স্মরণীয় দ্বৈরথ: এখনও তামিমের অস্বস্তির নাম ‘ভিটোরি’

প্রতিপক্ষের সেরা অস্ত্রের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলতে গিয়ে গড়বড় নিজের মনস্তত্ত্বেই! সেই গ্যাড়াকলে পড়েছিলেন তামিম ইকবাল। নিজের ফাঁদে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করেছেন দিনের পর দিন। ২০১১ সালের জিম্বাবুয়ে সফরে ব্রায়ান ভিটোরিকে ‘অর্ডিনারি’ বলার পর দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা এখনও ভুলতে পারেন না তামিম।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2020, 08:56 AM
Updated : 27 April 2020, 01:51 PM

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত আয়োজন ‘স্মরণীয় দ্বৈরথ’-এ বাংলাদেশের বর্তমান-সাবেক ক্রিকেটারদের অনেকে শুনিয়েছেন কঠিন সব চ্যালেঞ্জ জয়ের গল্প। তবে জয়ের গল্পই তো কেবল স্মরণীয় নয়। কখনও কখনও লড়াই জিততে না পারার স্মৃতিও দাগ কেটে রয় হৃদয়ে। তামিম যেমন তুলে আনলেন ৯ বছর আগে মানসিক চাপ জয় করতে না পারার অভিজ্ঞতা।

সেটি ২০১১ সালে বাংলাদেশের জিম্বাবুয়ে সফর। হারারের টেস্টে দলের প্রথম ইনিংসে দারুণ বোলিংয়ে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন ভিটোরি। শুধু উইকেট সংখ্যায় নয়, বাঁহাতি পেসার নজর কেড়েছিলেন নতুন বলে সুইং বোলিংয়ের দক্ষতা দিয়েও। টেস্টের চতুর্থ দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে একটি প্রশ্নের জবাবে তামিম বলেছিলেন, ‘ভিটোরি অর্ডিনারি।’

তামিমের সেই মন্তব্যর পর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল তুমুল। জিম্বাবুয়েতে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সামান্যই, সেখানে ক্রিকেট অনুসারী খুব বেশি নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একরকম শূলে চড়ানো হয়েছিল তামিমকে।

সমালোচনার তোপ আরও বাড়ে টেস্ট সিরিজ শেষে প্রথম ওয়ানডেতে ভিটোরির বলে তামিম আউট হওয়ার পর। প্রচণ্ড চাপে থাকা তামিম দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও আউট হন এই বাঁহাতি পেসারের বলে। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ওয়ানডেতেই ভিটোরি নিয়েছিলেন ৫টি করে উইকেট।

বাংলাদেশ সেবার হেরেছিল একমাত্র টেস্ট, হেরেছিল ওয়ানডে সিরিজ। তামিম শোনাচ্ছেন তার দুঃস্বপ্নের সেই অধ্যায়।

‘এখনও ভাবলে অস্বস্তি হয়’

“এত বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছি, লড়াই জয়ের গল্প অনেক আছে। অনেক লড়াই হেরেছিও। অনেক কিছুই স্মরণীয়। তবে ব্রায়ান ভিটোরিকে নিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা আমি মনে হয় কখনও ভুলব না। এখনও ভাবলে অস্বস্তি হয়। আমি নিশ্চিত, আবারও যদি ভিটোরিকে খেলতে যাই, নার্ভাস থাকব যথেষ্ট।”

“আমি ভিটোরিকে অর্ডিনারি বলেছিলাম স্রেফ হালকা চালে। প্রেস কনফারেন্সে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন তাকে নিয়ে। ভিটোরি তখন প্রথম ইনিংসে চার উইকেট নিয়েছে। ওদের মূল বোলার। টেস্টের মাঝপথে আমি কেন তাকে প্রশংসায় ভাসাব? আমার মনে হয়েছিল, এখন তার মনোবল বাড়িয়ে লাভ নেই। বরং আমাদের দলকে সাহস দেই। জিম্বাবুয়ে দল ও ভিটোরির সঙ্গে একটু সাইকোলজিকাল গেম খেলি। এই তো। তাছাড়া, যতদূর মনে পড়ে, ওই দিন আমি ভিটোরিকে খুব ভালো খেলেছিলাম (ভিটোরির ২৭ বলে ৬ চারে ৩২ রান করেছিলেন তামিম)। সব মিলিয়েই করেছিলাম ওই মন্তব্য।”

“কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ও মিডিয়া ভয়ঙ্কর সমালোচনা শুরু করল। আমরা ওই টেস্ট হেরেছিলাম, এজন্য হয়তো সমালোচনা আরও বেশি হয়েছে। ক্রিকেটে যুগে যুগে সাইকোলজিকাল গেম তো অনেকেই খেলেছে। কখনও সফল হয়েছে, কখনও হয়নি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে নিজ দেশেই যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছিল, তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমার ভাবনার বাইরে ছিল।”

“সেই সমালোচনা খুব বাজেভাবে প্রভাব ফেলেছিল আমার ওপর। ওয়ানডেতে ভিটোরির বলে এজন্যই আউট হয়েছি। আমার ওই সময়ের মানসিক অবস্থা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। মাঠে নেমেছিলাম ভয় নিয়ে, ভিটোরির বলে আউট হওয়া যাবে না। কিন্তু ওই ভয়ই কাল হয়েছে।”

“মানসিকভাবে এত ধুঁকছিলাম, তা বলার মত নয়। একটা বলও মনে হয় স্বস্তি নিয়ে খেলতে পারিনি। আত্মবিশ্বাস ছিল তলানিতে। ভিটোরির বলেই বাজে একটা শটে আউট হলাম।”

“তারপর সমালোচনা আরও বাড়ল। আমি সেটি আর নিতেই পারছিলাম না। পরের ওয়ানডেতে যখন নামলাম, তখন আমি আসলে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। এতটা মেন্টাল ব্লকনেস জীবনে আর কখনও কাজ করেনি। এবার ভিটোরির প্রথম ওভারেই আউট হলাম।” 

“জীবনে অনেক বড় বড় বোলারকে খেলেছি সেবারের আগে ও পরে। কিন্তু কখনোই আমার মনে হয়নি, অমুক বোলারকে খেলতে চাই না। কখনও মনে হয়নি, স্ট্রাইক বদলে অন্য প্রান্তে যাই। সেই একবারই মনে হচ্ছিল, ভিটোরির সামনে পড়তে চাই না। স্ট্রাইক পেলেও মনে হচ্ছিল, কোনো রকমে প্যাডে-ট্যাডে লাগিয়ে হলেও অন্যপ্রান্তে চলে যাই। সেটিও পারছিলাম না। আউট হওয়ার ভয় থেকেই আউট হয়েছি।”

“তখন বয়স কম ছিল, অভিজ্ঞতাও কম ছিল। মনের ভেতর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল আমার, সেটি সামলানোর উপায় জানতাম না। জীবনে প্রথমবার অমন অভিজ্ঞতা। দলের কারও সঙ্গে যে শেয়ার করব বা কারও কাছ থেকে পরামর্শ নেব, সেটিও বুঝতে পারছিলাম না। এখন যেমন জানি, কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। তখন পুরো আঁধারে ছিলাম।”

“তৃতীয় ওয়ানডেতে পণ করেছিলাম, আর যাই করি, তার বলে আউট হওয়া যাবে না। খুব সাবধানে খেলে তাকে পার করেছি। ফিফটির কাছে গিয়ে রান আউট হয়েছিলাম সেই ম্যাচে (৬২ বলে ৪৪)। তারপরও স্বস্তি ছিল যে অন্তত তাকে উইকেট দেইনি।”

“ওয়ানডে ও টেস্টে আর কখনও ভিটোরিকে খেলা হয়নি। তবে ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়ে টি-টোয়েন্টিতে তাকে পেলাম। মানসিকভাবে তখন আগের চেয়ে পরিণত হয়েছি। তবে সেই পুরনো ভয়টা ছিল। প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ভিটোরির দ্বিতীয় বলেই বোল্ড হলাম। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে অবশ্য ভালো খেলেছিলাম (৩০ বলে ৪৩)।”

“তবে সত্যি বলতে, ভিটোরির কথা ভাবলে এখনও আমার অস্বস্তি হয়। সেই অভিজ্ঞতাটা এতই ভয়ানক ছিল, মনে পড়লে এখনও আতঙ্ক লাগে। আমার মনে হয়, আবার কখনও ভিটোরিকে খেলতে গেলেও মানসিক অবস্থা একইরকম হবে।”

(চমক জাগানিয়া অভিষেকের পর ভিটোরির ক্যারিয়ার বারবার থমকে গেছে ত্রুটিপূর্ণ বোলিং অ্যাকশনের কারণে। অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কয়েকবার, নিষিদ্ধ হয়েছেন তিন দফায়। ৪ টেস্ট ও ২৪ ওয়ানডে খেলতে পেরেছেন মোটে। সবশেষ ২০১৮ সালের মার্চে বোলিংয়ে নিষিদ্ধ হওয়ার পর ক্রিকেটের বাইরে আছেন প্রায় দুই বছর ধরে। বয়স এখন পেরিয়েছে ৩০)।