মেহেদির বিধ্বংসী ইনিংস, মুশফিকের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি

স্রোতের বিপরীতে শক্ত হাতে হাল ধরলেন মুশফিকুর রহিম। দলকে নিলেন জয়ের ঠিকানার কাছে। কিন্তু তীর যখন দৃশ্যমান, তার ভুলেই ডুবল তরী। অসাধারণ সেঞ্চুরি করেও শেষ পর্যন্ত দলকে জেতাতে পারলেন না অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান। মেহেদি হাসানের বিধ্বংসী ইনিংসের পর শরিফুল ইসলাম ও মুস্তাফিজুর রহমানের দুর্দান্ত বোলিংয়ে জয়ের দেখা পেল তামিম একাদশ।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2020, 12:49 PM
Updated : 15 Oct 2020, 06:18 PM

বিসিবি প্রেসিডেন্ট’স কাপের তৃতীয় ম্যাচে বৃহস্পতিবার শান্ত একাদশকে ৪২ রানে হারিয়েছে তামিম একাদশ। তিন ম্যাচ শেষে টুর্নামেন্টের সব দলের জয় এখন একটি করে।

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে ৯ নম্বরে নেমে মেহেদি খেলেন ৫৭ বলে ৮২ রানের দারুণ ইনিংস। শুরুতে ধুঁকতে থাকা তামিমের দল ৫০ ওভারে পায় ২২১ রানের পুঁজি।

রান তাড়ায় শান্ত একাদশও পড়েছিল ব্যাটিং বিপর্যয়ে। সেখান থেকে মুশফিক দলকে টানেন দারুণ ব্যাটসম্যানশিপের প্রদর্শনী মেলে ধরে। কিন্তু তিনি আউট হয়ে যান সেঞ্চুরির পরপর। দলও থমকে যায় ১৭৯ রানে।

দুটি দুই দিনের ম্যাচের পর এই টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেও ব্যর্থ ছিলেন মুশফিক। এবার রানে ফিরলেন তিনি প্রবল বিক্রমে। তার ব্যাট থেকে আসে ১০৯ বলে ১০৩। অতিরিক্তসহ শান্ত একাদশের বাকি সবার সম্মিলিত রান ৭৬।

তামিম একাদশের হয়ে টানা দ্বিতীয় ম্যাচে নজরকাড়া বোলিং করেন মুস্তাফিজ। ৮ ওভারে ১৫ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। সফলতম বোলার অবশ্য আরেক বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম, ৩৭ রানে এই তরুণের শিকার ৪টি।

আগের দুই ম্যাচের তুলনায় উইকেট যথেষ্ট ভালো ছিল এই ম্যাচে। বল ব্যাটে আসে বেশ। তারপরও ধুঁকতে দেখা যায় তামিম একাদশের টপ ও মিডল অর্ডার।

টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে দুই তামিমের জুটি জমেনি এদিনও। আগের ম্যাচে শুরুতে ফিরেছিলেন তামিম ইকবাল, এবার তানজিদ তামিম। 

শুরুতে ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তানজিদ। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে আল আমিনকে পুল করে বাউন্ডারির পর আরেকটি চার মানের দৃষ্টিনন্দন স্কয়ার ড্রাইভে। রোমাঞ্চের পেছনে তার ছোটার সমাপ্তি ওই ওভারেই। আরেকটি পুল করতে গিয়ে ক্যাচ দেন মিড অনে।

দ্বিতীয় উইকেটে তামিম ও এনামুল হক জুটি গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই চেষ্টা শেষ হয় তাসকিন আহমেদের বলে এনামুলের আলগা শট ও স্লিপে সৌম্য সরকারের দুর্দান্ত ক্যাচে।

পেসারদের পর স্পিন আক্রমণে এলেও স্বস্তিতে ব্যাট করতে পারেননি তামিমরা। নাঈমের আঁটসাঁট বোলিং আটকে রাখে তামিম ও মিঠুনকে। শুধু রান আটকানোই নয়, দুজনকে বিদায়ও করেন এই অফ স্পিনার।

থিতু হয়ে যাওয়া তামিম ৪৫ বলে ৩৩ রান করে ফিরেন দারুণ এক ডেলিভারিতে, স্লিপে চমৎকার ক্যাচ নেন রিশাদ। ২১ বলে ৪ রানের অস্বস্তিময় ইনিংস খেলে মিঠুন বোল্ড হন আচমকা স্লগ করতে গিয়ে।

তরুণ শাহাদাত ও অভিজ্ঞ মোসাদ্দেক এরপর গড়েন কিছুটা প্রতিরোধ। রানের গতি যদিও ছিল প্রায় থমকে, ধীরে ধীরে তবু একটা জুটি গড়ে তোলেন দুজন। কিন্তু রিশাদ আহমেদের লেগ স্পিনে দৃষ্টিকটু শটে বিদায় নেন দুজনই।

৪৬ বলে ১২ করে মোসাদ্দেক আউট হয়ে যান অফ স্টাম্পের বাইরের বলে অযথা ব্যাট চালিয়ে। লেগ স্টাম্পের বাইরের যে শর্ট বল খেলা যেত অন সাইডে যে কোনো জায়গায়, শাহাদাত সেই বলেই ক্যাচ তুলে দেন শর্ট ফাইন লেগে। ৫২ বলে তরুণ ব্যাটসম্যান করেন ৩১।

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক আকবর আলি উইকেটে ছিলেন ৫ বল, এর মধ্যে আউট হতে পারতেন ৩ বার। অল্পের জন্য বার দুয়েক বেঁচে গিয়ে মিড অনে ক্যাচ দেন তিনি দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা আল আমিনের বলে। 

উইকেটে সময় কাটানোর ধার ধারেননি মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনও। বোল্ড হয়ে যান ক্রিজে ছেড়ে বেরিয়ে আল আমিনকে তেঁড়েফুড়ে মারতে গিয়ে।

তামিম একাদশের রান তখন ৮ উইকেটে ১২৫। সেখান থেকেই মেহেদি ও তাইজুল ইসলামের ব্যাটে শুরু নতুন এক অধ্যায়ের। বৃষ্টিতে ৬৭ মিনিট বন্ধ থাকে খেলা। বৃষ্টির পরও দুজনের ছন্দে ফিরতে সমস্যা হয়নি। শেষ দিকে মেহেদি তোলেন ঝড়, তাইজুল স্রেফ তাকে দিয়ে গেছেন স্ট্রাইক।

মূল বোলারদের ওভার শেষ হয়ে যাওয়ায় শেষ দিকে মুকিদুল ইসলাম ও সৌম্য সরকারকে দিয়ে কাজ চালাতে হয় শান্ত একাদশকে। তাদের বোলিং ছিল অনুমিত, মেহেদি স্রেফ কচুকাটা করেন তাদের।

৯ চার ও ৩ ছক্কায় মেহেদির ৮২ রানের ইনিংস শেষ হয় শেষ ওভারে মুকিদুলকে স্কুপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে। নবম উইকেটে দুজনের ৯৫ রানের জুটিতে দল পায় লড়ার মতো পুঁজি। তাইজুল অপরাজিত থাকেন ২০ রানে।

৩ উইকেট নিয়ে শান্ত একাদশের সফলতম বোলার আল আমিন হোসেন। তবে সেরা বোলার ছিলেন নিঃসন্দেহে নাঈম হাসান। ১০ ওভারে ৪টি মেডেন নেন এই অফ স্পিনার, উইকেট দুটি। লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেন দুটি উইকেট উপহার পান, বোলিংয়ে ছিল না খুব ধার।

শান্ত একাদশের রান তাড়া শুরুতে এগোতে থাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। রান আসেনি শুরুতে, ধরে রাখতে পারেননি তারা উইকেটও।

পঞ্চম ওভারে দেখা মেলে ইনিংসের প্রথম বাউন্ডারি। ১০ ওভারে রান ছিল মোটে ১৬। এর মধ্যে দুটি উইকেট হারায় তারা, দুটিরই শিকারি মুস্তাফিজ হোসেন। ২১ বলে ৭ করে সাইফ হাসান ক্যাচ দেন মিড অফে। নাজমুল হোসেন শান্ত দেন ফিরতি ক্যাচ।

গতি ও লাইন-লেংথ মিলিয়ে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন মুস্তাফিজ। হারিয়ে যাওয়া সেই ইয়র্কারও ফিরেছে বোলিংয়ে। তার প্রথম স্পেলটি ছিল ৫-২-৫-২।

সৌম্য সরকার তখনও ছিলেন টিকে। বলের পর বল ডিফেন্স করেন। চাপ বাড়তে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি লম্বা ইনিংস খেলে পুষিয়ে দিতে। তার ব্যাটিংয়ের সঙ্গে অদ্ভূতরকম বেমানান ইনিংসটায় সাইফ উদ্দিনের ইয়র্কারে এলবিডব্লিউ হন ৪৭ বলে ৯ রান করে।

চতুর্থ উইকেটে মুশফিকের সঙ্গে ৩৪ রানের ছোট্ট জুটি হয় আফিফ হোসেনের। বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম নিজের পরপর দুই ওভারে ফিরিয়ে দেন আফিফ ও তৌহিদ হৃদয়কে।

দিকহারা দলকে এরপর পথে ফেরানোর চেষ্টা করেন মুশফিক ও ইরফান শুক্কুর। ষষ্ঠ উইকেটে দুজনের জুটিতে আসে ৫৯ রান। আগের ম্যাচে ফিফটি করা শুক্কুর এবার ২৪ করে রান আউট হন দ্বিতীয় রানের চেষ্টায়।

লোয়ার-মিডল অর্ডারে ব্যাট হাতে ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল যাদের, সেই নাঈম ও রিশাদ রান না করেই উইকেট উপহার দেন শরিফুলকে।

তবে মুশফিক ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। এক পাশে উইকেট পড়েছে, আরেক পাশে তিনি খেলেছেন পুল, স্কুপ, রিভার্স স্কুপ। পেসার শরিফুলকে অবলিলায় ছক্কায় উড়িয়েছেন সুইপমতো খেলে। সাইফ উদ্দিনকে পরপর দুটি বাউন্ডারিতে স্পর্শ করেছেন সেঞ্চুরি।

কাজ তখনও বাকি ছিল। কিন্তু মুশফিকের পথচলা শেষ হয়ে যায়। প্রতিপক্ষের সেরা বোলার মুস্তাফিজকে র‍্যাম্প শট খেলতে গিয়ে বিলিয়ে দেন উইকেট। দলের আশারও সেখানে সমাপ্তি।

শেষ পর্যন্ত জয়-পরাজয়ের ব্যবধান বেশ বড় হলেও আসরের তৃতীয় ম্যাচে এসে অন্তত কিছুটা পাওয়া গেল রোমাঞ্চ আর ব্যাট-বলের লড়াই।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

তামিম একাদশ: ৫০ ওভারে ২২১/৯ (তামিম ৩৩, তানজিদ ৮, এনামুল ১২, মিঠুন ৪, শাহাদাত ৩১, মোসাদ্দেক ১২, আকবর ২, সাইফ উদ্দিন ৩, মেহেদি ৮২, তাইজুল ২০*, শরিফুল ১*; তাসকিন ১০-০-৪১-১, আল আমিন ১০-১-৪৩-৩, মুকিদুল ১০-০-৪৪-১, নাঈম ১০-৪-২৮-২, সৌম্য ৫-০-৪১-০, রিশাদ ৫-০-২১-২)।

শান্ত একাদশ:  ৪৫.৪ ওভারে ১৭৯ (সাইফ হাসান ৭, সৌম্য ৯, শান্ত ১, মুশফিক ১০৩, আফিফ ১৫, তৌহিদ ৪, শুক্কুর ২৪, নাঈম ০, রিশাদ ০, তাসকিন ৬, মুকিদুল ১*; সাইফ উদ্দিন ৮.৪-০-৪১-২, মুস্তাফিজ ৮-২-১৫-৩, মেহেদি ৯-১-৩৭-০, শরিফুল ১০-১-৩৭-৪, তাইজুল ১০-০-৪৬-০)।

ফল: তামিম একাদশ ৪২ রানে জয়ী

ম্যান অব দ্য ম্যাচ: মেহেদি হাসান

ব্যাটসম্যান অব দা ম্যাচ: মুশফিকুর রহিম

বোলার অব দা ম্যাচ: মুস্তাফিজুর রহমান

ফিল্ডার অব দা ম্যাচ: মোসাদ্দেক হোসেন