জাহানারার চাওয়া উড়ন্ত বেলস আর উপড়ানো স্টাম্প

গতিময় ডেলিভারিতে ডিগবাজি খাচ্ছে স্টাম্প আর বাতাসে উড়ছে বেলস। বিব্রত ব্যাটার মাথা নিচু করে হাঁটছেন ড্রেসিং রুমের পথে। যে কোনো ফাস্ট বোলারের সবচেয়ে প্রিয় দৃশ্য বুঝি এটিই। জাহানারা আলমের কাছে শুধু প্রিয় নয়, উপভোগের প্রতিশব্দও। ভারতের উইমেন’স টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জের গত আসরের ফাইনালে যে স্বাদ তিনি পেয়েছিলেন দুবার। এবারও তেমন কিছুর আশায় এই টুর্নামেন্টে খেলতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের এই ফাস্ট বোলার।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2020, 03:35 PM
Updated : 12 Oct 2020, 05:04 PM

মেয়েদের আইপিএল হিসেবে এই আসরকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে ভারতীয় বোর্ড। এবার তৃতীয় আসর হবে আগামী ৪ থেকে ৯ নভেম্বর। ছেলেদের আইপিএলের মতো মেয়েদের টুর্নামেন্টও হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। টানা দ্বিতীয়বার এখানে খেলার সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটে পেস বোলিংয়ের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন জাহানারা।

এবার অবশ্য জাহানারা একা নন, সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটের শুরুর সময়ের সৈনিক সালমা খাতুনও।

জাহানারার চোখে এই টুর্নামেন্ট বিশ্বকাপের মতো

গত আসরের মতো এবারও জাহানারার ঠাঁই হয়েছে ভেলোসিটি দলে। আগেরবার প্রথম ম্যাচে ৪ ওভারে ৩৪ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন তিনি। সেই হতাশা পাশে ঠেলে দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন ফাইনালে। ৪ ওভারে ২১ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। পরপর দুই ওভারে বোল্ড করেছিলেন মেয়েদের ক্রিকেটের বড় দুই তারকা ইংল্যান্ডের নাতালি শিভার ও নিউ জিল্যান্ডের সোফি ডিভাইনকে। দুটিতেই উপড়ে ফেলেছিলেন অফ স্টাম্প।

ভেলোসিটি শেষ পর্যন্ত ফাইনালে জিততে পারেনি। তবে জাহানারার দুটি বোল্ডের ভিডিও তুমুল সাড়া ফেলেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তিনি নিজে কতবার দেখেছেন? জাহানারা হেসে জানালেন অবাক করা উত্তর।

“ফাস্ট বোলাররা নিজেদের এরকম ডেলিভারির দৃশ্য বারবার দেখতে ভালোবাসে। তবে আমি একটু অন্যরকম। সাফল্যের ভিডিও খুব বেশি দেখি না। ওই বোল্ড দুটির ভিডিও যে দুয়েকবার পরে দেখিনি, তা নয়। তবে আমি বেশি দেখি আমার ঘাটতির জায়গার ভিডিও। সেখানে উন্নতির চেষ্টা করি।”

ভিডিও বেশি না দেখলেও তার হৃদয় জুড়ে সবচেয়ে বেশি থাকে অমন আউট। ব্যাটারকে ফাঁকি দিয়ে বেলস উড়িয়ে দেওয়াই তার ক্রিকেট জীবনের অক্সিজেন।

অনুশীলনে ট্রেনারের সঙ্গে জাহানারা

“বোল্ড আউটই ক্রিকেটে আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়। এরপর ভালো লাগে ব্যাটারকে বিভ্রান্ত করে কট বিহাইন্ড করতে, তৃতীয় প্রিয় এলবিডিব্লউ। তবে বোল্ড আউটের মতো মজা ক্রিকেটে আর কিছুতে পাই না। বোল্ড করার পর যে উদযাপন দেখেন আমার, ওটাও ভেতর থেকেই চলে আসে। এত ভালো লাগে যে উদযাপনও প্রাণখোলা হয়।”

উইমেন’স টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জের গত আসরে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে জাহানারার, সেটির কারণেই এবার তাড়না অনুভব করছেন আরও বেশি। বড় মঞ্চে নিজেকে যাচাই করার সুযোগ, বৈশ্বিক আবহে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ। টানা দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়ে মূলত সেজন্যই বেশি রোমাঞ্চিত ২৭ বছর বয়সী পেসার।

“এই টুর্নামেন্টকে আমার বিশ্বকাপের মতোই বড় মঞ্চ মনে হয়েছে। বিশ্বকাপে অবশ্যই অনেক বেশি দল থাকে। তবে এখানে এক দলেই বিশ্বের কয়েকটি দেশের ক্রিকেটার থাকে। তাদের সঙ্গে থাকা, অনুশীলন করা, মাঠের ভেতরে-বাইরে দ্রুত মানিয়ে নেওয়া, বড় তারকাদের মধ্যে পারফর্ম করা, বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে পারফর্ম করার চাপ, এসব অনেক বড় ব্যাপার।”

“গতবার ওখানে গিয়ে আরও ভালো করে বুঝেছি, আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। নিউ জিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা ছিল, এমনকি ভারতের ক্রিকেটাররাও…সবাই অনেক পেশাদার। আয়োজনের দিক থেকে, ক্রিকেটের মানে, সবকিছুতেই অনেক পেশাদারিত্ব। ওই লেভেল থেকে অনেক পিছিয়ে আমরা। আরও অনেক উন্নতি করতে হবে আমাদের।”

গত আসরের ফাইনালে যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন জাহানারা, এবারও সেটি ধরে রাখতে চান। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে প্রস্তুতি খুব ভালো হয়েছে বলে জানালেন মেয়েদের ক্রিকেটে বাংলাদেশের সফলতম পেসার।

“বোল্ড করে উইকেট নিতে পারলে অবশ্যই বেশি ভালো লাগবে। তবে পারফর্ম করতে পারলেই হলো। সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য নেই, আমার চেষ্টা থাকবে দলের হয়ে অবদান রাখার। টি-টোয়েন্টিতে ডট বল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পেসার হিসেবে দল আমার কাছে উইকেটই চাইবে। দলের চাওয়া পূরণের চেষ্টা করব।”

“কুরবানি ঈদের পর থেকে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। সত্যি বলতে, আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধা বিসিবি দিয়েছে প্রস্তুতির জন্য। মূল মাঠে ও সেন্টার উইকেটে অনুশীলন করেছি, ফ্লাড লাইটে করেছি। এই টুর্নামেন্ট খেলার জন্য নতুন কুকাবুরা বলে অনুশীলনের সুযোগ দিয়েছে আমাদের। কোচ দেওয়া হয়েছে একজন (বিসিবির কোচ মাহবুব আলি জাকি)। বিসিবিকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সব মিলিয়ে প্রস্তুতি খুব ভালো হচ্ছে।”

সালমা খাতুন। ছবি: আইসিসি

দেশে দুই দফা করোনাভাইরাস পরীক্ষায় নেগেটিভ হওয়া সাপেক্ষে আগামী ২১ অক্টোবর দুবাইয়ের বিমানে উঠবেন জাহানারা ও সালমা। সেখানে পৌঁছে আরেকদফা পরীক্ষার পর কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে ৬ দিন। কোয়ারেন্টিনের সময়ও পরীক্ষা হবে ৩ দফায়। সব ঠিক থাকলে ২৮ অক্টোবর থেকে তারা অনুশীলন শুরু করবেন দলের সঙ্গে।

রোমাঞ্চিত সালমাও

বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেট হাঁটি হাঁটি পা পা করার দিনগুলি থেকেই আছেন সালমা খাতুন। দেশের ক্রিকেটে তার পথচলা এক যুগের বেশি সময় ধরে, এখনও দলের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। দেশের বাইরের লিগে সুযোগ পেলেন তিনি এবারই প্রথম।

খেলার সুযোগ পেলে অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সালমা নিজেকে এমনভাবে মেলে ধরতে চান যেন পরেরবার বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি জনের সুযোগ মেলে।

“আগে আমাদের একজনই ছিল কেবল, জাহানারার সঙ্গে এবার আমি যাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে। এত বড় আসরে সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।”

“আমাকে যেহেতু অলরাউন্ডার হিসেবেই নিয়েছে, ব্যাটে-বলে ভালো পারফর্ম করতে চাই। দেশের নাম উজ্জ্বল করতে চাই। আমার ও জাহানারার পারফরম্যান্স দেখে যেন সামনে বাংলাদেশ থেকে ওরা আরও ক্রিকেটার নিতে আগ্রহী হয়।”

সালমা জায়গা পেয়েছেন ট্রেইলব্লেজার্স দলে। তার দলের অধিনায়ক স্মৃতি মান্ধানা। দলে আছেন ঝুলন গোস্বামীর মতো অভিজ্ঞ তারকা। বিদেশিদের মধ্যে আছেন বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন ডেনড্রা ডটিন। সালমার চাওয়া, এই আসর থেকে অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরবেন।

“ভারতের ক্রিকেটারদের প্রায় সবার সঙ্গেই পরিচয় আছে, কথা হয়। স্মৃতি মান্ধানা অনেক ভালো ক্রিকেটার, ঝুলন দিদি আছেন, ডটিনসহ অনেকে আছেন ভালো। সবার সঙ্গে অনেক কথা হবে, অনুশীলন করব, খেলব একসঙ্গে। আশা করি, সবকিছু থেকেই শিখতে পারব অনেক কিছু।”