৮ বছরের পরিক্রমা ও মিরাজের সেঞ্চুরি

২০১৩ সালের এপ্রিলে মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে যুব টেস্টে শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। অধিনায়ক মোসাদ্দেক হোসেনের পাশাপাশি ওই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন ১৫ বছর বয়সী এক ব্যাটসম্যান। সময়ের পরিক্রমায় সেদিনের সেই কিশোর দেশকে দুটি যুব বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিয়ে, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে আলোড়ন তুলে, টেস্ট আবির্ভাব রাঙিয়ে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এখন পরিচিত মুখ। কিন্তু আরেকটি সেঞ্চুরি ছিল অধরা। অবশেষে এতটা পথ পেরিয়ে, আশা-হতাশা ছড়িয়ে, আবার তিনি পেলেন শতরানের স্বাদ। মেহেদী হাসান মিরাজ!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনি চট্টগ্রাম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2021, 10:31 AM
Updated : 4 Feb 2021, 06:36 PM

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় দিন দারুণ এক সেঞ্চুরিতে রাঙিয়েছেন মিরাজ। আট নম্বরে নেমে তার ১০৩ রানের অসাধারণ ইনিংস বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে ৪৩০ রানের পুঁজি।

প্রায় ৮ বছর আগে যুব টেস্টের সেই সেঞ্চুরি ছিল অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে দেশের হয়ে মিরাজের প্রথম ইনিংস। সেই সেঞ্চুরির পর আরও ৩টি যুব টেস্ট ও ৫৬টি যুব ওয়ানডে খেলেছেন তিনি। এই টেস্ট সিরিজের আগে টেস্ট খেলেছেন ২২টি, ওয়ানডে ৪৪টি, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ১৩টি। প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার ৪০ ম্যাচের, লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ ৯৩ আর টি-টোয়েন্টি ৭৫ ম্যাচের। স্বীকৃত ক্রিকেটের এই সবগুলো পর্যায় মিলিয়ে ২৪৭ ইনিংস পর আবার তিনি পেলেন আরেকটি সেঞ্চুরির দেখা।

অথচ এত দীর্ঘ প্রতীক্ষার কথা ছিল ছিল না। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান হিসেবে বেশি ভালো ছিলেন নাকি বোলার হিসেবে, এটা নিয়ে তর্ক করা যায়। সেখানে ব্যাটসম্যান মিরাজের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। যুব টেস্টে সেঞ্চুরি ছাড়াও একটি ফিফটি আছে। যুব ওয়ানডেতে তার রান ১ হাজার ৩০৫। সে সময় যা ছিল এই পর্যায়ে সপ্তম সর্বোচ্চ। নিখাদ একজন অলরাউন্ডারই ছিলেন।

তার ক্যারিয়ার ভিন্ন মোড় নিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পনের সময় থেকে। বাংলাদেশ ক্রিকেটেরও সেটি পালাবদলের এক সময়। জাতীয় দলের সেই সময়কার কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে আর অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের পরিকল্পনায় দেশের মাঠে টেস্টে টার্নিং উইকেটের কৌশল বেছে নিল বাংলাদেশ। সেই পরিকল্পনার শুরুর অভিযানে সঙ্গী করা হলো মিরাজকেও।

২০১৬ সালে যুব বিশ্বকাপ খেলার কয়েক মাস পর টেস্ট অভিষেক হয়ে গেল মিরাজের। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার অভিষেক হলো ক্রিকেট বিশ্ব কাঁপিয়ে। সহায়ক উইকেটে স্পিনের মায়াজালে শিকার করলেন একের পর এক উইকেট। ২ টেস্টে ১৯ উইকেট আর রেকর্ডের মালা গেঁথে হলেন ম্যান অব দা সিরিজ।

এমন শুরুর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার পথচলা মসৃণ হলো বটে। তবে বদলে গেল তার পরিচয়। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের নিখাদ অলরাউন্ডার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হয়ে গেলেন কেবলই একজন অফ স্পিনার।

সময়ের সঙ্গে ব্যাটিংয়ের ঝলক খানিকটা দেখা গেল বটে। তবে অলরাউন্ডার পরিচয় ফিরে পাওয়ার মতো ধারাবাহিকতা নেই। তাকে নিয়ে দেশের ক্রিকেটে টুকটাক হাহুতাশ ক্রমে রূপ নিল হাহাকারে।

কারণ অনুসন্ধানে নানা সময়ে কাটাছেঁড়াও হলো যথেষ্ট। বোলিংয়ের সাফল্যের কারণে শুরুর অনেক দিন তাকে কেবল বোলার হিসেবেই বিবেচনা করেছে দল। তিনি নিজেও নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেন বোলিংয়ের গণ্ডিতে। ব্যাটিং পড়ে রয় আড়ালে, উন্নতি তাই তাল মেলাতে পারেনি প্রত্যাশার সঙ্গে।

পরে সিনিয়র ক্রিকেটারদের কয়েকজন তাকে জোর করেন ব্যাটিংয়ে মন দিতে। নিজেও খানিকটা তাড়না বোধ করেন। দলের অনুশীলনে ব্যাটসম্যান মিরাজ একটু প্রাধান্য পেতে শুরু করে। এশিয়া কাপের ফাইনালে আচমকা ওপেন করতে নেমে তিনি চমকে দেন পারফরম্যান্সে। বিপিএলে ওপেন করার সুযোগ পেয়ে কাজে লাগান দারুণভাবে। টেস্ট-ওয়ানডেতেও কার্যকর ইনিংস মাঝেমধ্যে আসতে থাকে।

এতে তার অলরাউন্ডার সত্ত্বা উঁকি দিতে থাকে আবার। কিন্তু অলরাউন্ডার পরিচয়ের প্রতিষ্ঠা তবু রয়ে যায় দূরে।

এবারের এই সেঞ্চুরি সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার পথে তাকে নিয়ে যেতে পারে অনেক দূর। সেটি শুধু বহু আরাধ্য শতরানের কারণেই নয়, ইনিংসটির গুণ, মান ও ধরনের কারণেও।

দ্বিতীয় দিন সকালে লিটন দাস আউট হওয়ার পরই উইকেটে যান মিরাজ। বল তখনও বেশ নতুন। শ্যানন গ্যাব্রিয়েল ১৪৫ কিলোমিটার গতির আশেপাশে বল করছিলেন নিয়মিতই। আরেকপাশে জোমেল ওয়ারিক্যান ৪ উইকেট নিয়ে তেতে ছিলেন আরেকটি উইকেটের অপেক্ষায়।

কিন্তু মিরাজ গিয়েই খেলতে থাকেন দারুণ স্বচ্ছন্দে। একটু্ও অস্বস্তিতে তাকে পড়তে হয়নি। যেন মাঠের বাইরে থেকেই থিতু হয়ে গিয়েছিলেন!

গ্যাব্রিয়েলের বলে স্কয়ার ড্রাইভে চার মেরে শুরু করেন পথচলা। এরপর পেস-স্পিনে ফ্লিক, সুইপ, সব ধরনের ড্রাইভ, কাট, গ্লাইড, ইনসাইড আউট, মিরাজ তার ভাণ্ডার থেকে মেলে ধরেন শটের পর শট। তার ব্যাটসম্যানশিপের দারুণ এক বিজ্ঞাপন তা।

এছাড়াও লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে যেভাবে দলকে এগিয়ে নিয়েছেন, যতটা পরিণত ব্যাটিং করেছেন, সেটিও তার জন্য হবে আত্মবিশ্বাসের বড় খোরাক।

এই ইনিংসে নিজেকে যেমন তিনি আবিষ্কার করবেন নতুনভাবে, অধিনায়ক ও টিম ম্যানেজমেন্ট তার ওপর ভরসা রাখতে পারবেন আরও বেশি করে। পারস্পরিক বিশ্বাসের দারুণ রসদ জোগাবে এই সেঞ্চুরি।

কে জানে, হয়তো অলরাউন্ডার হয়ে ওঠার পালা শুরু এখান থেকেই। হারানো সময়ের হাহাকার করে লাভ আপাতত খুব বেশি নেই। বরং সম্ভাবনাকে শুরু হোক পূর্ণতা দেওয়ার লড়াই!