চলে গেলেন বাঁহাতি স্পিনের পথিকৃৎ রামচাঁদ গোয়ালা

বাংলাদেশের ক্রিকেটে বাঁহাতি স্পিনের অগ্রপথিক রামচাঁদ গোয়ালা আর নেই। শুক্রবার ভোরে ময়মনসিংহের বাসায় মারা গেছেন এক সময়ের জনপ্রিয় এই ক্রিকেটার। অনেকদিন থেকেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 June 2020, 06:07 AM
Updated : 19 June 2020, 08:25 AM

আন্তর্জাতিক ম্যাচ তো বহুদূর, কখনও আইসিসি ট্রফির ম্যাচ খেলার সুযোগও হয়নি। তার পরও গোয়ালা কিংবদন্তি আপন কীর্তিতেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটে বাঁহাতি স্পিনের যে জোয়ার, সেটির শুরু ছিল তার হাত ধরে। দারুণ পারফরম্যান্সে বছরের পর বছর রাঙিয়েছেন দেশের ক্রিকেট। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে খেলে গেছেন ৫৩ বছর বয়স পর্যন্ত!

লম্বা বাবরি চুল ও পুরু গোঁফের গোয়ালা ছিলেন দারুণ দর্শকপ্রিয় ক্রিকেটার। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে খেলেছেন ভিক্টোরিয়া, জিএমসিসি, মোহামেডান ও আবাহনীর মতো ক্লাবে। আশির দশক থেকে নব্বই দশকের শুরু পর্যন্ত আবাহনীতে খেলে একরকম হয়ে উঠেছিলেন ক্লাবের প্রতীক। জাতীয় দলেও খেলেছেন অনেক ম্যাচ।

গোয়ালার জন্ম ১৯৪১ সালে। ময়মনসিংহের বিখ্যাত সার্কিট হাউস মাঠে তার ক্রিকেটের শুরু। শৈশবে ছিলেন পেসার। স্কুল ক্রিকেটে খেলার সময় একজনের পরামর্শে থিতু হন স্পিনে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ময়মনসিংহ লিগে খেলার সুযোগ পান পন্ডিতপাড়া ক্লাবের হয়ে। ১৯৬২ সালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে অভিষেক ঢাকা লিগে।

বাবার মৃত্যুর পর ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ব্যক্তিগত কারণে ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন। পরে আবার শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে নাম লেখান মোহামেডানে। পরে ১৯৮১-৮২ মৌসুম থেকে ১৯৯২-৯৩ পর্যন্ত টানা খেলেছেন আবাহনীতে।

বিসিবি পরিচালক ও আবাহনী ক্লাবের দীর্ঘদিনের সংগঠক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম বললেন, তার দেখা বাংলাদেশের সেরা বাঁহাতি স্পিনার গোয়ালা।

“লালমাটিয়া ক্লাব থেকে আমিই তাকে আর নান্নুকে (মিনহাজুল আবেদীন) এনেছিলাম আবাহনীতে। গোয়ালা দার বয়স তখন ৪০ পেরিয়ে গেছে। তার পরও অসাধারণ পারফর্ম করেছেন বছরের পর বছর। তখন বোলারদের দিয়েই আমরা ম্যাচ জিততাম বেশি। সেই বোলিং আক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন গোয়ালা দা। বয়স তার পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলেনি। এত বছর টানা ভালো খেলে গেছেন, আবাহনী ক্লাবের একরকম প্রতীক বা আইকন হয়ে উঠেছিলেন তিনি।”

“আমি বলতে পারি, আমার দেখা বাংলাদেশের সেরা বাঁহাতি স্পিনার গোয়ালা দা। সেটি সত্যিকার অর্থেই। তার মতো এতটা অ্যাকুরেট স্পিনার আমি আর দেখিনি। ৬ ফুটের ওপর উচ্চতা ছিল, সেটি কাজে লাগাতেন বোলিংয়ে। বিশাল হৃদয় ক্রিকেটার ছিলেন, নিজেকে উজার করে দিতেন মাঠে।”

আহমেদ সাজ্জাদুল আলমের স্মৃতিচারণায় উঠে এলো, গোয়ালা ছিলেন ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ।

“গোয়ালা দা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। দারুণ টিমম্যান। জনপ্রিয়ও ছিলেন খুব। সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন, অনুপ্রেরণা জোগাতে পারতেন। টাকার কথা ভেবে কখনও খেলেননি। খেলে নিজে আনন্দ পেতেন, সবাইকে আনন্দ দিতেন। সত্যিকার অর্থেই তিনি একজন কিংবদন্তি।”

জাতীয় দলের হয়ে ভারত সফরে গেছেন গোয়ালা, দেশের মাটিতে খেলেছেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ঢাকা লিগে আবাহনীর হয়ে ম্যাচে আউট করেছেন মোহামেডানে খেলতে আসা লঙ্কান কিংবদন্তি অর্জুনা রানাতুঙ্গা, অরবিন্দ ডি সিলভাকে।

এই দেশে বাঁহাতি স্পিনের শুরুর নায়ক তিনি, এটি তাকে দারুণ তৃপ্তি দিত। কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সেটি।

“বাংলাদেশে বাঁহাতি স্পিনের পথিকৃৎ আমিই। ষাটের দশকে বাঁহাতি স্পিন ব্যাপারটা নতুন ছিল এই দেশে। আমাকে দিয়েই শুরু হয় প্রচলন।”

৫৩ বছর বয়সে ঢাকার ক্রিকেটে শেষবার খেলেছেন জিএমসিসির হয়ে। খেলা ছাড়ার পর ময়মনসিংহেই থাকতেন। বিয়ে করেননি। সার্কিট হাউস মাঠে বাচ্চাদের সঙ্গে ক্রিকেট আনন্দে মেতে সময় কাটত। পরে দুই দফা স্ট্রোক করায় শেষ কয়েকবছর তার জীবন ছিল অনেকটাই ঘরবন্দি। সেখানেই নিভে গেল দেশের ক্রিকেটের উজ্জ্বল এক তারা।