রূপকথাকে হার মানানো এক জুটির গল্প

অগণিত জুটি দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট। দ্রাবিড়-টেন্ডুলকার, জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারা, হেইডেন-ল্যাঙ্গার, গ্রিনিজ-হেইন্সের মতো দারুণ সব জুটি। তবে জ্যাক হবস ও হার্বার্ট সাটক্লিফ মিলে জন্ম দিয়েছিলেন এমন এক গল্পের, যার ধারে কাছে যেতে পারেনি আর কোনোটি। তাদের জুটির কীর্তিগাথা চিরস্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছে ক্রিকেটীয় রূপকথায়।

আবু হোসেন পরাগবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2020, 10:16 AM
Updated : 14 June 2020, 11:48 AM

হবস ও সাটক্লিফের অবিশ্বাস্য সেই জুটির পথচলা শুরু হয়েছিল ৯৬ বছর আগে এই দিনে। ১৯২৪ সালের ১৪ জুন, এজবাস্টনে প্রায় ৩০ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল সাটক্লিফের; প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই দিনই ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমেছিলেন হবস ও সাটক্লিফ।

টেস্ট ক্রিকেটে হবস ততদিনে পার করে দিয়েছেন দেড় দশক। তখন পর্যন্ত টেস্টে শুরুর জুটিতে হাজার রান ছিল কেবল একটির। উইলফ্রেড রোডসের সঙ্গে সেই জুটির অংশও ছিলেন হবস। ৬১.৩১ গড়ে সেই জুটির রান ২১৪৬। পরের ছয় বছরে হবস-সাটক্লিফ জুটি স্পর্শ করে নতুন উচ্চতা, জায়গা করে নেয় ইতিহাসের পাতায়।

১৯২৪ থেকে ১৯৩০, হবস-সাটক্লিফ টেস্টে ইনিংসের শুরুতে একসঙ্গে ব্যাটিং করেন ৩৮ ইনিংসে। তাদের জুটিতে রান আসতে থাকে অনেকটা বানের স্রোতের মতো। সে সময়ে উদ্বোধনী জুটিতে রেকর্ড ৩২৪৯ রান করেছিলেন তারা ৮৭.৮১ গড়ে। টেস্ট ইতিহাসে উদ্বোধনী জুটিতে অন্তত তিন হাজার রান করা আর কোনো জুটির গড় তাদের ধারে কাছেও নেই। সবচেয়ে কাছে থাকা জুটির (বিল লরি ও বব সিম্পসনের ৬০.৯৪) চেয়ে যা বেশ এগিয়ে।

তাদের ৩৮ ইনিংসের ১৫টিই ছুঁয়েছিল তিন অঙ্ক। শুরুর জুটিতে বেশি সেঞ্চুরি জুটি আছে কেবল গর্ডন গ্রিনিজ ও ডেসমন্ড হেইন্সের। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই জুটির ১৬টি সেঞ্চুরির জন্য লেগেছিল ১৪৮ ইনিংস।

গড়ে ২.৫৩ ইনিংসে একটি করে সেঞ্চুরি এসেছে হবস-সাটক্লিফ জুটিতে। সেঞ্চুরির হিসেবে শুরুর জুটিতে অন্তত তিন হাজার রান করা অন্য আট জুটির মধ্যে দ্বিতীয় সেরা গড় সুনীল গাভাস্কার-চেতন চৌহানের। প্রতিটি সেঞ্চুরির জন্য এই জুটির লেগেছে গড়ে ৫.৯ ইনিংস (৫৯ ইনিংসে ১০ সেঞ্চুরি)। গ্রিনিজ-হেইন্স জুটিতে সেঞ্চুরি হয়েছে গড়ে ৯.২৫ ইনিংসে।

হবস-সাটক্লিফ জুটির পথচলার শুরুটা ছিল রাজকীয়; তিন অঙ্কের। এজবাস্টনে সাটক্লিফের অভিষেক ইনিংসের সেই দিনে জুটির রান ছিল ১৩৬। লর্ডসে পরের ম্যাচে তাদের জুটি ছুঁয়ে ফেলে দুইশ। ২৬৮ রানের ওই জুটি তখন ছিল উদ্বোধনী জুটিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সেই দুই টেস্টে ইংল্যান্ডের জয়ের ব্যবধান ছিল একই, ইনিংস ও ১৮ রানে!

ওই সিরিজে পরের তিন ইনিংসে আর সেঞ্চুরি ছুঁতে পারেনি তাদের জুটি। তবে পরের সিরিজ অ্যাশেজে টানা তিন ইনিংসে উপহার দেন তারা তিনটি সেঞ্চুরি জুটি! দুই ইনিংস পর আরেকটি। টানা তিন ইনিংসে সেঞ্চুরি জুটি গড়েছিলেন তারা পরে আরও একবার।

তাদের জুটিতে সাফল্য যত বেশি, ব্যর্থতা ঠিক ততটাই কম। ৩৮ জুটির মধ্যে ২০ রানের কমে শেষ হয়েছে কেবল ৬টি। মোট ইনিংসের যা ১৬ শতাংশের কম। শুরুর জুটিতে সবচেয়ে বেশি রান (৬৪৮২) করা গ্রিনিজ-হেইন্সের ১৪৮ ইনিংসের মধ্যে ২০ রানের কমে ভেঙেছে (অপরাজিত বাদে) ৬০টি। শতকরা হিসেবে ৪০.৫৪ শতাংশ।

তবে শুধু পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে না হবস-সাটক্লিফ জুটির ওজন। তারা যে যুগে ব্যাটিং করেছেন, তখন উইকেট ঢেকে রাখার কোনো ব্যাপার ছিল না। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে অনেক সময়ই উইকেট হয়ে উঠত ব্যাটসম্যানদের জন্য মরণফাঁদ। সে যুগেই ভয়ঙ্কর সব বোলারকে সামলেছেন তারা হেলমেট ছাড়া। করেছেন রান উৎসব।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রেকর্ড ১৯৯ সেঞ্চুরির মালিক হবস ছিলেন ক্ল্যাসিকাল ব্যাটসম্যানশিপের এক অনন্য উদাহরণ। যে কারণে তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘দ্য মাস্টার।’ আর সাটক্লিফ অমূল্য হয়ে উঠেছিলেন তার অসাধারণ ধৈর্য আর একাগ্রতার জন্য। তার টেম্পারমেন্ট ছিল দুর্দান্ত। তাকে নিয়ে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ডন ব্র্যাডম্যান যেমন বলেছেন, “তিনি ছিলেন দুর্দান্ত খেলোয়াড়। আমি যাদের বিপক্ষে ও সঙ্গে খেলেছি, তাদের মধ্যে তার টেম্পারমেন্ট ছিল সেরা।”

হবস-সাটক্লিফ জুটির সেরা পারফরম্যান্সের দেখা মিলেছিল ১৯২৬ সালের ওভাল টেস্ট ও ১৯২৮-২৯ সালের মেলবোর্ন টেস্টে। দুবারই কঠিন পরিস্থিতিতে, কঠিন উইকেটে দারুণ সব বোলারদের বিপক্ষে তাদের অসাধারণ পারফরম্যান্স নিশ্চিত করেছিল ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ জয়।

সিরিজের প্রথম চার টেস্ট ড্র হওয়ায় ওভালের ম্যাচটি হয়ে উঠেছিল সিরিজ নির্ধারণী। ২২ রানে পিছিয়ে থেকে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে নেমেছিল ইংল্যান্ড। আগের রাতে হয়ে যাওয়া তুমুল বৃষ্টিতে তৃতীয় দিন হবস-সাটক্লিফের সামনে ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। দলের লিড তখন কেবল ২৭।

অস্ট্রেলিয়া বোলিং শুরু করেছিল দুই প্রান্তে দুই স্পিনার দিয়ে; একদিকে লেগ স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেট, আরেক দিকে বাঁহাতি চার্লস ম্যাকার্টনি। বল স্পিন করছিল বেশ। একটা সময় প্রায় ৪০ মিনিট কোনো রানই করেননি সাটক্লিফ। ম্যাকার্টনি ৯ ওভারে দেন কেবল ২ রান। দিনের প্রথম ২০ রানই আসে হবসের ব্যাট থেকে।

পরে সূর্যের দেখা মিললে উইকেট হয়ে ওঠে আরও কঠিন। সেখানেই অস্ট্রেলিয়ান পেস-স্পিন দারুণভাবে সামলে হবস-সাটক্লিফ গড়েন ১৭২ রানের জুটি। বড় সংগ্রহের পর ইংল্যান্ড ম্যাচও জিতেছিল বড় ব্যবধানে। হবস করেছিলেন ঠিক ১০০ রান। সাটক্লিফ ১৬১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ৪২৮ মিনিট উইকেটে থেকে।

পরে মেলবোর্নের সে টেস্টেও সাটক্লিফ খেলেছিলেন প্রায় চারশ মিনিট স্থায়ী ইনিংস। সেটি ছিল আবার সেই সময়ের তরুণ ব্যাটসম্যান ব্র্যাডম্যানের কেবল দ্বিতীয় টেস্ট। দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন তার প্রথম সেঞ্চুরি। প্রথম ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন ইংল্যান্ডের ওয়ালি হ্যামন্ড।

চতুর্থ ইনিংসে ইংলিশদের সামনে লক্ষ্য ছিল ৩৩২ রানের। সফরকারীরা পেয়েছিল ৩ উইকেটের রোমাঞ্চকর এক জয়। যেটির ভিত গড়ে দিয়েছিল মূলত হবস-সাটক্লিফের ১০৫ রানের জুটি। হবস সেবার থেমেছিলেন ৪৯ রানে। তবে সাটক্লিফ সাড়ে ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ব্যাটিং করে খেলেন ১৩৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। আউট হন দলের জয় থেকে স্রেফ ১৪ রান দূরে থাকতে। টানা তৃতীয় জয়ে ইংল্যান্ড নিশ্চিত করে সিরিজ।

১৯৩০ সালে হবসের টেস্ট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটলে থেমে যায় তাদের জুটির পথচলাও। সাটক্লিফ এরপর টেস্ট খেলেন আরও পাঁচ বছর। 

হবসের সঙ্গে জুটিতেই নয় কেবল, সাটক্লিফের ব্যক্তিগত গড়ও দুর্দান্ত। ওপেনিংয়ে ৮৩ ইনিংসে ৪৫২২ রান করেছেন ৬১.১০ গড়ে। অন্তত ২০ ইনিংস খেলা ওপেনারদের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।