টেস্ট নিয়ে হাহাকার, সাদা বলে রঙিন স্বপ্ন মোসাদ্দেকের

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি, ব্যাটিং গড় ৫৭। ৩ টেস্টে সুযোগ পেয়ে পারফরম্যান্স খারাপ নয়। তার পরও সুযোগ হচ্ছে না বাংলাদেশ টেস্ট দলে। মোসাদ্দেক হোসেনের দীর্ঘশ্বাসে মিশে থাকে আক্ষেপ, কথায় ফুটে ওঠে অভিমানের সুর। দল তাকে বিবেচনা করছে শুধু সীমিত ওভারের ক্রিকেটে, তিনিও মন দিয়েছেন এখানেই। নিউ জিল্যান্ড সফরের দলে জায়গা পাওয়া অলরাউন্ডার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন তার দলে ফেরা, আশা-হতাশা ও ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2021, 03:43 AM
Updated : 21 Feb 2021, 03:43 AM

দলের বাইরে যাওয়া ও ফেরা তো বেশ কবারই হলো। আলাদা কোনো অনুভূতি হয় এখন?

মোসাদ্দেক হোসেন : এখন আসলে এসব নরম্যাল হয়ে গেছে। কোভিডের আগে অবশ্য মোটামুটি নিয়মিতই ছিলাম। তার আগে কিছু ইনজুরি সমস্যা ছিল। তবে এবার তো অনেক দিন পর হলো, করোনাভাইরাসের সময় বদলে গেছে অনেক কিছু। একটু নতুন নতুন লাগছে আর কী।

সাকিব আল হাসান এই সফরে নেই বলে আপনাকে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচকরা বলছেন, একইরকম ভূমিকা আপনার পালন করতে হতে পারে। একটা চাপ সঙ্গী করেই কি দলে ফিরছেন?

মোসাদ্দেক :  এটা আপনি জানেন, আমি জানি, সবাই জানে। সাকিব ভাইয়ের বিকল্প হয় না, তার অভাব পূরণ করার মতো নয়। উনার ভূমিকা পালন করা অনেক কঠিন কাজ। আমার যদি সুযোগ আসে খেলা, চেষ্টা করব নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ যতটা করা যায়। 

কিছুদিন আগে টি-টেন খেলে এলাম। ভালোই করেছি ওখানে। তার আগে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি, প্রেসিডেন্ট’স কাপ খেলেছি। অনুশীলন করছি। ভালো চলছে সব। আমি আত্মবিশ্বাসী।

ওয়ানডেতে আপনার ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটাই সাত নম্বরে খেলিয়েছে দল। ছয়-আটে কিছু ইনিংস। এবার সাকিব যেহেতু নেই, একাদশে সুযোগ পেলে ওপরে ব্যাট করার আশা আছে?

মোসাদ্দেক : আগেও সাকিব ভাই যখন ছিলেন না, তখনও ৭ নম্বরেই খেলতে হয়েছে। আমার সবশেষ সিরিজে (২০১৯ সালের জুলাইয়ে) বলেন বা তার আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে, এশিয়া কাপে (২০১৮), সব জায়গায়ই ৭ নম্বরে ব্যাট করতে হয়েছে।  

আমি আসলে নিজেকে এখন ওভাবেই মানিয়ে নিয়েছি। বুঝে গেছি, আমাকে এসব জায়গায়ই খেলতে হবে। ওপরে কেন সুযোগ পাচ্ছি না বা কবে পাব, এসব ভাবলে আমারই ক্ষতি। দল সাতে খেলাচ্ছে, আমি এই পজিশন নিয়েই ভাবছি।

সাত নম্বরে এখন তো আবার সৌম্য সরকারকে দিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালাচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্ট!

মোসাদ্দেক : হ্যাঁ, আমি জানি না আসলে (নিজের পজিশন)… কারও সঙ্গে কথা হয়নি এখনও। ২০ জনের স্কোয়াড যাচ্ছে নিউ জিল্যান্ডে, অনেক কিছু হতে পারে। দলে যোগ দেওয়ার পর হয়তো জানতে পারব আমাকে নিয়ে ভাবনা। একাদশে সুযোগ হলে নিশ্চয়ই আগে থেকেই জানাবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নেব। এখনও পর্যন্ত কিছু জানায়নি যখন, সাত নম্বরই ধরে রাখছি। অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে আসলে।

কোভিড বিরতির পর যখন থেকে অনুশীলন শুরু করলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু নিয়ে কি কাজ করেছেন ব্যাটিংয়ের? নিউ জিল্যান্ডে ২০১৬-১৭ সফরে ক্রাইস্টচার্চে দারুণ একটা ফিফটি ছিল আপনার। ওখানে ভালো করতে হলে কোন দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত?

মোসাদ্দেক : আসলে উন্নতির তো শেষ নেই। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন ভাবনায় আপাতত শুধু নিউ জিল্যান্ড। কন্ডিশন তো ওখানে খুবই কঠিন। সেখানকার উইকেটে বল বাউন্স করে অনেক। এসব জায়গায় যাওয়ার আগে আমরা চেষ্টা করি অনুশীলনে বাউন্স বল বেশি খেলার। ব্যাকফুটের বল বেশি খেলার। এবারও এটা মাথায় আছে।

ওখানে যাওয়ার পর কোয়ারেন্টিন শেষে ১০-১১ দিন অনুশীলনের সুযোগ থাকবে। ওই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ হবে উইকেটের গতি ও বাউন্সের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য।

টি-টেন খেলে এলেন কদিন আগে। এই ফরম্যাটে তো উইকেটে গিয়েই ব্যাট চালাতে হয়। সাত-আটে যদি ব্যাট করতে হয়, টি-টেনের ব্যাটিং কতটা কাজে দেবে?

মোসাদ্দেক : টি-টেনের ব্যাপারটি হলো, উইকেটে গিয়ে একটু সময় নেওয়ারও সুযোগ নেই। প্রথম থেকেই মেরে খেলতে হয়। বাংলাদেশ দলেও যদি ওরকম পরিস্থিতি আসে, অবশ্যই অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে।

টি-টেন খেললে হিটিং রেঞ্জ, রিফ্লেক্স সব বাড়ে অনেক। ওয়ানডেতে যদি শেষ দিকে ব্যাটিংয়ে নামতে হয়, ৪-৫ ওভার যদি বাকি থাকে, আমার মনে হয় আগের চেয়ে ভালো করব। আগে গিয়েই শট খেলার ক্ষেত্রে হয়তো সমস্যা হয়েছে। এখন আশা করি এখানে আরেকটু ভালো করব।

দলে সুযোগ পেলে বোলিংয়েও তো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে!

মোসাদ্দেক : আমি আমার মতোই চেষ্টা করব। কখনোই আমি বড় টার্নার নই, অনেক স্পিন করে না বল। আমার শক্তি ও সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে বল করার চেষ্টা করি। আমি জানি, আমি ব্যাটসম্যানকে আটকে রাখতে পারি। পরিস্থিতি অনুযায়ী বল করতে পারি। এটি মাথায় রাখার চেষ্টা করি এবং নিজের ভেতরই থাকার চেষ্টা করি। বাড়তি কিছু সাধারণত চেষ্টা করি না।

এবারও যদি সুযোগ হয়, পরিস্থিতি যেরকম চায়, সেরকমই চেষ্টা করব। টানা ডট বল করতে পারলে ব্যাটসম্যান যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময়ে চাপে পড়বে। মাশরাফি ভাই যখন অধিনায়ক ছিলেন, আমাকে এটাই করতে বলতেন। ৫-৬ ওভার বোলিং করলে, যতটা সম্ভব ডট বল যেন করতে পারি। এখনও নিশ্চয়ই ওরকমই থাকবে ভূমিকা।

৩টি মোটে টেস্ট খেলেছেন, ভালো করেছেন। ২০১৯ সালের ভারত সফর থেকে ফিরলেন মায়ের অসুস্থতায়, এরপর আর টেস্টে সুযোগ হয়নি। টেস্ট নিয়ে ভাবনা কি?

মোসাদ্দেক :  টেস্ট নিয়ে আসলে এই মুহূর্তে কিছুই ভাবছি না। ভাবার অবস্থায় মনে হয় আমি নেই।

৩টি টেস্টে আমি যেভাবে খেলেছি এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যে রেকর্ড, আমি তো আশা করতেই পারি যে আরও কয়েকটা টেস্টে যেন বেশি সুযোগ পাই। সেটি হয়তো হয়নি। টিম কম্বিনেশনের কারণে বা অন্য যে কোনো কারণে হতে পারে, আমি জানি না কেন হয়নি।

টেস্ট দলে নেই, এই বাস্তবতার সঙ্গে আমি মানিয়ে নিয়েছি। এখন তো আর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্রিকেটার নই, এসব সহ্য করতে শিখেছি।

তার মানে কি টেস্ট নিয়ে আপনার আশা নেই আর?

মোসাদ্দেক : আমি কিন্তু সবসময়ই বলেছি, টেস্ট ও ওয়ানডেকে আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দেই। দুটি ঘিরেই স্বপ্ন, আশা, ভবিষ্যৎ, সব ছিল ও আছে।

যখন দেখি আমার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৫৭ গড়, টেস্টে গড় ৪১, তখন খারাপ লাগে আরও বেশি টেস্ট খেলতে না পারা নিয়ে। কিন্তু আমাকে হয়তো পরিকল্পনাতেই রাখা হয়নি, বিবেচনাতেই নাই। সেই কারণে হয়তো খেলতে পারিনি। আমি কী করতে পারি!

প্রথম শ্রেণিতে হয়তো লম্বা ইনিংস খেলেছি কিছু। কিন্তু ওয়ানডে দলে আমাকে ৭ নম্বরে বিবেচনা করা হয়েছে। এজন্য আমি সেখানেই মনোযোগ দিয়েছি। যখন কাউকে একটা জায়গায় বেশি বিবেচনা করা হবে, তখন তো তার সেটা নিয়েই বেশি ভাবা স্বাভাবিক। যখন আপনি বুঝতে পারবেন, টেস্ট দলে আপনাকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই নেই, তখন আর কী করার থাকে! সাদা বল নিয়েই তো ফোকাস করতে হবে। সেটিই করছি এখন।

টি-টেন হলেও দেশের বাইরের একটি লিগে নেতৃত্ব দিলেন, সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? শোয়েব মালিক, মোহাম্মদ হাফিজের মতো অভিজ্ঞরা ছিলেন দলে, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো বা কতটা শিখতে পারলেন?

মোসাদ্দেক :  দলটি গড়ার পর শুরুতে অধিনায়কত্ব করার কথা ছিল শোয়েব মালিকের। আমি ছিলাম সহ-অধিনায়ক। কিন্তু উনার কোভিডে কারণে শুরুর কয়েক ম্যাচ ছিলেন না, হাফিজ ভাইও নেতৃত্ব নিতে রাজি হননি। আমাকেই দিয়েছে তখন। আমিও বললাম যে কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশে তো অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতা কিছু আছে।

কথা বলার সুযোগ খুব বেশি পাইনি। মাঠে তো এমনিতেই সুযোগ থাকে না, এত ছোট ফরম্যাট। আর মাঠের বাইরে বায়ো-বাবলে এত কড়াকাড়ি ছিল, আবু ধাবিতে যে অবস্থায় ছিলাম, খুব বেশি সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি।

এমনিতে ডাগ-আউটে কথা হয়েছে টুকটাক। হাফিজ ভাইয়ের একটি কথা মনে পড়ে। এক ম্যাচে শেষ ওভারে উইকেট পড়ার পর আমি নিজে না গিয়ে মুক্তার আলিকে পাঠালাম। মুক্তার তো বিগ হিটার, শক্তি আমার চেয়ে বেশি, ওই হিসেব করে পাঠিয়েছিলাম। হাফিজ ভাই তখন আমাকে এসে বললেন, ‘অবশ্যই তোমার যাওয়া উচিত ছিল। তুমি অধিনায়ক, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও আছে। তাছাড়া তুমি অনেক ভালো ব্যাটসম্যান, তুমি থাকলে দুটি ছক্কা হয়তো বেশি হতো।’

আমার ওপর উনার এত বিশ্বাস দেখে ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল যে উনারাও তাহলে আমাদের খেলা অনেক অনুসরণ করেন, জানেন আমাদের সবাইকে। এটা আমার ভালো লেগেছে।

দলে যখন ফিরলেন, আবার যেন বাইরে যেতে না হয়, এজন্য কি কি করতে চাইবেন?

মোসাদ্দেক : সত্যি বলতে, এসব আগে ভাবতাম। এখন আমি জানি, কিছু করার ভাবনা থাকলে কিছুই করা হয় না। নরম্যাল থাকলেই ভালো কিছু হয়। অনেক কিছু যখন করতে চেয়েছি, সেই চেষ্টা করতে গিয়ে আমিই ছিটকে গেছি। হাবিজাবি করে ফেলব, এখন এটা ভাবি না। দলের ভূমিকা পালন করতে পারলেই খুশি।