লেগ স্পিনার জুবায়েরের অপেক্ষা আর ফুরোয় না

একেকটি টুর্নামেন্ট যায়, জুবায়ের হোসেন লিখনের দীর্ঘশ্বাস বাড়ে। হতাশার শেষ সীমানায় গিয়ে তিনি একটু থমকে দাঁড়ান, জাতীয় লিগ তো আছে! এরপর তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকা এই টুর্নামেন্টের দিকে। অবশেষে যখন বহু কাঙ্ক্ষিত সেই জাতীয় লিগ এলো, ঢাকা বিভাগের ১৪ জনের স্কোয়াডেও নিজেকে খুঁজে পেলেন না এই লেগ স্পিনার।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2021, 12:14 PM
Updated : 21 March 2021, 12:14 PM

বেশ কিছুদিন ধরেই রাজশাহীর বাংলা ট্র্যাক ক্রিকেট একাডেমিতে অনুশীলন করছিলেন জুবায়ের। জাতীয় লিগে খেলার আশায় ঢাকায় ফিরে দিন চারেক অনুশীলন করেছেন দলের সঙ্গে। সোমবার শুরু টুর্নামেন্ট। ঢাকার ১৮ জনের দলে থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রথম রাউন্ডের ১৪ জনের দলে জায়গা না পেয়ে রোববার তিনি ফিরে যাচ্ছেন বাংলা ট্র্যাক একাডেমিতেই।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে অপার সম্ভাবনা নিয়ে আসা এই লেগ স্পিনার ২৫ বছর বয়সেই হয়ে উঠেছেন যেন ব্রাত্য। জাতীয় দল তো বহুদূর, ঘরোয়া ক্রিকেটে ম্যাচ খেলার জন্য হাপিত্যেশ করে ফিরছেন। গত তিন বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে খেলতে পেরেছেন মোটে ৭টি ম্যাচ! তার ঠাঁই হয় না হাই পারফরম্যান্স স্কোয়াড বা এই ধরনের দলগুলিতেও।

প্রধান নির্বাচকের কথা

ঢাকা বিভাগের ১৪ জনের দলেও কেন জায়গা পেলেন না জুবায়ের, সেই প্রশ্নে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন বললেন, “প্রথম দুই রাউন্ডে ৬ মিলিমিটার ঘাসের উইকেটে খেলা হবে। তাই ওকে রাখা হয়নি।”

ঢাকা বিভাগের প্রথম ম্যাচ বিকেএসপিতে। বরাবরই সেখানকার ২২ গজ পরিচিত দেশের সেরা ব্যাটিং উইকেট হিসেবে। সেখানে ঘাসের উইকেট থাকার কথা একটু বিস্ময়করই। তাছাড়া ঢাকা বিভাগের ১৪ জনের দলে স্পিনার ঠিকই আছে তিন জন-নাজমুল ইসলাম অপু, শাহবাজ চৌহান ও আরাফাত সানি জুনিয়র।

বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল অপুকে বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটের উপযোগী মনে করা হয়েছে কম সময়ই। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বিবেচনায় তবু তাকে রাখা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আরেক বাঁহাতি স্পিনার শাহবাজকে আগে কখনোই বড় দৈর্ঘ্যের জন্য কার্যকর মনে করা হয়নি। প্রথম শ্রেণির কোনো ম্যাচ তাই খেলতে পারেননি এখনও। ক্লাব ক্রিকেটেও দলে জায়গা পান কমই।

২০১৯ সালে বিসিবি একাদশের হয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের সময় চট্টগ্রামে রশিদ খানের পরামর্শ নেন জুবায়ের। ছবি: বিসিবি

সানি জুনিয়রের বাস্তবতাও প্রায় একই। বিশেষজ্ঞ স্পিনারও তিনি নন। খানিকটা অফ স্পিন আর খানিকটা ব্যাটিং সামর্থ্য মিলিয়ে তাকে বলা যায় ‘মিনি অলরাউন্ডার।’ সীমিত ওভারে মাঝেমধ্যে কার্যকর, কিন্তু বড় দৈর্ঘ্যের জন্য নয়। পাঁচ বছর আগে প্রথম শ্রেণিতে অভিষেক হলেও ম্যাচ খেলতে পেরেছেন কেবল ৩টি।

শাহবাজ-সানি জুনিয়র থাকতে পারলে জুবায়ের কেন নয়? এখানে প্রধান নির্বাচক গুরুতর অভিযোগ তুললেন, পাশাপাশি শোনালেন আশার কথাও।

“বিকেএসপিতে মনে হয় টার্নিং উইকেট হবে। নেব, লিখনকে পরের রাউন্ডে নেব। বাদ দিয়ে দেইনি। ১৮ জনের মধ্যে তো আছে।”

“ওকে নিয়ে তো কোচদের রিপোর্ট ভালো না। খেলাতে চায় না। আমরা জোর করে খেলিয়েছি আগে। এবারও পরের রাউন্ডে ওকে নেব।”

জুবায়েরকে নিয়ে এমন অভিযোগ অবশ্য পুরনো। বাংলাদেশের হয়ে তার ৬ টেস্ট, ৩ ওয়ানডে ও ১ টি-টোয়েন্টির সবকটি ২০১৪-২০১৫ সালে। এরপর তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করতে চাননি, নিবেদনে ঘাটতি ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে বারবার। সেসবে কিছুটা সত্যতাও ছিল বলে নানা জায়গা থেকে জানা গেছে তখন।

তবে গত কিছুদিনে তাকে যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে দেখা গেছে। ফিটনেস পরীক্ষায় আগের চেয়ে বেশ ভালো করেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটের কোচদের সঙ্গে তাকে কাজ করতেও দেখা গেছে নিয়মিত।

ঢাকা বিভাগের কোচ যা বলছেন

লেগ স্পিনারদের নিয়ে দেশের ক্রিকেটে হাহাকারের মধ্যে ২০১৯ সালে জাতীয় লিগে একটি নিয়ম করে দিয়েছিল বিসিবি, যেসব বিভাগে লেগ স্পিনার আছে, অন্তত ১ জনকে অবশ্যই খেলাতে হবে। সেবার জুবায়েরকে না খেলানোয় ঢাকা বিভাগের কোচ জাহাঙ্গীর আলম এবং রিশাদ হোসেনকে না খেলানোয় রংপুরের কোচ মাসুদ পারভেজকে বরখাস্ত করে বোর্ড।

বাংলা ট্র্যাক একাডেমিতে কোচ ও বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদের সঙ্গে কাজ করছেন জুবায়ের। ছবি: ফেইসবুক

এবার ঢাকা বিভাগের কোচ দিপু রায় চৌধুরি জানালেন, এই আসরে লেগ স্পিনার খেলানোর বাধ্যবাধকতা আপাতত নেই। জুবায়েরকে না রাখা ও নাজমুল-শাহবাজকে রাখার কারণ ব্যাখ্যা করলেন সাবেক এই পেসার।

“লিখন (জুবায়ের) খুব ভালো শেপে ছিল না, এজন্য প্রথম ম্যাচের জন্য বিবেচনা করা হয়নি। নেটে এসেছিল, বোলিং করেছে। তবে এখনও মনে হয় ভালো শেপে আসেনি। লেগ স্পিনারদের অনেক বোলিং করতে হয়। লাইন-লেংথ গুরুত্বপূর্ণ।”

“অপু (নাজমুল) প্রথম পছন্দ (স্পিনে)। আর কোনো স্পিনার নেই বলে সঙ্গে শাহবাজকে রাখা হয়েছে।”

‘শেপে’ না থাকলে জুবায়েরকে ১৪ জনের স্কোয়াডে রেখে বোলিং অনুশীলন করানোর সুযোগ তো ছিল! দিপু রায় চৌধুরি এবার বল ঠেলে দিলেন নির্বাচকদের কোর্টে।

“দলে রাখা বলতে…আমি তো কোচ, সবকিছু আমার হাতে নেই। ১৪ জনের দল তো নির্বাচকদের ব্যাপার। কোচের এখানে কিছুই করার নেই। আমি হয়তো একাদশ বাছাইয়ে ভূমিকা রাখতে পারি।”

“আমি নিজে লেগ স্পিনারদের অনেক পছন্দ করি। ক্লাব ক্রিকেট হোক, খুলনা বা রংপুর বিভাগে বলেন বা যে কোনো জায়গায় কোচিং করালে আমি লেগ স্পিনার খেলাই, যে ফরম্যাটই হোক। লেগ স্পিনাররা তো সবসময়ই আক্রমণাত্মক। আমার লেগ স্পিনার খেলাতে সমস্যা নেই, বরং খুশিই হই লেগ স্পিনার পেলে।”

এবং জুবায়ের যা ভাবছেন

নিবেদনে ঘাটতির পুরনো অভিযোগ নিয়ে জুবায়ের হেসে শুধু ছোট্ট করে বললেন, “আমার সঙ্গে যারা প্র্যাকটিস করেন, কোচরা যারা দেখেন, তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর পাবেন।”

নমুনা কিছুটা তাকে দেখলেও বোঝা যায়। ওজন আগের চেয়ে কমেছে বেশ। ঘরোয়া ক্রিকেটের বড় আসরগুলোতে খেলতে না পেরে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় খেলে নিজেকে ছন্দে রাখার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে গত কিছুদিনে আমিনুল ইসলাম বিপ্লব, রিশাদ হোসেন ও মিনহাজুল আবেদীন আফ্রিদি দৃশ্যপটে আছে লেগ স্পিনার হিসেবে। নানা জায়গায় অনেক সুযোগও পাচ্ছেন তারা। এই ৩ জনই অনেকটা আধুনিক ঘরানার লেগ স্পিনার, বিশেষ করে বিপ্লব ও রিশাদ। জুবায়ের সেখানে প্রথাগত ও ধ্রুপদি ঘরানার লেগ স্পিনার, বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে যিনি কার্যকর হতে পারেন বেশি।

২০১৯ সালে কোচ বরখাস্তের ঘটনার পর ঢাকা বিভাগের হয়ে দুটি ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন তিনি। খুব ভালো করতে পারেননি। অনেক দিন পরপর হুট করে দু-একটি ম্যাচ খেললে ভালো করাও কঠিন। লেগ স্পিনারদের জন্য স্কিলের বাইরে বড় সম্পদ আত্মবিশ্বাস। টানা কিছু ম্যাচ খেলতে না পারলে বা সেই নিশ্চয়তা না পেলে আত্মবিশ্বাস পাওয়াই কঠিন।

আশার জায়গা কম হলেও জুবায়ের জানালেন, তিনি নিজের মতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

“ঢাকা বিভাগের নেটে বোলিং করেছি। সবাই ভালোই বলছিল। দলে জায়গা পাওয়া তো আমার হাতে নেই। আমি প্র্যাকটিস করছি নিয়মিত, রাজশাহীতে বাংলাট্র্যাক একাডেমিতে সুজন স্যারের (বাংলা ট্র্যাকের কোচ ও বিসিবি পরিচালক খালেদ মাহমুদ) সঙ্গে কাজ করছি। প্র্যাকটিসের জায়গা ছিল না। উনি ব্যবস্থা করেছেন এই দুঃসময়ে। আমার বোলিং দেখে উনি অনেক ভালোও বলেছেন। আমি রাজশাহীতে টুর্নামেন্ট খেলেছি, টুকটাক নানা জায়গায় খেলে প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করছি।"