ক্যারিবীয় মহানায়ক যেবার খেলেছিলেন ঢাকায়

চোটের কাছে হার মেনে ৩৩ বছর বয়সেই টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন এভারটন উইকস। কিন্তু ক্রিকেট প্রেমে মগ্ন মনের তেষ্টা তো তখনও মেটেনি! আত্মার খোরাক জোগাতে তাই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, এমসিসি, কমনওয়েলথ একাদশের মতো দলগুলিতে খেলে গেছেন উইকস। সফরও করেছেন অনেক। সেই পথচলাতেই একবার তার পা পড়েছিল ঢাকায়।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2020, 12:43 PM
Updated : 6 July 2020, 12:43 PM

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লিউ’-এর একজন, স্যার এভারটন উইকস ৯৫ বছর বয়সে মারা গেছেন গত বুধবার। এই ক্যারিবিয়ান মহানায়কের বিদায়ের পর থেকেই ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে চলছে তার বন্দনা। স্মৃতিচারণা করছেন অনেকেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটার, ক্রিকেট কোচ, প্রথিতযশা ক্রীড়া লেখক ও শ্রদ্ধেয় ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব জালাল আহমেদ চৌধুরি নিজের ফেইসবুক পাতায় তুলে ধরলেন উইকসের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগসূত্র। ৫৮ বছর আগে ঢাকায় খেলে গেছেন এই কিংবদন্তি। আরেকটু খুঁজে উইকসদের সেই সফরের বিস্তারিত অনেক কিছুও পাওয়া গেল।

দারুণ সমৃদ্ধ রেকর্ড হলেও ক্যারিয়ারকে ঠিক পূর্ণতা দিতে পারেননি উইকস। টেস্টে তার গড়া দ্রুততম হাজার রানের রেকর্ড টিকে আছে এখনও। তার টানা ৫ ইনিংসে সেঞ্চুরির কীর্তি ছুঁতে পারেননি কেউ। খেলেছেন আরও দুর্দান্ত সব ইনিংস। তার কাছ থেকে টেস্ট ক্রিকেটেরও পাওয়ার ছিল আরও অনেক কিছু। কিন্তু পিছু না ছাড়া চোটে বিরক্ত হয়ে বাধ্য হন টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে।

তবে দুর্দান্ত পায়ের কাজ ও স্ট্রোকের ছটায় মুগ্ধতা ছড়ানোর অধ্যায় শেষ নয় তখনই। কিছুদিন বিরতির পর উইকস আবার ফেরেন ক্রিকেটে। বারবাডোজের হয়ে খেলতে থাকেন। তার ব্যাটিং শৈলীর রাজত্ব প্রসারিত করেন ইংলিশ ক্রিকেটেও। সেখানকার লিগ ক্রিকেটে তার ব্যাট থেকে রান আসে বানের জলের মতো।

টেস্ট ক্রিকেট পরবর্তী জীবনেও তিনি নানা দেশ সফর করেছেন বিভিন্ন দলের হয়ে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইলেভেন’ ছিল তেমনই এক দল। ১৯৬২ সালে বিশ্ব সফরে বের হয়েছিল দলটি। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই দলের পদচারণায় মুখর হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বের নানা প্রান্ত। সেই আন্তর্জাতিক একাদশের তারকারাজিতে উইকস ছিলেন যেন ধ্রুবতারা। অনেকগুলো ম্যাচে নেতৃত্বও দেন। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের শুরুর দিক পর্যন্ত কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ৮টি ম্যাচ খেলে দলটি পা রেখেছিল সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে।

একটিই ম্যাচ ছিল এখানে, আন্তর্জাতিক একাদশের প্রতিপক্ষ পূর্ব পাকিস্তান গভর্ণর একাদশ। নামে পূর্ব পাকিস্তান দল হলেও খেলেছিল একরকম পাকিস্তানের মূল দলই। হানিফ মোহাম্মদের নেতৃত্বে সেই দলে ছিলেন হানিফের ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ, সাইদ আহমেদ, শহিদ মাহমুদ, জাভেদ আখতার, মাহমুদ হুসাইনের মতো ক্রিকেটাররা। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অনেক বঞ্চনার মতো ক্রিকেটেও এ অঞ্চলের বঞ্চনার একটি স্বাক্ষী ওই ম্যাচ। পূর্ব পাকিস্তান একাদশে পূর্ব পাকিস্তানের ক্রিকেটার রাখা হয়েছিল কেবল একজন, মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ।

এই লতিফও বাঙালি ছিলেন না। অবিভক্ত ভারতের মহারাষ্ট্রে তার জন্ম। পরে চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। ৩৬টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা লেগ স্পিনিং অলরাউন্ডার স্বাধীনতার আগেই চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। বয়স এখন ৮০ পেরিয়ে গেছে।

আন্তর্জাতিক একাদশের নেতৃত্বে ছিলেন রে লিন্ডওয়াল। অস্ট্রেলিয়ার এই গ্রেট ফাস্ট বোলার ততদিনে টেস্ট ক্রিকেট ছেড়েছেন। দলে ছিলেন উইকসের বারবাডোজ সতীর্থ রয় মার্শাল, ইংল্যান্ডের টম গ্র্যাভেনি, নর্মান গিফোর্ড, ভারতের সুভাষ গুপ্তে, অস্ট্রেলিয়ার কলিন ম্যাকডোনাল্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার কলিন ব্লান্ডের মতো তারকা।

ছবি: ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজ

তখনকার ঢাকা স্টেডিয়াম, এখন যেটির গৌরবময় পরিচয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, সেখানেই ১০ মার্চ শুরু হয় তিন দিনের ম্যাচটি।

টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা গর্ভণর একাদশকে দারুণ শুরু এনে দেন হানিফ মোহাম্মদ ও শহিদ মাহবুব। সুভাস গুপ্তের লেগ স্পিনে শহিদের বিদায়ে ভাঙে ১০০ রানের জুটি। হানিফ পরে ৭৭ রান করে আউট হন বাঁহাতি স্পিনার গিফোর্ডের বলে। তৃতীয় উইকেটে ২১২ রানের জুটি গড়েন সাইদ আহমেদ ও ওয়াজির মোহাম্মদ। ১৪৯ রানে আউট হন সাইদ, ওয়াজির অপরাজিত থেকে যান ১০০ রানে। পূর্ব পাকিস্তান একাদশ ইনিংস ঘোষণা করে ৫ উইকেটে ৩৮৫ রানে।

এই অঞ্চলের একমাত্র প্রতিনিধি এমএ লতিফ সাতে নেমে অপরাজিত ছিলেন শূন্য রানে।

ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে ঢাকার দর্শকরা সুযোগ পান উইকসকে দেখার। তবে অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী এই মাঠ উইকসকে মনে রাখার মতো স্মৃতি খুব বেশি পায়নি। ১৬ রানেই জাভেদ আখতারের অফ স্পিনে বোল্ড হয়ে যান তিনি।

ঢাকার দর্শকদের প্রাপ্তি অবশ্য কম ছিল না। সর্বকালের সেরা ফিল্ডারদের একজন বলে বিবেচিত কলিন ব্লান্ড তার ফিল্ডিংয়ের জাদু কতটা দেখাতে পেরেছিলেন, সেটি এখন জানার উপায় খুব একটা নেই। তবে স্কোরকার্ড স্বাক্ষ্য দিচ্ছে, ৮৯ রানের ইনিংস খেলে ব্যাটিং আনন্দ তিনি ঠিকই উপহার দিয়েছিলেন। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার ইংলিশ ব্যাটসম্যান গ্র্যাভেনি অপরাজিত থাকেন ৪৭ রানে। ২৬৬ রানে শেষ হয় আন্তর্জাতিক একাদশের ইনিংস। পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে তিনটি করে উইকেট নেন পাকিস্তানের দুই টেস্ট পেসার মাহমুদ হোসেন ও মোহাম্মদ ফারুক।

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং অর্ডার একটু ওলট-পালট করে পূর্ব পাকিস্তান একাদশ। কেউ খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। চারে নেমে এবার এমএ লতিফ ১০ রানে আউট গিফোর্ডের স্পিনে। দলের রান ৬ উইকেটে ৯৪ হওয়ার পর ম্যাচের সমাপ্তি।

সেই সময় মর্নিং নিউজ পত্রিকায় তৌফিক আজিজ খানের ম্যাচ রিপোর্টের বরাত দিয়ে জালাল আহমেদ চৌধুরী তার ফেইসবুক স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, নিউ জিল্যান্ডের ফ্লাইট ধরার তাড়া ছিল উইকসদের। তাই ম্যাচ শেষ হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের আধ ঘণ্টা আগে।

স্মৃতির ডানায় সেই সময়টায় ফিরে গিয়ে জালাল আহমেদ জানালেন, অনেক ইচ্ছে থাকার পরও ম্যাচটি দেখতে যেতে পারেননি।

“ঢাকায় এরকম একটি ম্যাচ হচ্ছে, এত বড় তারকারা এসেছেন, খুব ইচ্ছে ছিল মাঠে যাওয়ার। কিন্তু বাবার ভয়ে যেতে পারিনি। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, স্কুল বাদ দিয়ে মাঠে যেতে পারিনি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি যখন ঢাকা লিগে খেলা শুরু করি, বাসায় না জানিয়ে খেলতাম। তখন ২০ রান করলেই পত্রিকায় নাম আসত। আমি কোনো ম্যাচে রান করলে তাই পরদিন সকালে বাসার পত্রিকা সরিয়ে ফেলতাম যেন বাবার চোখে না পড়ে। কাজেই বলা বাহুল্য, স্কুল বাদ দিয়ে উইকসদের ম্যাচ দেখতে যাওয়ার উপায় ছিল না।”

অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সেরা ফাস্ট বোলারদের একজন লিন্ডওয়ালের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ ছিল ঢাকার সেই ম্যাচ।

আন্তর্জাতিক একাদশ ঢাকা থেকে নিউ জিল্যান্ডে গিয়ে তিনটি ম্যাচ খেলেছিল ক্রাইস্টচার্চ, ওয়েলিংটন ও অকল্যান্ডে। সেখানে দলে যোগ দেন রিচি বেনো, বব সিম্পসন, ইয়ান ক্রেইগের মতো তারকারা। পরে তারা হংকংয়ে তিনটি, ভারতের বোম্বেতে (এখনকার মুম্বাই) একটি ম্যাচ খেলে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে একটি ম্যাচ দিয়ে শেষ করে সফর।

টেস্ট ক্রিকেট ছাড়ার পর ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন উইকস, লিগ ও অন্যান্য ক্রিকেট খেলেছেন ১৯৬৭ পর্যন্ত। ঢাকার দর্শকরা তার সেরাটা দেখতে পাননি ওই ম্যাচে। তবে ঢাকার ক্রিকেট এমন একজন মহানায়কের ছোঁয়া পেয়েছে, স্রেফ এটুকুও তো কম নয়!