বিদায় বেলায় শাহরিয়ারের ‘অদ্ভূত’ অনুভূতি

কালো স্যুটে কেতাদুরস্ত হয়ে বিদায়ী আয়োজনে এলেন শাহরিয়ার নাফীস। মঞ্চে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে বের করলেন এক টুকরো কাগজ, ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতার তালিকা। ছেলেবেলা থেকে ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত যাদের পাশে পেয়েছেন, উল্লেখ করলেন সবার কথাই। সবই গোছানো, পরিপাটি। কেবল বিদায়ের অনুভূতির প্রকাশে তিনি একটু এলোমেলো।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2021, 11:16 AM
Updated : 13 Feb 2021, 11:16 AM

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাকে সবশেষ দেখা গেছে প্রায় ৮ বছর আগে। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি এখনও ছিলেন বড় নাম। ‘ছিলেন’ বলতে হচ্ছে, কারণ এখন তার পরিচয় সাবেক ক্রিকেটার। সব ধরনের ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায়ের ঘোষণা দিলেন তিনি শনিবার।

বয়স ৩৫, আরও কিছুদিন খেলতেই পারতেন। ফর্মও ছিল বেশ ভালো। সবশেষ ৩টি ম্যাচে করেছেন ১টি করে সেঞ্চুরি ও ফিফটি। তবু খেলোয়াড়ি জীবনের পথচলা থামালেন তিনি নতুন শুরুর জন্য। সেটিও ক্রিকেটের পথেই। দায়িত্ব নিচ্ছেন বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের ডেপুটি অপারেশন্স ম্যানেজারের।

২২ গজের কসরত থামিয়ে আপাতত অপারেশন্স ম্যানেজার সাব্বির খানের সঙ্গে কাজ করে শিখবেন টেবিলের কাজ। ভবিষ্যতে হয়তো তাকে দেখা যেতে পারে মূল দায়িত্বেই।

২০০২ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ দিয়ে শুরু হয়েছিল দেশের ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে তার পথচলা। গত ফেব্রুয়ারিতে বিসিএলে কক্সবাজারে দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে মধ্যাঞ্চলের বিপক্ষে ম্যাচটি হয়ে রইল শেষ।

সেই ছেলেবেলা থেকে ক্রিকেট খেলাই ছিল সত্ত্বা জুড়ে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। তবে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে জানালেন, অনেক ভেবেই নিয়েছেন সিদ্ধান্ত।

“(সাবেক হয়ে যাওয়ার অনুভূতি) একটু কঠিন। গতকাল থেকেই চিন্তাভাবনা করছিলাম। আর খেলব না, তাতে খুব কষ্ট লাগছে না। তবে অনুভূতিটা অদ্ভুত। একটা স্কুলে পড়লাম, স্কুল ছেড়ে দিচ্ছি-ওরকম অনুভূতি। খুবই অদ্ভুত।”

“আমি সবসময় সব সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নিয়েছি, পরিষ্কার করে। চিন্তা করেছি, যখন খেলোয়াড় হিসেবে আর অবদান রাখতে পারব না, আর থাকব না। তবে সবসময়ই বলেছি, ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকব। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটাই সঠিক সময়। কারণ খেলে যতটুকু অবদান রাখতে পারব তার চেয়ে বেশি এখন পারব।”

জাতীয় দলে বেশ আগে থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিজের আগমনী বার্তা জানান শাহরিয়ার। ২০০৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলে জায়গা পাননি তিনি বিতর্কিতভাবে। তবে বিশ্বকাপের আগে ভারতের বিপক্ষে একটি প্রস্তুতি ম্যাচে ঢাকা মেট্রো দলের হয়ে ১৬ চারে ১০১ রানের ইনিংস খেলে জানান দেন নিজের প্রতিভার।

এরপর কেবলই সামনে এগিয়ে যাওয়া। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের ক্রিকেট স্পেশালিস্ট বাঁহাতি ব্যাটসম্যান পায় তাকে দিয়ে। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ড সফরে ত্রিদেশীয় সিরিজে ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪৭ রানের ইনিংস, চতুর্থ ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ৭৫। দ্রুতই হয়ে ওঠেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

২০০৬ সাল ছিল তার জন্য সোনায় মোড়ানো। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফতুল্লা টেস্টে মহাকাব্যিক ১৩৮ রানের ইনিংস, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে সেঞ্চুরি, জয়পুরে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেঞ্চুরি, দেশের মাটিতে সেঞ্চুরি। এক পঞ্জিকাবর্ষে হাজার ওয়ানডে রানের কীর্তি, এখনও যা করতে পারেননি বাংলাদেশের আর কেউ; ছয় মাসের মধ্যে চারটি ওয়ানডে সেঞ্চুরি।

এমন পারফরম্যান্সের সঙ্গে লম্বা চুল আর স্টাইলিশ চলন-বলন ও গ্ল্যামার মিলিয়ে শাহরিয়ার হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টারবয়।

এরপর চূড়া থেকে পতন। বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর বিতর্কিতভাবে দলে জায়গা নড়বড়ে হয়ে ওঠা, আইসিএলে গিয়ে নিষিদ্ধ হওয়া। একসময় আইসিএলের অন্য সবার মতোই ক্ষমা পেয়ে ফেরেন দেশের ক্রিকেটে। জাতীয় দলেও আবার ঠাঁই হয়, পারফরম্যান্স হয় ভালো-মন্দ মিশিয়ে। তবে আগের সেই সুর কেটে যায় স্পষ্টভাবেই। অধারাবাহিকতায় জায়গা হারান দলে।

পরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে দারুণ পারফর্ম করেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। বিশেষ করে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। কিন্তু জাতীয় দলে আর ফেরা হয়নি। শেষ পর্যন্ত আর হলোই না। ১২৪টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ, ১৮০ লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ ও ৬০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ মিলিয়ে ২৫ সেঞ্চুরিতে ১৪ হাজার ৬৫৮ রানে শেষ হলো ক্যারিয়ার।

জাতীয় দলের সঙ্গে দীর্ঘ বিচ্ছেদ নিয়ে আক্ষেপ একসময় ছিল তার। তবে বিদায় বেলায় সব ভুলে বললেন তৃপ্তির কথাই।

“আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি, আমার সেরা যেটা ছিল আল্লাহ তাই দিয়েছেন। তাই আমার কোনো অতৃপ্তি নেই।”

“আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া বাংলাদেশ মানুষের ভালোবাসা। আমি যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আরেকটু বেশি খেলতাম, হয়তো পরিসংখ্যান আরও ভালো হতো। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে তৃপ্তি বিচার করি না। বাংলাদেশ মানুষ ও মিডিয়ার যে ভালোবাসা পেয়েছি এর চেয়ে বেশি ভালোবাসা পাওয়া একজন খেলোয়াড়ের জন্য সম্ভব না। আমার ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো অতৃপ্তি নেই।”