তাসকিনের ৫ উইকেটের ৬ বছর ও আশা-হতাশার গল্প

গতি, নিয়ন্ত্রণ, সুইং, কাটার, বাউন্স, আগ্রাসন, সব মিলিয়ে বিধ্বংসী বোলিং। অভিষেক ওয়ানডের স্মরণীয় সেই পারফরম্যান্সের ভিডিও বুধবার নিজের অফিসিয়াল ফেইসবুক পাতায় পোস্ট করেছেন তাসকিন আহমেদ। ৬ বছর পূর্তিতে অভিষেকের দিনটিতে একটু ফিরে তাকানো! তাসকিনের সেই বোলিং যেমন দোলা দেয় রোমাঞ্চের, তেমনি এখন জাগায় হাহাকার। ক্রিকেট অনুসারীদের মনে যেমন, স্বয়ং তাসকিনের মনেও!

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2020, 09:50 AM
Updated : 17 June 2020, 10:05 AM

সেই দীর্ঘশ্বাসকে অবশ্য খুব দীর্ঘ হতে দেন না তাসকিন। বরং চনমনে হয়ে ওঠেন নতুন স্বপ্নের বুননে। পেছনের ৬ বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে সঙ্গী করেই ছুটতে চান সামনের পথচলায়, আরও অন্তত ১০ বছর।

ক্যারিয়ার নতুন করে সাজাতে চান বলেই নিজেকে ভেঙে গড়ার চেষ্টা করছেন। করোনাভাইরাসের কারণে গত তিন মাস ক্রিকেট বন্ধ থাকলেও জিমে খেটে ওজন কমিয়েছেন পাঁচ কেজি। বাসার গ্যারেজে বোলিংও করে যাচ্ছেন টুকটাক।

অবসরে নিজের পুরনো ভিডিও অনেক সময়ই দেখেন তাসকিন। অভিষেকের পারফরম্যান্স তার নিজের খুব প্রিয়। ২০১৪ সালের ১৭ জুন, বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন যখন বুঁদ ফুটবল বিশ্বকাপে, মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে তখন ইতিহাস গড়েছিলেন তাসকিন। ভারতের বিপক্ষে নিয়েছিলেন ২৮ রানে ৫ উইকেট। সেই প্রথম, ওয়ানডে অভিষেকে ৫ উইকেটের স্বাদ পেয়েছিলেন বাংলাদেশের কেউ।

ওই ওয়ানডের আগেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন তাসকিন। তবে নিজের আগমণী বার্তা প্রবলভাবে জানান দেন প্রথম ওয়ানডে দিয়েই। একদিনের ক্রিকেটে অভিষেকের ৬ বছর পূর্তির দিনটিতে তাসকিনের মনে চলছে মিশ্র অনুভূতির খেলা।

“অভিষেক ম্যাচটা ছিল অন্য লেভেলের। অন্যরকম রোমাঞ্চ ছিল। কোনোদিন ভুলতে পারব না। অনেক আশা নিয়েই নেমেছিলাম। কিন্তু এত ভালো কল্পনাও করিনি। এখন ভাবলে একটু মন খারাপও লাগে। অভিষেকের পারফরম্যান্সই এখনও আমার সেরা বোলিং। হ্যাটট্রিক করেছি, ভালোও করেছি কিছু ম্যাচে। কিন্তু সেরাটাকে ৬ বছরেও ছাড়াতে পারিনি।”

তাসকিনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এখন ৫ টেস্ট, ৩২ ওয়ানডে ও ১৯ টি-টোয়েন্টির। একমাত্র ৫ উইকেট সেই অভিষেক ওয়ানডেতেই।

৬ বছরের খেরোখাতা

সাড়া জাগানো ওয়ানডে অভিষেকের ৬ বছর হয়ে গেল। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স আরও আড়াই মাস বেশি। নিজের অবস্থান মূল্যায়নের জন্য এই সময়টুকু যথেষ্টই। আপন আয়নায় তাকিয়ে তাসকিন আঁকলেন নিজের ছবি।

“প্রথম তিন বা সাড়ে তিন বছর ছিল স্বপ্নের মতো। যা চেয়েছি, সবই প্রায় হয়েছে। পরের দুই-আড়াই বছর পুরো উল্টো। ইনজুরি, ফর্ম হারানো, দলের বাইরে চলে যাওয়া, অনিয়মিত হয়ে পড়া, একজন খেলোয়াড় হিসেবে কখনোই চাইনি এসব। সত্যি যদি বলেন, আমার সম্ভাবনা যতটা ছিল, তার খুব কমই করতে পেরেছি। ৬ বছরে যেখানে থাকা উচিত ছিল, সেখান থেকে অনেকটা পেছনে আছি।”

“তবে এসবও জীবনের অংশ। জীবনে সবই শিক্ষা। আমার নিজের কিছু গাফিলতি ছিল, অনেক ভুল করেছি। কিছু কিছু জিনিস সম্পর্কে খুব ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। সবকিছুই আমার জন্য শিক্ষা। এসব থেকেই নিজেকে আরও ভালোভাবে মেলে ধরতে চাই সামনে।”

নিজের ভুল ও গাফিলতির কথা গত কিছুদিনে বেশ কবারই বলেছেন তাসকিন। সেই উপলব্ধি বাড়িয়ে দিয়েছে তার তাড়না। আত্মদহনেই পরিশুদ্ধ করতে চান নিজেকে।

“আমার লাইফস্টাইলই আমাকে অনেকটা পেছনে ঠেলে দিয়েছে। তখন বুঝিনি। ভেবেছিলাম, বল করলেই উইকেট মেলে। সেটার জন্য মাঠের বাইরে যে কত পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, বুঝতাম না। সিনিয়র ক্রিকেটাররা ডায়েট করতেন, খাটতেন। আমাকেও বলতেন। আমি তখন কান দেইনি। ইচ্ছামতো খেয়েছি। যথেষ্ট ভালোভাবে নিজেকে প্রস্তুত করিনি।”

“সময় আমাকে সবই বুঝিয়ে দিয়েছে। আমি মনে করি, দুঃসময়টা আমার জন্য ভালোই হয়েছে। এই শিক্ষা কাজে লাগাতে পারলে ভবিষ্যতে আমার ক্রিকেট ও জীবন, দুটিই অনেক ভালো হবে।”

ভবিষ্যতের ছবি

নিজেকে নতুন করে প্রমাণের লক্ষ্য নিয়েই গত মার্চে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ শুরু করেছিলেন তাসকিন। কিন্তু করোনাভাইরাসের থাবায় থমকে গেছে ক্রিকেট। তিনি অবশ্য থমকে যাননি। জানালেন, সময় এলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে তৈরি রাখছেন নিজেকে।

“লিগের প্রথম ম্যাচটি যখন খেলি, আমার ওজন ছিল ৮১ কেজি। এখন ৭৫-৭৬ এর মধ্যে থাকছে। নিয়মিত ফিটনেস ট্রেনিং করছি। ধানমণ্ডিতে একটি জিম আছে, নাম ‘মাসলম্যানিয়া’, সেখানে দেবু দা ও জিন্নাহ ভাই লকডাউনের সময়ও এক-দেড় ঘণ্টা খুলে দিয়েছেন স্রেফ আমার জন্য। এখন জিম খুলে গেছে, তারপরও আমি গেলে ওই সময় আর কাউকে ঢুকতে দেন না। তারা বলেন, ‘আপনি বাংলাদেশের সম্পদ, আপনি ভালো করলে দেশেরই লাভ।’ তাদের কথাগুলি আমাকে খুব স্পর্শ করেছে।”

“সিনিয়র ক্রিকেটাররা যা বলতেন আগে, এখন সবই করার চেষ্টা করছি। ডায়েট নিয়ে আমার পরিবারও অনেক সাহায্য করছে। ট্রেনিং এখন বুঝেশুনে করি। আগে যখন করতাম, শুধু মাসল বাড়িয়ে মানুষকে দেখানোর একটা ভাবনা কাজ করত। এখন আমি জানি, একজন ফাস্ট বোলারের কীভাবে ট্রেনিং করা উচিত। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, বাকিটা ওপরওয়ালার হাতে।”

নিজেকে ফিরে পাওয়ার এই লড়াইয়ে তাসকিনের শৈশবের নায়ক এখনও তার বড় অনুপ্রেরণা।

“আমার একটা সুবিধা হলো, ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও বয়স কেবল ২৫। মাশরাফি ভাইকে দেখেছি, ৩০ বছর পেরিয়েও কত কিছু অর্জন করেছেন। কোন জায়গায় নিজেকে নিয়ে গেছেন। আমার তো সামনে অনেক সময় আছে। আরও ১০ বছর খেলতে চাই। শুধু খেলার জন্য খেলা নয়, সত্যিকার অর্থেই নিজের সেরাটা দিয়ে দলে অবদান রাখতে চাই।”

এক সময় ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টিতে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য অংশ। পরে টেস্ট খেলেছেন, রেকর্ড খুব ভালো নয়। তবে আপাতত তার নিকট ভবিষ্যতের স্বপ্ন টেস্ট ক্রিকেটকে ঘিরেই।

“গত দুইবার যখন আমি জাতীয় দলে ছিলাম, টেস্ট স্কোয়াডেই জায়গা পেয়েছি। একসময় হয়তো ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতেই আমাকে ভাবা হয়েছে। কিন্তু এখন দল ভাবছে, আমিও নিজেকে টেস্টের জন্য আগের চেয়ে বেশি প্রস্তুত মনে করি। আর সত্যি কথা বললে, টেস্টে ভালো করলে ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি অনেক সহজ হয়ে যাবে।”

“আমি সেভাবেই ট্রেনিং করার চেষ্টা করছি। এখন খেলা নেই, সময়টা হতাশার বটে। তারপরও নিজেকে প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করছি যেন শুরু হলেই নিজের সেরাটা দিতে পারি। খুব ভালো করার নিশ্চয়তা তো কেউ দিতে পারে না। তবে প্রক্রিয়াটা ঠিক থাকবে এখন থেকে, এই কথা আমি দিতে পারি।”