জীবনের পথচলায় লারা পূর্ণ করলেন আরেকটি বছর। সর্বকালের অন্যতম সেরা ও বিনোদনদায়ী ব্যাটসম্যানের ৫১তম জন্মদিন শনিবার। মহাতারকার জন্মদিনে তার ক্যারিয়ারে একবার ফিরে তাকানোই যায়। আর সেটি যদি হয় তার নিজের চোখে, তাহলে তো দারুণ মুখরোচক ব্যাপার!
মহাকাব্যিক সব ইনিংসের রচয়িতা তিনি। জন্ম দিয়েছেন অসংখ্য নাটকীয়তার। সেরা কিছু মুহূর্ত বাছাই করা সহজ হওয়ার কথা নয়। উইজডেনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তবু লারা বেছে নিয়েছেন সেরা দশ। অনেকেই যেটিকে মনে করেন টেস্ট ইতিহাসের সেরা ইনিংম, ১৯৯৯ সালে বারবাডোজের সেই ১৫৩ রানের অসাধারণ ম্যাচ জেতানো ইনিংসটি বিস্ময়করভাবে নেই তার নিজের সেরা দশে।
সোবার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ
(স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল টুর্নামেন্ট, ১৯৮৬)
স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল টুর্নামেন্টে ফাতিমা কলেজের হয়ে খেলছিলাম আমি। ৭-৮ নম্বরে ব্যাট করতে হতো আমাকে, কারণ দলটি ছিল দারুণ। কোনো এক শুক্রবার বিকেলে প্রতিপক্ষের এক বোলার হ্যাটট্রিক করায় আমি আগেভাগে ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগ পেলাম। দুর্দান্ত একটি সেঞ্চুরি করে ফেললাম! ১৪ বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে সেঞ্চুরি করেছি। তখনই বুঝে গেলাম, ক্রিকেটে আমার ভবিষ্যৎ আছে!
বছর দুয়েক পরে (১৯৮৬ সালে) স্কুল টুর্নামেন্টেই বারবাডোজে স্যার গ্যারি সোবার্সের সঙ্গে দেখা হলো। কিছুক্ষণ কথাও হলো। আমার খেলা ভালো লাগে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। উঠতি একজন ক্রিকেটারের জন্য সেটা ছিল বড় অনুপ্রেরণা! আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সেটি।
অপ্রত্যাশিত টেস্ট অভিষেক
(প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, লাহোর, ১৯৯০, রান- ৪৪ ও ৫)
সুযোগটি পাওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ কার্লাইল বেস্টের প্রতি! আমার একাদশে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু ম্যাচের আগে স্লিপ ফিল্ডিং অনুশীলন করতে গিয়ে বেস্টের হাত ফেটে গেল। আমাকে নেওয়া হলো। অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল সেটি। ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিসদের বিপক্ষে খেলতে পারা ছিল দারুণ ব্যাপার। অভিষেকে দলে কিছুটা অবদান রাখতে পারাও আমার জন্য ছিল খুবই স্পেশাল কিছু।
(প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, ১৯৯৩)
সিরিজে আমরা পিছিয়ে ছিলাম। সিডনিতে আগে আমরা প্রত্যাশিত ফল পাইনি খুব একটা। সব মিলিয়েই ছিল চ্যালেঞ্জিং। এত কম বয়সে ও নিজের মাত্র পঞ্চম টেস্টেই শেন ওয়ার্ন, মার্ভ হিউজ ও ক্রেইগ ম্যাকডারমটদের মতো বোলারদের সামলে অমন একটা ইনিংস খেলতে পারা ছিল অসাধারণ অনুভূতি। ইনিংসটি আমার খুব প্রিয় বলেই মেয়ের নাম রেখেছি সিডনি।
এমন একটা ইনিংস খেলতে পারলে যে কোনো তরুণই তা হৃদয়ে সযত্নে লালন করবে। নিশ্চিতভাবেই আমার সেরা পাঁচ ইনিংসের একটি এটি।
প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিতেই ২৭৭ পর্যন্ত যেতে পারা ছিল দারুণ ব্যাপার। মনে আছে, চা-বিরতির সময় আমি ১২০ রানে অপরাজিত ছিলাম। কোচ রোহান কানহাই আমাকে বললেন উইকেট আঁকড়ে রাখতে এবং যতটা সম্ভব লম্বা সময় ব্যাট করতে। সেঞ্চুরি হওয়ার পর আমি এটিকে কোনো মাইলফলক বা বড় অর্জন হিসেবে দেখিনি। লম্বা ইনিংস খেলার তাড়না ছিল ভেতরে।
ইতিহাস গড়া ইনিংস
(৩৭৫, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ১৯৯৪, অ্যান্টিগা)
এই ইনিংসের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল আগের ম্যাচেই বারবাডোজে ইংল্যান্ডের জয়। প্রথম তিন টেস্ট জিতেই আমরা সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছিলাম। চতুর্থ টেস্টে ইংল্যান্ড জিতে গেল। পঞ্চম টেস্টে অ্যান্টিগায় আমরা তাই দাপটে শেষ করতে চেয়েছিলাম।
রেকর্ডের ভাবনা অবশ্যই আমার মাথায় ছিল না। তবে লক্ষ্য ছিল, অধিনায়ক ইনিংস ঘোষণা করা পর্যন্ত আমি উইকেটে থাকব। কোর্টনি ওয়ালশ ও কার্টলি অ্যামব্রোসের চোখের ভাষা পড়তে পারছিলাম আমি, “খবরদার আউট হয়ে যেও না, এই ট্র্যাকে আমরা বোলিং করতে চাই না!”
আমার ক্যারিয়ারের দারুণ স্মরণীয় একটি মুহূর্ত ছিল ওই রেকর্ড। ইনিংসটি আমার ভাগ্যেই লেখা ছিল। সিডনিতে ২৭৭ রানের ইনিংসটিতে আমি রান আউট হয়ে যাওয়ায় স্যার গ্যারি সোবার্স বেশ হতাশ হয়েছিলেন। আমি খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলাম যে তাকে ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়ার সময় তিনি মাঠেই ছিলেন।
(৫০১, ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে ডারহামের বিপক্ষে, এজবাস্টন, ১৯৯৪)
১৯৯১ সালে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলাম আমি, কন্ডিশন খুব কঠিন মনে হয়েছিল। সেবার যদিও টেস্টে সুযোগ পাইনি। তবে প্রস্তুতি ম্যাচগুলিতে মিডিয়াম পেসাররাই আমার স্টাম্প উপড়ে ফেলছিল নিয়মিত।
ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলতে গিয়ে (১৯৯৪) আমি তাই সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলাম, মানিয়ে নিতে সময় লাগতে পারে।
সৌভাগ্যবশত, আমি শুরু থেকেই রান করতে শুরু করি (প্রথম ৭ ইনিংসেই করেছিলেন ৬ সেঞ্চুরি!)। ডারহামের বিপক্ষে এই রেকর্ড গড়া ইনিংসটি খেলার সময় আমার মনে হচ্ছিল, রানের ধারা অবশেষে থামছে। ১০ রানে বোল্ড হলাম, কিন্তু বলটি ছিল ‘নো।’ ১৪ রানে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে গেলাম। আম্পায়ারকে বলেছিলাম, “ক্লান্তিতে আমি নিঃশেষিত প্রায়, আর রান করা হবে না।” দেড় দিন পর অবশ্য বাস্তবতা দেখা গেল ভিন্ন!
আমরা চেষ্টা করছিলাম, ম্যাচে জয়-পরাজয় বের করতে। কিন্তু ডারহামকে রাজি করাতে পারলাম না। লক্ষ্য তাই ছিল যত সময় সম্ভব ব্যাট করে ব্যাটিং পয়েন্ট পাওয়া। আমি শুরু থেকে সারাদিনই আগ্রাসী ব্যাট করে গেছি, একের পর এক মাইলফলক ধরা দিয়েছে। আমি স্রেফ মাথা নিচু করে চূড়ার দিকে ছুটে গেছি।
সিরিজ বাঁচানো ইনিংস
(১৭৯, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ওভাল, ১৯৯৫)
খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সিরিজ ছিল। ইংল্যান্ড আমাদের ছেড়ে কথা বলছিল না। যতবারই আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, ওরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। ব্যাট হাতে সিরিজটি আমার ভালোই কেটেছিল (৫ টেস্টে ৩ সেঞ্চুরি, ৩ ফিফটি)।
ইংল্যান্ড আশা করছিল যে ওভালে শেষ ম্যাচটি জিতে সিরিজ জিতবে। প্রথম ইনিংসে ভালো স্কোরও গড়েছিল (৪৫৪)। তবে আমার ও কার্ল হুপারের সেঞ্চুরিতে জয় ইংল্যান্ডের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল।
বড় একটি সেঞ্চুরি দিয়ে সিরিজ শেষ করতে পারায় ভালো লেগেছিল। যদিও দল জিতলে আরও ভালো লাগত। সে সময় ইংল্যান্ডকে হারানোই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য স্বাভাবিক।
একার লড়াই
(৩ টেস্টে ৬৮৮ রান, প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, ২০০১)
শ্রীলঙ্কায় ওই সিরিজে আমার পারফরম্যান্স দারুণ ছিল। ক্যারিয়ারের অনেক বড় একটি মুহূর্ত সেটি। আমরা তিন টেস্টেই হেরেছিলাম কিন্তু আমি ম্যান অব দা সিরিজ হয়েছিলাম। হোয়াইটওয়াশড হওয়া দলের ক্রিকেটার কীভাবে সিরিজের সেরা হতে পারে! ওই সিরিজে আসলেই খুব ভালো ব্যাট করেছিলাম। মনে আছে, একটি টেস্টে আমি প্রথম ইনিংসে ২২১ করলাম, দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩০। তারপরও দল ম্যাচ হেরে গেল দুই সেশন বাকি থাকতেই!
রেকর্ড পুনরুদ্ধার
(৪০০, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, অ্যান্টিগা, ২০০৪)
১০ বছর আগের চেয়ে এবারের প্রেক্ষাপট ছিল পুরো ভিন্ন। সেবার আমরা সিরিজে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে ছিলাম। এবার আমরা ৩-০তে পিছিয়ে থেকে ছিলাম হোয়াইটওয়াশড হওয়ার মুখে। আমি তখন অধিনায়ক। একটাই চাওয়া ছিল যেন আমার নেতৃত্বে ৪-০তে হারতে না হয়।
মাইকেল ভনকে (ইংল্যান্ড অধিনায়ক) জিজ্ঞেস করলে বলবে যে আমি শূন্য রানে আউট ছিলাম (জোরালো আবেদন ছিল)। কিন্তু আমার মনে হয়নি, বল আমার ব্যাটে লেগেছে। আর আমি তখনই ক্রিজ ছেড়ে যাব, যখন বুঝব যে আমি নিশ্চিত আউট।
টেস্ট শুরুর আগে দলের উদ্দেশে বলেছিলাম, কাউকে বড় ইনিংস খেলতে হবে। ভালো লেগেছিল যে আমিই সেটি করতে পেরেছিলাম। আমার জীবনের আরেকটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত সেটি। ওদের দলে দুজন ছিল, যারা আগের রেকর্ডের সময়ও ছিল প্রতিপক্ষে (নাসের হুসেইন ও গ্রাহাম থর্প)। ৩৭৫ ও ৪০০, দুটি ইনিংসই দেখে তাদের ভালো লাগার কথা নয়!
(আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ইংল্যান্ড, ২০০৪)
অল্প কিছুদিনের মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৮ টেস্টের ৭টি হেরেছিলাম আমরা। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে তাই বারমুডায় গিয়ে আমরা বিশ্রাম নিয়েছি একটু তরতাজা ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে। পরে আবার ইংল্যান্ডে ফিরেছি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য। যদিও নিজেদের নিয়ে সংশয় ছিল অনেক, আত্মবিশ্বাস ছিল তলানিতে। দলে আত্মকেন্দ্রীকতা ছিল প্রবল।
আমরা চেষ্টা করেছি সব কিছু জয় করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামতে। রোমাঞ্চকর ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জয় ছিল অভাবনীয় অনুভূতি। অধিনায়ক হিসেবে আমার বলার মতো কিছু নেই, ওই ট্রফি জয় ছিল তাই স্পেশাল মুহূর্ত।
সেরাগুলোর সেরা
(২১৩, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, জ্যামাইকা, ১৯৯৯)
লোকে যখন আমার প্রিয় ইনিংসের কথা জিজ্ঞেস করে, সবাই আমাকে ওই সিরিজে বারবাডোজের অপরাজিত ১৫৩ রানের ইনিংসটির দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আগের টেস্টে জ্যামাইকায় করা ২১৩ আমার সবচেয়ে প্রিয়।
তখন মাত্রই আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫-০তে সিরিজ হেরে ফিরেছি। দেশে ফিরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টও হেরেছি। সবাই ধারণা করছিল, স্টিভ ওয়াহর দল সহজেই সিরিজ জিতবে। আমাকে শর্ত দিয়ে স্রেফ প্রথম দুই টেস্টের জন্য অধিনায়ক করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড চাপে ছিলাম।
ম্যাচ জেতানো ইনিংস ও ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস বেশ কিছু খেলেছি। কিন্তু যদি নিজের চাপের কথা বলি, দলের বিপর্যস্ত অবস্থার কথা বলি, জ্যামাইকার এই ইনিংস ছিল অন্য পর্যায়ের। আমি দেখিয়েছিলাম যে দলকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি, তেজোদীপ্ত কিছু করতে পারি এবং খাদের কিনারা থেকে দলকে উদ্ধার করতে পারি।
জ্যামাইকার এই ইনিংসটিতেই ক্যারিয়ারের সেরা ব্যাটিং করেছি। হয়তো আমার নিজের ঘরানায় (আগ্রাসী) খেলতে পারিনি, সিডনির ২৭৭ ছিল অনেকটাই নিজের মতো খেলে, তবে চাপ ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় জ্যামাইকার ২১৩-ই সেরা।