স্মরণীয় দ্বৈরথ: মর্কেল ও মানসিক চাপের সঙ্গে মুমিনুলের লড়াই

দলে জায়গা ধরে রাখার চাপ। মনে সংশয়ের ঘুণপোকা। সামনে মর্নে মর্কেলের গতি ও বাউন্স সামলানোর চ্যালেঞ্জ। এই বিরুদ্ধ পারিপার্শ্বিকতায় মুমিনুল হক খেলেছিলেন দারুণ এক ইনিংস। তার নিজের কাছে লড়াই জয়ের মনে রাখার মতো এক অধ্যায় সেটি।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2020, 10:24 AM
Updated : 1 May 2020, 10:24 AM

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত আয়োজন, ‘স্মরণীয় দ্বৈরথ’-এ মুমিনুল বললেন ২০১৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে পচেফস্ট্রুম টেস্টে তার ইনিংসটির কথা।

টেস্টে ৯টি সেঞ্চুরি করেছেন মুমিনুল, দেড়শ ছাড়িয়েছেন তিনবার। কিন্তু চ্যালেঞ্জ জয়ের বিবেচনায় এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান এগিয়ে রাখছেন পচেফস্ট্রুমে ৭৭ রানের ইনিংসটি।

‘চ্যালেঞ্জ ছিল ভেতরে-বাইরে’

“সেঞ্চুরি তো বেশ কিছুই করেছি। তবে চ্যালেঞ্জ জয়ের কথা বললে সবার আগে আমার পচেফস্ট্রুমের ইনিংসটির কথাই মনে পড়ে।”

“চ্যালেঞ্জের শুরু ছিল ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই। তখন কিছুদিন আগেই শ্রীলঙ্কা সফরে আমি টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েছিলাম। শততম টেস্টে খেলতে পারিনি। দেশে ফিরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টেও জায়গা পাইনি একাদশে। পরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে সুযোগ পেলেও দুই ইনিংসে আউট হয়ে গেছি সেট হয়েও।”

“পচেফস্ট্রুম টেস্ট খেলতে নামার সময় তাই জানতাম, আরেকবার ব্যর্থ হলে আবার বাদ পড়তে হবে নিশ্চিত। তখন আমার ব্যাটিং নিয়ে অনেক কথাও হচ্ছিল। শর্ট বলে আমি দুর্বল, এই ধরনের কথা চলছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেট বাউন্সি। ওদের মর্নে মর্কেল, কাগিসো রাবাদা অনেক লম্বা বোলার। এসব আমার মনের মধ্যেও ছাপ ফেলেছিল। সব মিলিয়ে চাপ ছিল ভয়ঙ্কর।”

“প্রথম ইনিংসে ওরা বড় স্কোর গড়েছিল। আমরা ব্যাটিংয়ে নেমে চাপে পড়লাম যথারীতি। এরপর তামিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার একটি জুটি হলো। দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস ঘোষণার সময় তামিম ভাই ফিল্ডিংয়ে ছিলেন না। তাই আমাদের ব্যাটিংয়ে ওপেন করতে পারেননি। নেমেছিলেন পাঁচ নম্বরে।”

“উইকেট খুব ভয়ঙ্কর ছিল না। বলা যায়, ব্যাটিং উইকেটই ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে বাউন্স কিছুটা থাকেই, তা ছিল। তবে ওদের বোলারদের স্কিল তো দারুণ। রাবাদা দুই দিকে সুইং করাচ্ছিল। পুরনো বলে রিভার্স সুইংও। সবচেয়ে ঝামেলা করছিল মর্কেল। ওই উইকেটেও অনেক বাউন্সি আদায় করছিল। আর এমন অ্যাঙ্গেলে বল করে, তাকে খেলা খুব কঠিন।” 

“আমি আর তামিম ভাই দ্বিতীয় দিন শেষে অপরাজিত ছিলাম। দুজনেই মোটামুটি সেট ছিলাম। কিন্তু তৃতীয় দিন সকালে তারপরও কঠিন পরীক্ষা হয়েছে আমাদের। সকালে মর্কেল ও রাবাদা দুর্দান্ত বোলিং করছিল। আমাদেরকে নড়াচড়ার সুযোগই দিচ্ছিল না। অসহায় লাগছিল।”

“তামিম ভাই সেসময় অনেক সাহায্য করেছেন। বারবার বলেছেন, ‘ওদের এই স্পেলটা কোনো রকমে পার করে দে, উইকেট দিস না। ওরা সর্বোচ্চ ৫-৬ ওভারের স্পেল করবে। হাল না ছেড়ে পড়ে থাক ক্রিজে।’ টেস্ট ক্রিকেটে এসব খুব নরম্যাল কথা হয়তো, সবারই জানা। তারপরও উইকেটে অনেক সময় মাথা কাজ করে না। তখন সঙ্গী ব্যাটসম্যানের সাধারণ কোনো কথাও অনেক ভালো কাজ করে। আমার ক্ষেত্রে করেছিল।”

“প্রথম ১০ ওভারে মনে হয় আমরা ৫ রান করেছিলাম কেবল (আসলে ৯ ওভারে ৭)। শুধু পার করে দিয়েছি, চেয়েছি যেন ওরা ক্লান্ত হয়, স্পেল শেষ হয়ে যাক। তামিম ভাই বলছিলেন, ওদের ক্লান্ত করে দিতে পারলে পরে রান আসবে। সেটিই হলো। রাবাদা এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে আলগা বল করল। তামিম ভাই বাউন্ডারি মারলেন। আমিও ওই ওভারে দুটি বাউন্ডারি মারতে পারলাম। আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল।”

“দুর্ভাগ্যজনকভাবে তামিম ভাই একটু পর আউট হয়ে গেল, কিপার কুইন্টন ডি কক অসাধারণ একটা ক্যাচ নিয়েছিল এক হাতে। তবে রিয়াদ ভাই (মাহমুদউল্লাহ) এসে বললেন, ‘চিন্তা করিস না, আমি আছি।’ উনি শুরু থেকে ভালো খেলছিলেন। তাতে আরও সাহস পেলাম।”

“এরপর ইনিংস এগিয়ে নিয়েছি। সকালের পর আর খুব সমস্যা হয়নি। সেটিই হয়তো আমার জন্য কাল হয়েছে। মানসিকভাবে হয়তো একটু রিল্যাক্সড হয়ে গিয়েছিলাম, এজন্যই স্পিনে আউট হয়ে গেছি (কেশভ মহারাজের বলে)। ক্যাচটা অবশ্য খুব ভালো নিয়েছিল মারক্রাম। খুব খারাপ লেগেছিল তখন, এত কষ্ট করেও একটুর ভুলে সেঞ্চুরি পর্যন্ত যেতে পারলাম না।”

“তবে ওই ইনিংসটি আমার জন্য বড় শিক্ষা ছিল। চাপের মধ্যে খেলা, ভয়ঙ্কর স্পেল পার করে দেওয়া, এসব তো আমরা সবসময় বলি। কিন্তু নিজে করতে পারলে সেই অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে অমূল্য। আমার যেমন ওই ইনিংসের অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে পরে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।”

“জিম্বাবুয়ে সিরিজে (২০১৮) প্রথম টেস্টে হেরে গিয়ে আমরা প্রচণ্ড চাপে ছিলাম। এরপর মিরপুর টেস্টেও শুরুতে ব্যাটিংয়ে নেমে ৩ উইকেট পড়ে গেল দ্রুতই। ভীষণ চাপে আমরা তখন। কাইল জার্ভিস আর টেন্ডাই চাতারা অসাধারণ বল করছিল।”

“আমি আর মুশফিক ভাই প্রচণ্ড ধুঁকছিলাম শুরুতে। তবে ওই পচেফস্ট্রুমের ইনিংসটির কথা মনে রেখে শুধু চেয়েছি উইকেটে থাকতে, কোনো রকমে পার করে দিতে। মুশফিক ভাইয়ের সঙ্গে আলাপও করছিলাম এটিই যে লড়াই করতে হবে। এক পর্যায়ে আমার রান ছিল ৪০ বলে ১০। মুশফিক ভাইয়েরও ওরকম।”

“টিকে যাওয়ার পর ঠিকই সব সহজ হয়ে গেছে। আড়াইশ রানের জুটি গড়েছি দুজন (২৬৬)। আমি ১৬১ করেছিলাম, মুশফিক ভাই ডাবল সেঞ্চুরি। পচেফস্ট্রুমের ইনিংসটি অনেক শিখিয়েছে আমাকে।”