মাঠ থেকে দেখা: সাকিব-তামিমের শৌর্যে অস্ট্রেলিয়া-বধ কাব্য

প্যাট কামিন্সের একেকটি শট কাঁপন ধরাচ্ছিল বুকে। পিন পতন নীরবতা নেমে আসছিল স্টেডিয়ামে। আবার জশ হেইজেলউড স্ট্রাইকে এলেই গ্যালারিতে ফিরছিল প্রাণ। বল প্যাডে লাগলেই সমস্বরে চিৎকার! রোমাঞ্চ-উত্তেজনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল যেন। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারির সেই ঢেউয়ে ভাসছিলেন মেহেদী হাসানও। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয়ের সাক্ষী হতে তিনি এসেছিলেন মাঠে। শেষ জুটির সেই রুদ্ধশ্বাস সময়ে শঙ্কা-সম্ভাবনার দোলাচলে দুলছিলেন তিনি প্রবলভাবে। শেষ পর্যন্ত মাঠ ছেড়েছিলেন ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2020, 01:40 PM
Updated : 15 May 2020, 08:39 PM

২০১৭ সালের অগাস্ট, ইতিহাস গড়া সেই মিরপুর টেস্ট। অসাধারণ অলরাউন্ড নৈপুণ্যে অর্জনের মুকুটে নতুন পালক যোগ করেছিলেন সাকিব আল হাসান। ব্যাটিং দৃঢ়তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তামিম ইকবাল। বাঁক বদলের নানা ধাপ পেরিয়ে চতুর্থ দিনের মাঝ দুপুরে ধরা দিয়েছিল জয়। বাংলাদেশ রচনা করেছিল অস্ট্রেলিয়া-বধ কাব্য।

বাংলাদেশের রোমাঞ্চকর কিছু ম্যাচ ও স্মরণীয় পারফরম্যান্স যারা মাঠে বসে দেখেছেন, তাদের নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ধারাবাহিক আয়োজন, ‘মাঠ থেকে দেখা।’ এই পর্বে সেই সময়ের ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টার্নেটিভের (ইউডা) ছাত্র মেহেদী হাসানের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারানোর গল্প।

আগ্রহের শুরু সিরিজ শুরুর আগেই  

সফরের পেছনের গল্পটা বেশ লম্বা। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। নিরাপত্তা শঙ্কায় সে সময়ে আসেনি তারা। কয়েকবারের পরিদর্শনে নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে ২০১৭ সালের অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে সফরের সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তখন জেরবার ক্রিকেটারদের বেতন কাঠামো নিয়ে। অনুশীলন বন্ধ। জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘এ’ দলের একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ার নাম। বাংলাদেশ সফরের আগে ডারউইনে অনুশীলন ক্যাম্পে যোগ দেন ক্রিকেটাররা। তবে শর্ত ছিল, বেতন কাঠানো নিয়ে অচলাবস্থার সমাধান হলেই বিমানে উঠবেন তারা। শেষ পর্যন্ত সমাধান হয়। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আসে স্মিথের দল।

সফরের শুরুতেই বিপত্তি। দুই দিনের প্রস্তুতি ম্যাচের ভেন্যু খান সাহের ওসমান আলী স্টেডিয়াম ছিল পানিতে সয়লাব। শুরুর আগেই বাতিল হয়ে যায় প্রস্তুতি ম্যাচ।

মাঠের বাইরে চলতে থাকে কথার লড়াই। সেই সময়ের বাংলাদেশ কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, ২-০ ব্যবধানে জয় ছাড়া ভাবছেন না কিছু। সুর মেলান সাকিব-মুশফিক। দলের অন্যদের আত্মবিশ্বাসও বাড়তে থাকে, অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব।

দলের সেই বিশ্বাস ছড়িয়ে গিয়েছিল সমর্থকদের মধ্যেও। সেই বিশ্বাসই মেহেদীকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মাঠে।

“সব মিলিয়ে যে আবহ ছিল, তাতে ঢাকা টেস্ট নিয়ে যে কোনো ক্রিকেটপ্রেমীরই আগ্রহ থাকার কথা। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে না আসায় মনে একটা ক্ষোভ ছিল। ওদের বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলায় আবার সফর না হওয়ার শঙ্কা ছিল। ভাবছিলাম, কেবল আমাদের এখানে খেলতে আসার কথা হলেই কেন এমন হয়! আসুক একবার, দেখিয়ে দিব।”

“দেখিয়ে দিতে পারার আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল সেই সময়ের খেলা দেখেই। আগের বছর মিরপুরেই ইংল্যান্ডকে এক সেশনে ধসিয়ে দিয়ে জিতেছিলাম আমরা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টের আগে কলম্বোয় আমাদের শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছি। জয়ের একটা আশা তাই ছিল। সিরিজ শুরুর আগেই জমে উঠেছিল কথার লড়াই। ম্যাচে এর প্রতিফলন দেখতে পাঁচ দিনেরই টিকেট কিনে ফেলেছিলাম। মাঠে ছিলাম প্রথম দিন থেকেই।”

বাদ যাবে না একটা বলও

নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল বেশ কড়া। কয়েক স্তরের নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল স্টেডিয়াম ও এর আশেপাশের এলাকা। আগের দিন লাইন ধরে ইনডোর স্টেডিয়াম থেকে টিকেট কেনা মেহেদী পণ করেছিলেন, উঠতে হবে সকালে, যেন মিস হয় না একটি বলও।

“বাসা মিরপুরে হওয়ায় সুবিধা। তাই কোনো বল মিস করতে চাইনি। এত আগ্রহের একটা ম্যাচ, মাঠে থেকে দেখতে চেয়েছি সবটুকু। টস জিতে বাংলাদেশ ব্যাটিং নেওয়ায় আশায় ছিলাম বড় একটা সংগ্রহের। তামিম আর সাকিব যেভাবে ব্যাট করছিল তাতে তিনশ ছাড়ানো সংগ্রহ আশা করেছিলাম।” 

বাংলাদেশ ১০ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর ১৫৫ রানের জুটি গড়েছিলেন তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান। তার পরও ইনিংস থেমে যায় ২৬০ রানেই। ৫ চার ও ৩ ছক্কায় ৭১ রান করেন তামিম, ১১ চারে ৮৪ রান করেন সাকিব।

তবে শেষ বিকেলে বোলিংয়ে নেমে দ্রুতই অস্ট্রেলিয়ার ৩ উইকেট তুলে নেয় বাংলাদেশ। পরদিন আবার প্রবল উৎসাহে মাঠে আসার জ্বালানী পেয়ে যান মেহেদী।

“বোলারদের দাপটে প্রথম দিন ভালোভাবেই শেষ করে বাংলাদেশ। ১৮ রানে ৩ উইকেট পড়ায় আশায় ছিলাম লিডের। পরের দিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম দারুণ আগ্রহ নিয়ে।”

দ্বিতীয় দিন বাংলাদেশের দারুণ বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া গুটিয়ে যায় ২১৭ রানে। ৪৩ রানের লিড পায় বাংলাদেশ। ৬৮ রানে ৫ উইকেট নিয়ে দলের সফলতম বোলার ছিলেন সাকিব।

তামিম দ্বিতীয় ইনিংসেও খেলেন দারুণ এক ইনিংস (৭৮)। তবে আর কেউ খুব ভালো করতে পারেননি। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের সম্ভাবনাময় ইনিংস থেমে যায় ৪১ রানে। মেহেদীর মতো মাঠে থাকা দর্শকেরাও ছিলেন হতাশ।

“ তামিম খুব ভালো খেলছিলেন, তখন বড় লিডের আশা করছিলাম। ভেবেছিলাম তিনশ ছাড়ানো স্কোর হবে। কিন্তু দেখতে দেখতে সুন্দর দিনটি যে হতাশায় মুড়ে গেল। ৩ উইকেটে ১৩৫ থেকে এক সময়ে স্কোর হয়ে গেল ৮ উইকেটে ১৮৬। লোয়ার অর্ডারে মিরাজ কিছু রান করেছিল। তখনই মনে হচ্ছিল, উইকেটের যে অবস্থা, এই রানকটিই বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত সেটিই হয়েছিল।”

শেষ ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে ২৬৫ রানের লক্ষ্য দেয় বাংলাদেশ। রান তাড়ায় অস্ট্রেলিয়া ২ উইকেট হারাল ১০ ওভারের মধ্যে। গ্যালারিতে জয়ের হাওয়া বইতে শুরু করেছে তখনই।

“২৮ রানে ২ উইকেট হারাল ওরা। গ্যালারিতে যেন তখন উৎসব। একটু আফসোসও ছিল। ওদের সেরা দুই ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নার ও স্টিভেন স্মিথ জীবন পেয়ে গেল! নইলে ওই দিনই হয়তো জয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যেত।”

কিন্তু হলো উল্টো। বেঁচে গিয়ে ওয়ার্নার ও স্মিথ দারুণ জুটি গড়লেন। ২ উইকেটে ১০৯ রান নিয়ে দিন শেষ করল অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্ন ধাক্কা খেল প্রবলভাবে।

দুরু দুরু বুক নিয়ে মাঠে

হাতে ৮ উইকেট, প্রয়োজন ১৫৬ রান। ক্রিজে দলের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক। ম্যাচ হেলে তখন অস্ট্রেলিয়ার দিকে। ওয়ার্নার-স্মিথের জমে যাওয়া জুটি ভাঙতে পারলেই ম্যাচের চিত্র পাল্টে যাবে, এটা জানত বাংলাদেশ।

চতুর্থ দিনেই খেলা শেষ হবে, এই ভাবনায় সকাল-সকাল মাঠে হাজির হয়েছিলেন মেহেদী।

“আগের দিন মন খারাপ করে বাসায় ফিরেছিলাম। অনেক দিন আগেই বাড়ি যাওয়ার টিকেট কাটা ছিল। চতুর্থ দিন ছিল গাড়ি। ভাবছিলাম, বাড়ি (ফেনী) যাব, নাকি মাঠে! এদিকে মাঠে তখন চলছে ওয়ার্নারের তাণ্ডব। দল হারের পথে থাকায় বাড়ি যাওয়ার আগ্রহটা বাড়ছিল একটু একটু করে। হঠাৎ করে সাকিব জাদু। ফিরে গেলেন ওয়ার্নার। আমারও বাড়ি যাওয়ার ভাবনা শিকেয় উঠল।”

প্রথম ঘণ্টায় ওই একটাই উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। উপমহাদেশে নিজের প্রথম সেঞ্চুরিতে ১৩৫ বলে ১৬ চার ও এক ছক্কায় ১১২ রান করেন ওয়ার্নার।

পানি বিরতির পর প্রথম ওভারে আরেক বড় বাধা স্মিথকে কট বিহাইন্ড করে দেন সাকিব। তার সঙ্গে তাইজুল ইসলাম ও মিরাজ শিকারে যোগ দিলে নিয়মিত উইকেট হারাতে থাকে অস্ট্রেলিয়া।

ম্যাচ জমে ওঠে শেষ দিকে। নবম উইকেটে লায়নের সঙ্গে ২৯ রানের জুটি গড়ার পর শেষ জুটিতে হেইজেলউডকে নিয়েও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন কামিন্স। বাড়তে থাকে শঙ্কা, তীরে এসে ডুববে তরী! গ্যালারিতে মেহেদীরা ছিলেন অস্থির অপেক্ষায়।

“ওদের খুব বেশি রান লাগতো না। শেষ জুটিতে প্রয়োজন ছিল ৩৭ রান। কামিন্স সচল রেখেছিলেন রানের চাকা। স্ট্রাইক ধরে সুযোগ পেলেই বড় শট খেলছিলেন। অনেকের মনে জেগেছিল হারের শঙ্কা।”

“হেইজেলউডকে স্ট্রাইকে পেলে আশা জাগছিল। শেষ পর্যন্ত দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ানো শেষ জুটিটা ভাঙলেন তাইজুল। দারুণ এক ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ করে দিলেন হেইজেলউডকে। আউট হওয়ার পর তাকে রিভিউয়ের ইশারা করতে দেখেছিলাম, অবশ্য তাদের আর রিভিউ ছিল না।”

২৬৫ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ২৪৪ রানে থামে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস।

৮৫ রানে ৫ উইকেট নেন সাকিব। ম্যাচে ১০ উইকেট, প্রথম ইনিংসে ৮৪ রানের ইনিংস, ম্যাচ সেরার লড়াইয়ে সাকিবের ধারে কাছে ছিলেন না কেউ।

তৃপ্তি নিয়ে মাঠ ছাড়া

শঙ্কা নিয়ে সকালে মাঠে এসেছিলেন মেহেদী। মাঠ ছেড়ে যাওয়ার সময় মন ছিল ভালো লাগায় পূর্ণ। তুমুল চিৎকার, হইচই, উল্লাস শেষে মাঠ ছাড়ার সময় তার মনে পড়ছিল একটি কথা। 

“সিরিজ শুরুর আগে যখন কথার লড়াই চলছিল, বাংলাদেশ দল বলেছিল, অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইটওয়াশ করাও সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক স্মিথ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশ এতদিনে কেবল নয়টা টেস্ট জিতেছে।’ ওই জয়টা তাই ছিল একরকম জবাব। মাঠ থেকে বের হতে হতে ভাবছিলাম, ৯ থেকে ১০ হয়ে গেল। এবার সামনে এগোনোর পালা।”