মাঠ থেকে দেখা: ১০ উইকেটের সেশনে বাংলাদেশের দুর্দান্ত জয়

২৭‌৩ রান তাড়ায় উদ্বোধনী জুটিতেই শতরান। ইংল্যান্ডের জয় মনে হচ্ছিল নাগালে। অ্যালেস্টার কুক ও বেন ডাকেট যখন দৃঢ় পায়ে এগিয়ে নিচ্ছিলেন দলকে, মিরপুরের গ্যালারি থেকে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন অনেক দর্শক। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে বসে আসাদুল হকও ভাবছিলেন, চলেই যাবেন। কিন্তু মনের সায় মিলল না। মনের কোথাও উঁকি দিচ্ছিল জয়ের স্বপ্ন। আসাদুল থেকে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষী হলেন বাংলাদেশের অসাধারণ এক জয়ের।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2020, 06:01 AM
Updated : 9 May 2020, 08:04 AM

ম্যাচটির কথা মনে পড়লে আসাদুল এখনও ভাবেন, ‘যদি চলে যেতাম, রূপকথার মত একটি সেশন মিস করতাম!’ ২০১৬ সালে মিরপুর টেস্টের তৃতীয় দিনে এক সেশনেই ইংলিশদের ১০ উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছিল নিজেদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা জয়।

বাংলাদেশের রোমাঞ্চকর কিছু ম্যাচ ও স্মরণীয় পারফরম্যান্স যারা মাঠে বসে দেখেছেন, তাদের নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ধারাবাহিক আয়োজন, ‘মাঠ থেকে দেখা।’ এই পর্বে কম্পিউটার প্রকৌশলী আসাদুল হকের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে ইংল্যান্ডকে টেস্টে প্রথমবার হারানো ও অবিশ্বাস্য সেই সেশন।

যে কারণে বেছে নেওয়া সেই ম্যাচ

টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের ভাবনার বড় পরিবর্তনের শুরু সেই সিরিজ দিয়েই। পরিকল্পনাটি মূলত এসেছিল তখনকার অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের মাথা থেকে। সমর্থন দিয়েছিলেন কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে। ড্রেসিং রুমে অনেক আলোচনার পর চূড়ান্ত হয় পরিকল্পনা, দেশের মাটিতে বাংলাদেশ বেছে নেবে ভয়ঙ্কর টার্নিং উইকেটের পথ।

এর আগে পর্যন্ত দেশের মাটিতে বেশির ভাগ সময় ব্যাটিং সহায়ক উইকেট রাখা হতো ম্যাচ বাঁচানোর আশায়। ওই পরিকল্পনা খুব একটা কাজে না আসেনি। টেস্ট ক্রিকেটে একটি জায়গাতেই যেন থমকে ছিল বাংলাদেশ। চিরায়ত ভাবনার বলয় ভেঙে অবশেষে নেওয়া হয় সাহসী সিদ্ধান্ত। নিজেদের শক্তির জায়গা স্পিন, তাই স্পিনারদের জন্য মঞ্চ সাজিয়ে প্রচেষ্টা জয়ের।

প্রথম চেষ্টা অল্পের জন্য সফল হয়নি। সিরিজের প্রথম টেস্টে চট্টগ্রামে খুব কাছে গিয়ে হেরে যায় বাংলাদেশ। তবে দল বুঝে যায়, পথটা ঠিক আছে। বুঝে যান সমর্থকেরাও। তাদেরই একজন আসাদুল। চট্টগ্রাম টেস্টের পারফরম্যান্স থেকেই দলকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন তিনি।

“চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের জেতার সম্ভাবনা ছিল। সাব্বির (রহমান) আরেকটু সহায়তা পেলে চিত্রটা অন্যরকম হতে পারত। সে কারণে একটা আশা ছিল, ঢাকায় জিতে সমতায় সিরিজ শেষ করা সম্ভব হবে।”

“চট্টগ্রামে আগের টেস্ট তিন দিনেই শেষ হয়েছিল। মিরপুরেও প্রথম দুই দিনে অনেক উইকেট পড়েছিল। এজন্য আমার মনে হয়েছিল, এই টেস্টও তৃতীয় দিনেই শেষ হতে পারে।”

টেস্ট ক্রিকেট তার বরাবরই প্রিয়। মাঠে যাওয়ার আগ্রহের কারণ ছিল এটিও।

অফিস থেকে মাঠে

ম্যাচের তৃতীয় দিন ছিল রোববার। সকালে অফিসে যাওয়ার পর কলিগরা মিলে ঠিক করেন, যেতে হবে মাঠে। ছুটি নিতে সমস্যা হয়নি। টিকেটও মিলে যায় দ্রুত।  

“অফিসের কলিগদের সঙ্গে মাঠে গিয়েছিলাম। ভাবনাটা আগে থেকেই ছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম অফিসে যাওয়ার পরে। চার জন কলিগ বনানী থেকে গাড়ি নিয়ে মাঠে চলে আসি। ইনডোর স্টেডিয়াম থেকেই টিকেট কেটেছিলাম। ওয়ানডের সময় টিকেট পাওয়া খুব কঠিন, টেস্টের সময় সহজেই পেয়েছিলাম। খেলা দেখেছিলাম গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে বসে।”

তৃতীয় দিনের শুরুতে যেখানে ছিল ম্যাচ

টস জিতে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে তামিম ইকবালের সেঞ্চুরির পরও ২২০ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। আগের ম্যাচে অভিষিক্ত মেহেদী হাসান মিরাজ ৬ উইকেট নিয়ে ২৪৪ রানে থামিয়ে দেন ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস। তাইজুল ইসলাম নেন ৩ উইকেট।

দ্বিতীয় ইনিংসে তামিম (৪১) ও মাহমুদউল্লাহর (৪৭) আক্রমণাত্মক দুই ইনিংস আর ইমরুল কায়েসের দায়িত্বশীল ফিফটিতে ৩ উইকেটে ১৫২ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে ২৪ রানে পিছিয়ে থাকা দলটি তখন ১২৮ রানে এগিয়ে।

আসাদুলের মত টেস্ট ক্রিকেটকে ভালোবাসা একজন দর্শকের জন্য বেশ উৎসাহজনক একটা পরিস্থিতি। মাঠে যাওয়ার তাড়না তাতে বেড়ে যায় আরও।

“আগের দিন বাংলাদেশের ৩ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তৃতীয় দিন ফল হয়ে যেতে পারে, এই আশা নিয়েই খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার দিকে সেটিই হয়।”

“ইমরুল খেলছিল ৫৯ রানে। দ্বিতীয় দিন শেষে বাংলাদেশ বড় লিডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। হাতে অনেক উইকেট ছিল। আশা ছিল বড় একটা লক্ষ্য দেওয়া যাবে।”

বাংলাদেশের ব্যাটিং

সকালে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ইমরুলের ভালো একটি জুটি হয়। দারুণ দৃঢ়তা দেখানো ইমরুলের বিদায়ে ভাঙে ৪৮ রানের জুটি। মঈন আলির বলে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হয়ে যান বাঁহাতি ওপেনার।

“গ্যালারিতে যারা ছিলাম, তারা অপেক্ষা করছিলাম ইমরুলের সেঞ্চুরির জন্য। সে আউট হওয়ার পর সাকিব আর মুশফিক দ্রুত আউট হয়ে গেল। গ্যালারিতে তখন অস্বস্তি।”

লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের নিয়ে শুভাগত হোম চোধুরী দলকে নিয়ে যান ২৯৬ রানে। চতুর্থ ইনিংসে ইংল্যান্ডের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৭৩।

সোনায় মোড়ানো সেশন

ইনিংস বিরতির সময় আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর গ্যালারি। তরুণ মিরাজ তিন ইনিংসের দুটিতেই নিয়েছে ৬ উইকেট করে। সঙ্গে আছে সাকিব ও তাইজুল। এ তিন জনই তো যথেষ্ট হওয়ার কথা। সঙ্গে শুভাগত-মাহমুদউল্লাহর অফ স্পিন আছে।

মাঠের আবহ ছিল প্রাণবন্ত। গ্যালারিতে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি ম্যাচের মতোই উত্তেজনা। উইকেটে বল ঘুরছে। স্পিনের বিপক্ষে ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা অতটা ভালো না। কুক ও জো রুটকে আউট করতে পারলেই জয় হাতের মুঠোয়। সম্ভাব্য জয়ের রোমাঞ্চে কাঁপছিল গ্যালারি।

“উইকেটের জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিন্তু কোথায় কী! কোনো উইকেট পড়ে না। ওদের উদ্বোধনী জুটিই তো ভাঙে না! অধিনায়কের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে মাঠের অনেক লোকই বের হয়ে গিয়েছিল। আমরাও চলে যাব কিনা ভাবছিলাম।”

“চা-বিরতির সময় ক্রিকেটাররা যখন প্যাভিলিয়নের দিকে এগিয়ে আসছিল। তখন হাথুরুসিংহে বেরিয়ে এসে কিছু একটা যেন বলেছিল তামিমকে। চা-বিরতির পর ফিল্ডিং ঠিক করা, বোলিং পরিবর্তনের কাজগুলো তামিম করছিল বলে মনে হচ্ছিল। বাইরে থেকে মনে হয়েছে, তামিমই তখন অধিনায়ক।”

তৃতীয় সেশনের প্রথম বলেই বাংলাদেশের বড় স্বস্তি হয়ে ধরা দেয় ব্রেক থ্রু। দারুণ এক ডেলিভারিতে ডাকেটকে বোল্ড করে দেন মিরাজ। এরপর আর কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি ইংল্যান্ড।  

“ইংল্যান্ডের ইনিংসের সময় একটা জিনিস আলাপ হচ্ছিল গ্যালারিতে। ডাকেট সুইপ করে সমানে চার মারছিল। এটা কোনোভাবেই আটকাতে পারছিল না। সবাই বলাবলি করছিল, এটা যদি আটকানো যায় তাহলে হয়তো কাজ হবে।”

“চা-বিরতির পর প্রথম বলে মিরাজ উইকেট পেতেই পাল্টে যায় গ্যালারির চিত্র। হতাশ হয়ে পড়া দর্শকেরা ফিরে পায় প্রাণ।”

রুটকে টিকতেই দেননি সাকিব। গ্যারি ব্যালান্স, মইনকে দ্রুত থামান মিরাজ। পানি পানের বিরতির আগেই কুকের প্রতিরোধও ভাঙেন তরুণ এই অফ স্পিনার। গ্যালারিতে তখন জয়ের দোলা লাগতে শুরু করেছে।

“ওদের ৫ উইকেট যাওয়ার পর মনে হয়েছিল জয় সম্ভব, আজকেই সম্ভব। ৬ উইকেট চলে যাওয়ার পর বাইরে চলে যাওয়া লোকজনের অনেকে আবার ঢুকেছিল। শেষ দিকে প্রচুর লোক ছিল মাঠে।”

ইংল্যান্ডের শেষ ৯ ব্যাটসম্যানের মধ্যে দুই অঙ্কে যেতে পারেন কেবল বেন স্টোকস। ৭৭ রানে ৬ উইকেট নেন মিরাজ। দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২ উইকেট নিয়ে তিনিই ম্যাচ সেরা। দুই ম্যাচে ১৯ উইকেট নিয়ে সিরিজ সেরাও ছিলেন এই তরুণ। সাকিবের প্রাপ্তি ছিল ৪ উইকেট।

চারিদিকে উৎসব

চট্টগ্রামের হৃদয় ভাঙা হার মনে ছিল দর্শকদের। সফরকারীদের উদ্বোধনী জুটির দৃঢ়তায় শঙ্কা জেগেছিল এই ম্যাচও হাত থেকে ছুটে যাওয়ার। ঘুরে দাঁড়িয়ে ৬৪ রানের মধ্যে মিরাজ-সাকিবরা ১০ উইকেট তুলে নেওয়ার পর দর্শকরা যেন মেতেছিল বিশ্বজয়ের আনন্দে।

“বাংলাদেশের ক্রিকেটে জয় এখন বিরল কিছু না। কিন্তু টেস্টে ইংল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে জয় বিশেষ কিছু। সবচেয়ে পুরনো টেস্ট দলের একটি, যারা এই সংস্করণকে সত্যিই খুব গুরুত্ব দেয় তাদের হারাতে পারা ছিল বিশেষ কিছু।”

“জয়টা আরও মধুর হয়ে উঠেছিল মাঝের কঠিন সময়টার জন্য। চারদিকে কেবল চিৎকার, কেউ মিরাজ, কেউ সাকিব, কেউ তামিম বলে চিৎকার করছিল। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে চিৎকার তো ছিলই।”

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের পর ধীরে ধীরে খালি হতে শুরু করে গ্যালারি। কিন্তু দর্শকদের উল্লাস তখনও থামেনি। এতক্ষণ গ্যালারিতে বসে খেলা দর্শকদের অনেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রাস্তায়। সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছিলেন জয়ের মধুর স্বাদ।

“শেষ বিকেলে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। মাঠ ছাড়তে ছাড়তে সন্ধ্যা। রাস্তায় অনেক মানুষ দাঁড়িয়েছিল। এমন দিন তো বাংলাদেশের ক্রিকেটে খুব বেশি আসেনি। সত্যি সত্যিই টেস্টে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে বাংলাদেশ, এটা কল্পনা নয় সত্যি, ভাবতে ভাবতে মাঠ ছাড়ি।”