যুবরাজের পিঠ ভেঙেছি, আফ্রিদির পাঁজর : শোয়েব

শোয়েব আখতার মানে গতির ঝড়, শোয়েব আখতার মানে বিতর্কের ঝড়ও। গতি দিয়ে যেমন ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপন ধরিয়েছেন, তেমনি মাঠের ভেতরে-বাইরে আচরণ দিয়েও আলোচনার জন্ম দিয়েছেন অনেকবার। খেলা ছাড়ার পরও খোলামেলা ও চাঁছাছোলা সব মন্তব্যে শিরোনামে উঠে আসেন প্রায়ই। ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ খ্যাত সাবেক এই পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার ফিরে তাকালেন তার ঘটনাবহুল খেলোয়াড়ি জীবনে, স্মৃতি হাতড়ে শোনালেন দারুণ কিছু গল্প।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2020, 06:31 AM
Updated : 6 August 2020, 06:32 AM

ইংল্যান্ড-পাকিস্তান টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে বিবিসির ‘দুসরা পডকাস্ট’-এ শোয়েব হাঁটলেন স্মৃতির সরণিতে। সেই পথচলায় উঠে এলো বলে-কয়ে ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতিতে বল করা, ম্যাথু হেইডেন ও অ্যান্ডু ফ্লিন্টফের সঙ্গে দ্বৈরথ, ভালোবাসা প্রকাশের খ্যাপাটে ধরন, সতীর্থ আর প্রতিপক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক, রোমাঞ্চকর এরকম আরও কিছু অধ্যায়।

বলে-কয়ে ১০০ মাইল গতির ডেলিভারি

(২০০৩ বিশ্বকাপে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের প্রথম বোলার হিসেবে ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতিতে বল করে ইতিহাস গড়েছিলেন শোয়েব। কেপ টাউনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে সেই ডেলিভারটি খেলেছিলেন ছিলেন নিক নাইট)

“ ১০০ মাইল গতিতে বল করা এমন কোনো ব্যাপার ছিল না আমার জন্য। এটি ছিল স্রেফ মিডিয়া হাইপ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ঘিরে মনোযোগ আকর্ষণের কৌশল। অত জোরে বল করার চেষ্টায় যে হাড়ভাঙা খাটুনি, সেটির জন্য তো আর টাকা-পয়সা পাচ্ছিলাম না!”

“আমি কেবল ভেবেছিলাম, যা থাকে কপালে, এটি আমাকে করতেই হবে। পুরো পরিকল্পনা সাজাই এবং সেভাবেই অনুশীলন শুরু করি। পিঠে ১৭০ কেজি বোঝা নিয়ে দৌড়েছি, প্রতি ১০০ মিটার দৌড়ানোর পর ২০ কেজি করে কমিয়ে দিতাম। ক্রিকেট বলের চেয়ে ভারী কিছু দিয়ে ২৬ গজ দূর থেকে বোলিং করতাম। পরে যখন ২২ গজে ফিরতাম, আগের চেয়ে গতি তখন ঘণ্টায় ৬ কিলোমিটার বেড়ে যেত।”

“নিক নাইটের বিপক্ষেই ডেলিভারিটি করার পরিকল্পনা করেছিলাম। তাকে বলেছিলাম, ‘তোমাকে আমি ছোবল দেব, নিজের ভালো চাও তো বল থেকে সরে যেও।’ ওই ওভারে, একদম ওই ডেলিভারিতে ১০০ মাইল গতির বল করব, আমি তাকে আগেই বলেছিলাম।”

গতির পথে বাধা এখন আইন

(অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লি (২০০৫) ও শন টেইট (২০১০) দুজনই ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতিতে বল করেছিলেন। শোয়েব ছাড়া শত মাইলের গণ্ডি ছুঁতে পেরেছেন কেবল এই দুজনই।)

“ আমরা দেখনদারি মানসিকতার ছিলাম না। তবে মাঠে মধ্যমনি হয়ে থাকাটা আমরা উপভোগ করতাম। বল হাতে যখন ছুটতাম, নিশ্চিত করতে চাইতাম যে ম্যাচ, দর্শক, সংবাদমাধ্যম, সবকিছুর আগ্রহের কেন্দ্রে যেন থাকি। বক্স অফিস হিট আমরাই।”

“ ১০ বছর আগে বোলাররা ঘণ্টায় ১৫৫ কিলোমিটার গতিতে বল করত। এখনকার বোলারদের গতি আচমকাই ঘণ্টায় ১৩৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। সত্যিকারের ফাস্ট বোলার গোটা বিশ্বে মাত্র গুটিকয় আছে এখন। আগে তো কেবল দক্ষিণ আফ্রিকার ছিল ছিল ছয়জন!”

“ক্রিকেটের আইনই এখন বোলারদের দ্রতগতিতে বল করার পথে বাধা; দুটি নতুন বল, অতিরিক্ত বিধিনিষেধ, অনেক বেশি ম্যাচ, এত এত টি-টোয়েন্টি লিগ, প্রচুর অর্থের ছড়াছড়ি, অনেক বেশি টিভি স্বত্ব।”

“ ক্রিকেটাররা এখন অনেক স্মার্ট হয়ে হচ্ছে, অর্থের দিকেই ঝোঁক বেশি। তারা চায় ক্যারিয়ার লম্বা করতে, শরীর বাঁচাতে, যেন ১০ বছর খেলতে পারে। আমি সেখানে নিজেকে উজার করে দিতাম প্রতিটি সিরিজ ধরে, সর্বস্ব ঢেলে দিতাম একেকটি দিনে।”

“ ক্রিকেটের আইন তখন এতটা জটিল ছিল না। দুটির বেশি বাউন্সার যখন নিষিদ্ধ করা হলো, আমি প্রচণ্ড হতাশ হয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, “ব্যাটসম্যানকে তাহলে ফাঁদে ফেলব কিভাবে? বডি লাইন বোলিং কোথায় গেল!”

“ দয়া করে অনুমতি দিন শরীর তাক করে বোলিং করার, তাকেও (ব্যাটসম্যান) সুযোগ দিন আমাকে পাল্টা আক্রমণ করার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো এমন কিছুই কাম্য! এসব দুর্বল, ছিমছাম, অতি যথার্থ ক্রিকেট দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত।”

হেইডেন ও ফ্লিন্টফের সঙ্গে লড়াই

(লম্বা রান আপে যেমন শোয়েব ছুটে আসতেন বুনো চেহারায়, তেমনি মাঠে কথা ও শরীরী ভাষায়ও ছিলেন দারুণ আগ্রাসী। ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে তাই তার লড়াই জমে উঠত প্রায়ই।)

 “ খেলাটায় এখন আকর্ষণীয় চরিত্র বলে কেউ নেই। কেবল বেন স্টোকস ছাড়া, আর কে আছে তেমন? যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কেউ আছে আর!”

“ একবার সকালের নাস্তার সময় আমার ও অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথু হেইডেনের লেগে গেল। পারলে দুজন পরস্পরকে মারতে যাই! মাঠে নামার পর আমাদের আরেকদফা কথার লড়াই হলো। তার শরীর তো ছিল আমার দ্বিগুণ। তবে আমি সোজা বলে দিয়েছিলাম, এসব লড়াইয়ে শারীরিক আকৃতি কোনো ব্যাপার নয়!”

“ আমরা পরস্পরের সঙ্গে যা করেছি, খুব খারাপ ছিল। তবে দর্শক মজা পেয়েছে, আমি উপভোগ করেছি, সেও ছেড়ে কথা বলেনি।”

“ আমি তাকে বলেছিলাম, ‘তুমি তো আমার মতো সুদর্শন নও, তুমি খুবই কুৎসিত। এজন্যই আমি চাই তোমাকে আউট করতে যেন তোমার চেহারা দেখতে না হয়।”

“আইসিসি সুপার সিরিজে একবার, আমি চোট পেয়েছিলাম। ফ্রেডি (অ্যান্ড্রু) ফ্লিন্টফকে বললাম যে আমি ফিট নই। সে বলল, ‘তুমি তো বরারই আনফিট। তোমাকে দেখতে লাগে টারজানের মতো, কিন্তু বল করো জেনের মতো।”

“পরেরবার সে যখন ইংল্যান্ডের হয়ে পাকিস্তান সফরে এলো, কথার লড়াই শুরু হলো তাকে দিয়েই। আমি তাকে বলেছিলাম, অস্ট্রেলিয়ায় ওই কথাটি বলে সে আমাকে তাতিয়ে দিয়েছে।”

“ওই সিরিজে আমি সবচেয়ে জোরে বল করেছি। এমনকি, শেষ স্পেল ছিল প্রথমটির চেয়ে দ্রুতগতির। ফ্রেডি খুব বাজেভাবে চোট পেয়েছিল, ওর কোনো জবাব ছিল না। সেই সিরিজে বেশ কয়েকবার ওকে আউট করেছিলাম।”

“ তবে এই ধরণের চরিত্র খেলাটায় আবার ফিরে আসা উচিত।”

ভালোবাসার বুনো প্রকাশ

(সতীর্থদের সঙ্গে ঝামেলায় ঝড়িয়ে নানা সময়ই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন শোয়েব। প্রতিপক্ষের সঙ্গেও লেগেই ছিল নানা কিছু নিয়ে। আবার মাঠের বাইরে সুসম্পর্কও দেখা গেছে অনেকের সঙ্গে। শোয়েব বললেন সেসব নিয়ে, জানালেন ভালোবাসা প্রকাশের বিচিত্র ধরনের কথাও)

“ কুস্তি মানে আমার কাছে কোনো লড়াই ছিল না, এটি ছিল আসলে লোকের প্রতি আমার ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম। সত্যি বলতে, সীমা ছাড়িয়েই ফেলতাম। আমি যখন কাউকে পছন্দ করি, তাকে তুলে ছুঁড়ে মারি!”

“ যুবরাজের পিঠ ভেঙে দিয়েছি আমি, এর আগে শহিদ আফ্রিদিকে জড়িয়ে ধরে পাঁজর ভেঙে ফেলেছি, আব্দুল রাজ্জাকের হ্যামস্ট্রিংয়ে একটু বেশিই টান লাগাতে বাধ্য করেছি।”

“ মানুষের প্রতি আমার ভালোবাসা প্রকাশের ধরনটিই বুনো। তরুণ বয়সে একটু নির্বোধ ছিলাম, নিজের শক্তি সম্পর্কেও ধারণা ছিল না।”

“ ক্যারিয়ারে দু-একবার ঝামেলা জড়িয়েছি (সতীর্থদের সঙ্গে), তবে এমনিতে দলের সঙ্গে সম্পর্ক উপভোগই করেছি আমি। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে হয়তো নয়, তবে সতীর্থদের সঙ্গে অনেক ভালো সময় কাটিয়েছি।”

“যদিও সতীর্থদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে ভালো লেগেছে, তবে ম্যাচের পর তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে কখনও উপভোগ করিনি। একাই সব করতাম।”