মলিন ক্রিকেটের দিনে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক সাকিব

ফুলেল মঞ্চে দাঁড়িয়ে সিরিজের উদ্বোধন ঘোষণা করলেন বিসিবি সভাপতি। মাঠের নানা প্রান্ত থেকে ওড়ানো হলো বেলুন। আতশবাজির স্ফুলিঙ্গের ছটায় শুরু হলো ম্যাচ। কিন্তু উৎসবের আবহে শুরু হওয়া ম্যাচ রঙিন হলো না বর্ণিল ক্রিকেটের প্রদর্শনীতে। ব্যাটিংয়ে ধুঁকল দুই দলই। লড়াইয়ে ছড়াল না উত্তাপ। জয়ের স্বস্তিটা অবশ্য পেল বাংলাদেশ। দারুণ বোলিংয়ে জয়ের নায়ক নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামা সাকিব আল হাসান।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2021, 09:52 AM
Updated : 20 Jan 2021, 03:38 PM

১০ মাস পর দেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরার ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় ৬ উইকেটে।

নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে তামিম ইকবালের পথচলা শুরু হলো জয় দিয়ে। আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগে পয়েন্টের খাতা খুলল বাংলাদেশ।

তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথমটিতে বুধবার ক্রিকেটের মান ছিল ম্লান। মেঘলা আকাশ আর গুমোট চারপাশ মিলিয়ে কন্ডিশন ছিল বোলিং সহায়ক। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের উইকেটও বন্ধুত্বের হাত বাড়াল বোলারদের দিকেই। মন্তর উইকেটে টার্ন মিলল বেশ। বোলারদের ফুট মার্কে উইকেটে ক্ষত তৈরিও হলো দ্রুত।

এসবের সঙ্গে যোগ হলো ক্যারিবিয়ানদেন যাচ্ছেতাই ব্যাটিং। সাকিবের স্পিনের জবাবই যেন পেল না তারা। ৩২.২ ওভারেই গুটিয়ে গেল ১২২ রানে। সেই রান তাড়ায় বাংলাদেশকে হারাতে হলো ৪ উইকেট। খেলতে হলো ৩৩.৫ ওভার পর্যন্ত।

২০১৯ বিশ্বকাপের পর প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমে ৭.২ ওভারে মাত্র ৮ রান দিয়ে সাকিবের শিকার ৪ উইকেট। তার সামনে এরকম অসহায় দেখা গেল ক্যারিবিয়ানদের।

অভিষেকেই ৩ উইকেট নেওয়া হাসান মাহমুদের উদযাপন।

যাকে নিয়ে অনেক আশা বাংলাদেশ ক্রিকেটের, সেই হাসান মাহমুদ যথেষ্টই রাঙালেন অভিষেক ওয়ানডে। তরুণ পেসারের প্রাপ্তি ৩ উইকেট।

আশার ছবি আছে মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিংয়েও। ২ উইকেট শিকার তার জন্য এমনিতে বড় খবর নয়। তবে প্রথম উইকেট নেন তিনি ভেতরে ঢোকানো বলে (ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য), যেটি নিয়ে কাজ করছিলেন অনেক দিন থেকে। আরও কয়েকবার তার হাত থেকে বের হলো এই ডেলিভারি।

একগাদা শীর্ষ ক্রিকেটারকে ছাড়া খেলতে আসা ক্যারিবিয়ানদের দুর্দশা খুব বিস্ময়কর অবশ্য নয়। এই ম্যাচে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছে তাদের ৬ জনের। একাদশের সবার সম্মিলিত অভিজ্ঞতা ১০৫ ম্যাচের, সেখানে বাংলাদেশের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা ১ হাজার ১১৫ ম্যাচ! অভিজ্ঞতার এই পার্থক্যের প্রতিফলন তাই মাঠের ক্রিকেটে পড়া অস্বাভাবিক নয়। তবে সব বাস্তবতা মাথায় রেখেও ক্যারিবিয়ানদের ব্যাটিং ছিল দৃষ্টিকটু।

নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ম্যাচে টস জেতেন তামিম। আদর্শ কন্ডিশনে বোলিংয়ে নামে বাংলাদেশ।

শুরুতে ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ম্যাচের প্রথম ওভারেই রুবেল হোসেনের শর্ট বলে পুল করে ছক্কায় ওড়ান সুনিল আমব্রিস।

পরের ওভারেই আমব্রিসকে ফিরিয়ে দেন মুস্তাফিজ। স্টাম্পে পিচ করে একটু ভেতরে ঢোকা বলে এলবিডব্লিউ এই ডানহাতি ওপেনার।

তৃতীয় ওভারে বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ থাকে ঘণ্টাখানেক সময়। বৃষ্টির পর আবার মুস্তাফিজের ছোবল। অভিষিক্ত কিপার-ব্যাটসম্যান যশুয়া দা সিলভা ফেরেন গালিতে লিটন দাসের দুর্দান্ত ডাইভিং ক্যাচে।

হাসান প্রথম স্পেলে ছিলেন একটু ধারহীন, হয়তো ছিলেন নার্ভাস। কিন্তু সাকিব আক্রমণে আসার পর দিশাহারা হয়ে পড়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং।

আন্দ্রে ম্যাককার্থি বোল্ড হন সুইপ করতে গিয়ে। অধিনায়ক জেসন মোহাম্মেদ স্টাম্পড হন ডিফেন্স করার চেষ্টায়। সোজা বলে এলবিডব্লিউ এনক্রমা বনার। ওই ওভার শেষে সাকিবের বোলিং ফিগার তখন ৫-১-৫-৩!

৫৬ রানে ৫ উইকেট হারানো দলকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন কাইল মেয়ার্স ও রভম্যান পা্ওয়েল। শুধু উইকেট ধরে রাখাই নয়, দুর্দান্ত কিছু শটও খেলেন দুজন। এই জুটির ৫০ আসে ৫১ বলে।

হাসান দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে প্রথম ওভারে হজম করেন দুটি বাউন্ডারি। তবে পরের ওভারেই পুষিয়ে দেন দুটি উইকেট নিয়ে।

অফ স্টাম্প ঘেষা দুর্দান্ত ডেলিভারিতে পাওয়েলকে (২৮) ফিরিয়ে ভাঙেন তিনি ৫৯ রানের জুটি। পরের বলেই এলবিডব্লিউ রেমন রিফার। টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, বলটি চলে যেত স্টাম্পের ওপর দিয়ে। ক্যারিবিয়ানদের তখন ছিল না কোনো রিভিউ।

পরের ওভারে আরেকটি বড় ধাক্কা খায় ক্যারিবিয়ানরা। তাদের আশা হয়ে থাকা মেয়ার্সকে ৪০ রানে থামান মেহেদী হাসান মিরাজ।

কোনো প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি লোয়ার অর্ডারেও। আকিল হোসেনকে ফিরিয়ে হাসান ধরেন তৃতীয় শিকার। সাকিব বোলিংয়ে ফিরে আল জারি জোসেফকে বোল্ড করে শেষ করে দেন ইনিংস।

বোলারদের দারুণ পারফরম্যান্সের দিনে বিবর্ণ ছিলেন কেবল অভিজ্ঞ রুবেল হোসেন। গতি, লাইন-লেংথ, ভালো ছিল না তার কিছুই।

রান তাড়ায় বাংলাদেশের শুরুটা ছিল বেশ অনায়াস। আলজারি জোসেফ একপাশ থেকে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করলেও আরেকপাশে শেমার হোল্ডারের বলে রান তুলে নেন তামিম ও লিটন দাস।

আকিল হোসেন আক্রমণে আসার পর পাল্টে যায় চিত্র। অভিষিক্ত বাঁহাতি স্পিনার প্রথম থেকেই দুর্দান্ত বোলিংয়ে উইকেটে আটকে রাখেন তামিম-লিটনকে। প্রথম ৬ ওভারে ৩৩ রান এলেও পরের ৭ ওভারে আসে মাত্র ১৪।

দলকে উইকেটও এনে দেন আকিলই। লেগ-মিডলে পিচ করে দারুণ টার্ন করে বল ছোবল দেয় লিটনের অফ স্টাম্পে। ১৪ রান করতে তাকে খেলতে হয় ৩৮ বল।

যাকে তিনে খেলাতে সাকিবকে নামানো হয়েছে চারে, সেই নাজমুল হোসেন শান্ত কাজে লাগাতে পারেননি প্রথম সুযোগ। ১ রান করে আকিলের বল শান্ত তুলে দেন মিড উইকেটে।

বাংলাদেশের জয় নিয়ে সংশয় অবশ্য জাগেনি কখনোই। সাকিব ও তামিম দলকে এগিয়ে নেন একটু একটু করে। তবে কাজ শেষ করে ফিরতে পারেননি দুজনের কেউ।

৬৯ বলে ৪৪ রান করে তামিম স্টাম্পড হন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক জেসনের বলে। আকিলের বল কাট করতে গিয়ে স্টাম্পে টেনে আনেন সাকিব (৪৩ বলে ১৯)।

২৬ রানে ৩ উইকেট নিয়ে শেষ করেন আকিল। অভিষেকে কোনো ক্যারিবিয়ান স্পিনারের সেরা বোলিং এটিই।

মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ এরপর দলকে পৌঁছে দেন লক্ষ্যে। তবে এই জয়ে স্বস্তি থাকলেও তৃপ্তি খুব বেশি থাকার কথা নয়।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৩২.২ ওভারে ১২২ (আমব্রিস ৭, যশুয়া ৯, ম্যাককার্থি ১২, জেসন ১৭, মেয়ার্স ৪০, বনার ০, পাওয়েল ২৮, রিফার ০, জোসেফ ৪, আকিল ১, হোল্ডার ০*; রুবেল ৬-০-৩৪-০, মুস্তাফিজ ৬-০-২০-২, হাসান ৬-১-২৮-৩, সাকিব ৭.২-২-৮-৪, মিরাজ ৭-১-২৯-১)।

বাংলাদেশ: ৩৩.৫ ওভারে ১২৫/৪ (লিটন ১৪, তামিম ৪৪, শান্ত ১, সাকিব ১৯, মুশফিক ১৯*;, মাহমুদউল্লাহ ৯*; জোসেফ ৮-৩-১৭-০, হোল্ডার ৩-০-২৬-০, আকিল ১০-১-২৬-৩, জেসন ৮-০-১৯-১, ম্যাককার্থি ২-০-১০-০, বনার ২.৫-০-১৫-০)।

ফল: বাংলাদেশ ৬ উইকেটে জয়ী

সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে

ম্যান অব দা ম্যাচ: সাকিব আল হাসান