ম্যাচের শুরুর চিত্রে যেমন মিল প্রথম ম্যাচের সঙ্গে, তেমনি মিল আছে মুশফিকের ইনিংস গড়ার ধরনেও। বাউন্ডারির দিকে না ঝুঁকে সিঙ্গেলস-ডাবলসে রান বাড়ানোর মাস্টারক্লাস মেলে ধরেন তিনি আরেকবার। প্রথম বাউন্ডারি মারেন ৪০ বল খেলার পর। ৭০ রান পর্যন্ত বাউন্ডারি ছিল ওই একটিই! শেষ দিকে আবার পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে দ্রুত কিছু বাউন্ডারিও আদায় করেন।

মুশফিকের ইনিংসটিই শেষ পর্যন্ত হয়ে থাকে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারক।

ম্যাচের শুরুটা ছিল ঘটনার ঘনঘটায়। ইসুরু উদানাকে টানা তিনটি বাউন্ডারিতে শুরু করেন তামিম। এর মধ্যে একটি করে নো ও ওয়াইডও করেন উদানা। এই ওভারেই চতুর্থ বলে তামিম বেঁচে যান পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে।

১৫ রানের প্রথম ওভারের পরই বাংলাদেশের উল্টোযাত্রা। দ্বিতীয় ওভারে দুশমন্থ চামিরার দুর্দান্ত গতি ও সুইংয়ের জবাব পাননি তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান। ভেতরে ঢোকা দুর্দান্ত দুটি ডেলিভারিতে চার বলের মধ্যে এলবিডব্লিউ দুজনই।

মুশফিকের লড়াই শুরু সেখান থেকে। লিটন দাসের সঙ্গে তার জুটিতে খানিকটা সামাল দেওয়া যায় জোড়া ধাক্কা। তবে সেই প্রচেষ্টা দীর্ঘায়িত হয়নি খুব। অনেক আলোচনা-বিতর্কের পর আরেকটি সুযোগ পাওয়া লিটন তা হেলায় হারান।

উইকেটে ১১ ওভার কাটিয়ে দেওয়ার পর যখন মনে হচ্ছিল লিটন থিতু, তখনই তিনি ছুঁড়ে আসেন উইকেট। চায়নাম্যান লাকশান সান্দাক্যানের প্রথম বলটি ছিল অফ স্টাম্পের বেশ বাইরে। জায়গায় দাঁড়িয়ে আলগা কাট শটে লিটন ক্যাচ দেন পয়েন্টে। ৪২ বলে তার রান ২৫, সবশেষ ৮ ওয়ানডে ইনিংসে তার সর্বোচ্চ স্কোর এটিই।

সুযোগ হারানো ও বাজে শটের পালায় অবশ্য লিটনকেও ছাড়িয়ে যান মোসাদ্দেক। মোহাম্মদ মিঠুনের জায়গায় একাদশে এসে তিনি দায়িত্ব পান পাঁচে ব্যাটিংয়ের। কিন্তু সান্দাক্যানের লেগ স্টাম্পের বাইরের যে বল ছেড়ে দিলেই ওয়াইড অনায়াসে, চাইলেও আউট হওয়া কঠিন, সেই বলেই ব্যাট ছুঁইয়ে মোসাদ্দেক আউট স্রেফ ১০ রান করে।

৭৪ রানে ৪ উইকেট হারানো দলকে উদ্ধার করেন মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ। শুরুতে একটু সময় নেন দুজন। ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা আক্রমণে আসার পর তাকে দারুণ দুটি ছক্কায় রান বাড়ান মাহমুদউল্লাহ। মুশফিক যথারীতি প্রান্ত বদলে সচল রাখেন রানের চাকা।

১০৮ বলে ৮৭ রানের জুটি থামে সেই সান্দাক্যানের বলেই এবং এবারও বোলারের কৃতিত্ব সামান্যই। মাহমুদউল্লাহকে প্যাডল শট খেলতে দেখে লেগ সাইডে সরে যান কিপার কুসল পেরেরা, ব্যাট ছুঁয়ে আসা বল দারুণ ক্ষীপ্রতায় তিনি জমান গ্লাভসে।

এরপর লড়াই কেবল মুশফিকের। আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ পারেননি টিকতে। সাইফ উদ্দিন নিজে রান বেশি করতে না পারলেও অন্তত কিছুটা সঙ্গ দেন মুশফিককে। অষ্টম উইকেটে ৪৮ রানের জুটিতে সাইফের রান ২৯ বলে ১১, মুশফিকের ২২ বলে ৩৬।

৮৫ ও ৯৬ রানে দুই দফা বৃষ্টিতে মুশফিককে থাকতে হয় অপেক্ষায়। শেষ পর্যন্ত চামিরার বলে বাউন্ডারিতে অষ্টম ওয়ানডে সেঞ্চুরি স্পর্শ করেন ১১৪ বলে।

সেঞ্চুরির পর বাউন্ডারি মারেন আরও চারটি। ৫০ ওভার পর্যন্ত অবশ্য থাকতে পারেননি। লড়াইয়ের পুঁজি পেয়ে যায় দল। সেই স্কোরকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই পারেনি লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা।

অভিষিক্ত শরিফুল ইসলাম প্রথম উইকেটের স্বাদ পান লঙ্কান অধিনায়ক কুসল পেরেরাকে ফিরিয়ে। পরের জুটিতে রানের গতি যায় থমকে।

এমনিতে আগ্রাসী দানুশকা গুনাথিলাকা এ দিন থাকেন একদম মিইয়ে (৪৬ বলে ২৪)। পাথুম নিসানকা আবার ব্যর্থ নিজেকে মেলে ধরতে। কুসল মেন্ডিস, ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা, দাসুন শানাকারা বিদায় নেন বাজে শটের মহড়ায়। আগের ম্যাচে ঝড় তোলা ভানিন্দু হাসারাঙ্গাকে স্তিমিত করে রাখেন মিরাজ।

প্রথম ম্যাচে চার উইকেটের পর এবার মিরাজের শিকার তিনটি। মুস্তাফিজের প্রাপ্তি টানা দুই ম্যাচে তিন উইকেট করে। সাকিব দুই উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ডে স্পর্শ করেন মাশরাফি বিন মুর্তজাকে।

৮ ম্যাচে ৫০ পয়েন্ট নিয়ে এখন আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগের শীর্ষে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব হিসেবে চালু হওয়া এই লিগে সামনে যদিও কঠিন চ্যালেঞ্জ অনেক বাকি। তবু আপাতত এক নম্বরে বাংলাদেশ, দেশের ক্রিকেটের অস্থির সময়ে স্বস্তির একটু কোমল বাতাস।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ৪৮.১ ওভারে ২৪৬ (তামিম ১৩, লিটন ২৫, সাকিব ০, মুশফিক ১২৫, মোসাদ্দেক ১০, মাহমুদউল্লাহ ৪১, আফিফ ১০, মিরাজ ০, সাইফ ১১, শরিফুল ০, মুস্তাফিজ ০*; উদানা ৯-০-৪৯-২, চামিরা ৯.১-২-৪৪-৩, হাসারাঙ্গা ১০-১-৩৩-১, শানাকা ৭-০-৩৮-০, সান্দাক্যান ১০-০-৫৪-৩, ধনাঞ্জয়া ৩-০-২৩-০)।

শ্রীলঙ্কা: (লক্ষ্য ৪০ ওভারে ২৪৫) ৪০ ওভারে ১৪১/৯ (গুনাথিলাকা ২৪, কুসল পেরেরা ১৪, নিসানকা ২০, কুসল মেন্ডিস ১৫, ধনাঞ্জয়া ১০, বান্দারা ১৫, শানাকা ১১, হাসারাঙ্গা ৬, উদানা ১৭*, সান্দাক্যান ৪, চামিরা ৪*; মিরাজ ১০-০-২৮-৩, শরিফুল ৬-০-৩০-১, তাসকিন ৮-০-২৭-০, মুস্তাফিজ ৬-১-১৬-৩, সাকিব ৯-০-৩৮-২, মোসাদ্দেক ১-০-২-০)।

ফল: ডিএলএস পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ১০৩ রানে জয়ী।

সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-০তে এগিয়ে।

ম্যান অব দা ম্যাচ: মুশফিকুর রহিম।