লেগ স্পিনারদের আশার পালে আমিনুলের দোলা

“আমাদের একজন লেগ স্পিনার ছিল, কিন্তু সে তো বিবর্ণ হয়ে গেল…খুবই হতাশাজনক,”  ২০১৬ সালে জুবায়ের হোসেনের ব্যাপারে আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন তখনকার বাংলাদেশ কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে। দেশের ক্রিকেটের দীর্ঘ সেই হাহাকার গত বছরের শেষ দিকে এসে কিছুটা ঘুচেছে। আমিনুল ইসলামকে পেয়ে বাংলাদেশ অন্তত বলতে পারছে, আমাদের একজন লেগ স্পিনার আছে। এই তরুণকে দেখে নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন নিজেকে হারিয়ে খোঁজা নূর হোসেন, হাথুরুসিংহের সেই হতাশা জুবায়ের আর সম্ভাবনাময় মিনহাজুল আবেদীন আফ্রিদি।

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2020, 02:10 PM
Updated : 13 April 2020, 03:24 PM

যাকে দেখে তারা নতুন স্বপ্নের রসদ পাচ্ছেন, সেই আমিনুল নিজেও অবশ্য পায়ের নিচে জমিন শক্ত করতে পারেননি এখনও। তবে অন্তত টি-টোয়েন্টিতে হলেও জাতীয় দলে নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছেন একজন লেগ স্পিনার, অন্যদের জন্য এটিও বড় প্রেরণা।

গত সেপ্টেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন আমিনুল। ২০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে ৭ ম্যাচে নিয়েছেন ১০ উইকেট।   

জাতীয় দলে এখন পর্যন্ত মূলত এই এক সংস্করণেই বিবেচনা করা হচ্ছে আমিনুলকে। লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন ১৫টি, প্রথম শ্রেণির ম্যাচ মোটে একটি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব সংস্করণের জন্য বিবেচিত হতে হলে তাকে পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ।

বাস্তবতা বলছে, সেই পথ কাঁটায় ভরা। একজন লেগ স্পিনারকে প্রস্ফুটিত হতে দেওয়ার মতো ক্রিকেট সংস্কৃতিই যে বাংলাদেশের এখনও গড়ে ওঠেনি! প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের সামনে প্রতিবন্ধকতা।

লেগ স্পিনারদের জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি যেটি, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেখানেই ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। পর্যাপ্ত ম্যাচ খেলার সুযোগ না পাওয়া!

খেলার সুযোগ যেন সোনার হরিণ

লেগ স্পিনার নিয়ে হাহাকার, বাংলাদেশের ক্রিকেটে কান পাতলেই শোনা যায়। অথচ লেগ স্পিনারের সন্ধানে দেশের ক্রিকেট যতটা মরিয়া, তাদের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘরোয়া দলগুলি ততটাই উল্টো রথের যাত্রী। একটি ম্যাচ খেলার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকতে হয় নুর, জুবায়ের, আফ্রিদিদের। আঙুলের কড়ে গুনে তারা বলে দিতে পারেন, গত কয়েক বছরে কয়টি ম্যাচ খেলেছেন।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের পর প্রথম শ্রেণি, লিস্ট ‘এ’ কিংবা টি-টোয়েন্টি, কোনো সংস্করণেই কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি নূরের। বয়স খুব বেশি হয়নি এখনও। তারপরও যেন চলে গেছেন অনেকটা বিস্মৃতির আড়ালে।

গত মৌসুমে খেলেছেন তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ২৭ বছর বয়সী লেগ স্পিনার জানালেন, ক্রিকেট মাঠ ছেড়ে যাননি। প্রিমিয়ার লিগ ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আবার শুরুর অপেক্ষায় দিন গুণছেন।

প্রিমিয়ার লিগে এবার দল পেয়েছেন জুবায়ের। করোনাভাইরাসের জন্য খেলা বন্ধ হওয়ার আগে পারটেক্সের একমাত্র ম্যাচে খেলার সুযোগ হয়নি। যেহেতু শিরোপা লড়াইয়ে থাকা কোনো ক্লাব নয়, এবার তাই কিছু ম্যাচ পাওয়ার আশায় ছিলেন ২৫ বছর বয়সী এই লেগ স্পিনার। কিন্তু খেলা বন্ধ থাকায় তার কণ্ঠে ফুটে উঠল অসহায়ত্ব।

“পারটেক্সের সবাই আমাকে সাহায্য করেছে। সবাই সমর্থন করেছে এবং নিশ্চয়তা দিয়েছে, ‘তুমি ম্যাচ খেলবে।’ সে হিসেবে ম্যাচ খেলার এবার বেশ সুযোগ ছিল, কিন্তু যা হলো। আসলে কারও কিছু করার নেই, প্রাকৃতিক ব্যাপার। আশা করি, প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে আবার খেলা শুরু হবে। তো তখন সুযোগ পেলে চেষ্টা থাকবে ভালো কিছু করার।”

আমিনুলের আগে জুবায়েরই ছিল দেশের ক্রিকেটে লেগ স্পিনে আশার বাতিঘর। সহজাতভাবেই বল টার্ন করাতে পারতেন, ছিল দারুণ গুগলি। প্রতিভা ছিল বলেই ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার আগেই তাকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে আসেন নির্বাচকেরা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ও ‘লিস্ট এ’ অভিষেক তার বাংলাদেশ ‘এ’ দল দিয়ে।

জাতীয় দলেও জায়গা করে নেন দ্রুতই। অভিষেক টেস্ট সিরিজে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট, ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টে পান ৫ উইকেটের স্বাদ। এরপর ভারতের বিপক্ষে ফতুল্লা টেস্টে বিরাট কোহলিকে বোল্ড করা তার সেই গুগলি এখনও চোখে লেগে আছে অনেকের। অথচ গত ৫ বছর ধরে তিনি টেস্ট ক্রিকেট থেকে দূরে।

খুব খারাপ করে যে টেস্ট থেকে বাদ পড়েছিলেন, এমন নয়। সবশেষ বোলিং করা টেস্টেও নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। কিন্তু তিনিও শিকার দেশের ক্রিকেটের পুরনো রোগের। জাতীয় দলে খেলার সময়ই ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন ব্রাত্য!

জায়গা হারানোর পরও চিত্রটা প্রায় একই। কোনো কোনো টুর্নামেন্টে দল পান না। দল পেলে একাদশে জায়গা মেলে না। একাদশে থাকলে যথেষ্ট বোলিংয়ের সুযোগ মেলে না। ২০১৮ সালে জাতীয় লিগে এক ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার পরও দ্বিতীয় ইনিংসে তার লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল হাত ঘুরাতে।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সবশেষ টেস্ট খেলার পর এই ৫ বছরে দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি সুযোগ পেয়েছেন কেবল ৮ ম্যাচে!

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জুবায়ের জানালেন, মাঝে মধ্যে যাও বা সুযোগ মেলে, সেটা হারালে হাওয়া হয়ে যায় পুরো মৌসুম।

লেগ স্পিনারদের জন্য একটি-দুটি ম্যাচ বাজে যাওয়া কিংবা খরুচে বোলিং করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের যা চর্চা, এক ম্যাচ খারাপ করলেই দীর্ঘ সময় চলে যেতে হয় বিবেচনার বাইরে। আগ্রাসী লেগ স্পিনের চেয়ে দলগুলির পছন্দ নিয়ন্ত্রিত অফ স্পিন বা বাঁহাতি স্পিন।

এক ম্যাচে বাজে পারফরম্যান্সের খেসারত দিতে হয়েছে জুবায়েরকেও।

“অনেক সময় এমন হয়েছে যে, একটা ম্যাচ খারাপ খেলার পরই পুরো মৌসুম বসে থাকতে হয়েছে আমার। বেশিরভাগ সময়ই আমি ঘরোয়া লিগে টানা খেলতে পারিনি। তাতে আমার ক্যারিয়ারের জন্য অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে বলে আমি মনে করি।”

“জাতীয় দলে খেলে ফেলার পরেও আমি ঘরোয়া লিগ খেলতে পারিনি। এমন নয় যে আমি জাতীয় দলে খারাপ খেলেছি বা বাদ পড়ে যাওয়ার পরের কথা এটা। যখন জাতীয় দলে ছিলাম, তখনও ঘরোয়া লিগ খেলতে পারিনি। যে কয় জন লেগ স্পিনারের কথা শোনা যায়, তারাও কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত না। ঘরোয়া লিগে দেখা যাচ্ছে তারাও দল পাচ্ছে না, এভাবে একজন লেগ স্পিনারের পক্ষে খেলা কঠিন, যেটার ভুক্তভোগী আমি।”

ম্যাচ খেলার জন্য হাপিত্যেশ করতে করতে কিছুদিন খ্যাপ খেলে বেড়িয়েছেন জুবায়ের। তার বিশ্বাস, একটা মৌসুমে ঠিক মতো খেলার সুযোগ পেলেই ছন্দে ফেরা সম্ভব।

“একটা বছর খেলতে পারলে ফেরা সম্ভব বলে মনে করি। আমার মূল লক্ষ্যটা হচ্ছে, একটা বছর ভালো মত খেলা, যেখানেই খেলি যেন পারফর্ম করতে পারি, নিজের সেরাটা দিতে পারি।”

আমিনুল ছাড়া গত বিপিএলে দেশের লেগ স্পিনারদের মধ্যে খেলার সুযোগ মিলেছিল কেবল আফ্রিদির। তবে বোলিং পেয়েছিলেন স্রেফ ১ ওভার। ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি প্রস্তুতি ম্যাচ দিয়ে আলোচনায় আসা ২১ বছর বয়সী এই স্পিনারের এগিয়ে চলার পথেও মূল সমস্যা একাদশে জায়গা না পাওয়া।

“দল পাই এটা ঠিক আছে, কিন্তু ম্যাচ খেলতে পারি না, এটা খারাপ লাগে। জাতীয় দল ছাড়া বোর্ডের সবগুলো দলেই ছিলাম। তবে ম্যাচ খেলার সুযোগ কমই পেয়েছি। বিপিএলে দুইটা ম্যাচ খেলেছি, গত বছর প্রিমিয়ার লিগে তিনটা ম্যাচ খেলেছি। 'এ' দলে খেলতে পারিনি, ইমার্জিং টিমস এশিয়া কাপে একটা ম্যাচ খেললাম, নেপালে গিয়ে এসএ গেমসে তিনটা ম্যাচ খেলছি। এটাই সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা।” 

বিপিএলের সুবাদে টম মুডির সঙ্গে কথা হয় আফ্রিদির। খেলার সুযোগ কতটা মিলছে, তার কাছে প্রায়ই জানতে চান অস্ট্রেলিয়ান কোচ।  

“সপ্তাহে ৩-৪ দিন মুডির সঙ্গে কথা হয়। উনি জানেন যে, আমি ম্যাচ খেলছি না। কবে ম্যাচ খেলব, এসব জিজ্ঞেস করেন। ম্যাচের আগে আমি উনাকে বলি, ‘কোচ আমার কাল বা পরশু ম্যাচ আছে।’ ম্যাচের আগেই উনাকে জানাই। তখন উনি ম্যাচের দিন জিজ্ঞেস করেন, খেলছি কী না। প্রায় সময়ই ‘নো’ বলতে হয়।”

আমিনুলসহ দেশের অনেক লেগ স্পিনারের ‘গুরু’ ওয়াহিদুল গণি। লেগ স্পিনারদের জন্য ম্যাচ খেলার গুরুত্ব তিনি খুব ভালো করে জানেন, বলেও আসছেন বছরের পর বছর। দেশের ক্রিকেট মহলকে সেই একই বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন এখনও। অন্তত জাতীয় লিগে যেন লেগ স্পিনারদের পর্যাপ্ত সুযোগ মেলে, সেই আকুতি তার কণ্ঠে।

“প্রাথমিক পর্যায়ে ছেলেগুলোকে নিচের পর্যায়ে খেলাতে হবে। আগে বয়সভিত্তিক দলে খেলাতে হবে। পরে একাডেমি দলে খেলাতে হবে। এরপর জাতীয় ক্রিকেট লিগে নিয়ে আসতে হবে। জাতীয় লিগ এমন একটা জায়গা যেখানে লম্বা ক্রিকেট হয়। অনেক সময় পায় একটা ছেলে বোলিং করার।”

“যেহেতু এটা আমাদের নিজেদের টুর্নামেন্ট, হার-জিত মুখ্য ব্যাপার নয়, একজন খেলোয়াড়ের উন্নতি হবে মূল ব্যাপার। আমি মনে করি, এটা একটা সঠিক জায়গা, যেখানে আমরা রিস্ট স্পিনার তৈরি করতে পারি। আমাদের এখানে জুনিয়র লেভেলে অনেক লেগ স্পিনার আছে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা খেলাতে চাই না। তাদের সুযোগ দিই না। সুযোগ দিলে না বোঝা যাবে কীভাবে তারা কতটা যোগ্য!”

সুযোগ-আস্থা-সহানুভূতি

এক জন লেগ স্পিনারকে গড়ে তুলতে, তার ওপর ভরসা রাখার কোনো বিকল্প দেখেন না ওয়াহিদুল। বর্ষীয়ান এই কোচের মতে, একজন লেগ স্পিনার যখন ছন্দ পেতে ধুঁকছেন, তার কাঁধে অধিনায়কের আস্থা ও সহানুভূতির হাত রাখা তখনই সবচেয়ে জরুরি।

“কিংবদন্তি লেগ স্পিনার আব্দুল কাদির বলেছিলেন, তার ক্যারিয়ারে ইমরান খানের প্রভাব কতটা। কঠিন সময়ে অধিনায়ক কীভাবে তাকে আগলে রেখেছিলেন।”

“একজন লেগ স্পিনারকে গড়ে তোলা কেবল খেলোয়াড়-কোচের ব্যাপার নয়, ম্যানেজমেন্টেরও বড় একটা ভূমিকা থাকে। কোন দলের বিপক্ষে খেলাবে, কোথায় খেলাবে এসবের সঙ্গে মাঠে ভালো একজন অধিনায়ক লাগে। একজন লেগ স্পিনারকে আগলে রাখার দরকার আছে। তার প্রতি অধিনায়কের সহানুভূতি থাকার প্রয়োজন আছে।”   

একই তাগিদ ২৬টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৮০ উইকেট নেওয়া লেগ স্পিনার নূরের কণ্ঠেও। স্রেফ লেগ স্পিনার বলেই খেলার আশা তিনি করছেন না। পারফরম্যান্স দিয়েই করে নিতে চান জায়গা। কিন্তু একাদশে সুযোগ দেওয়া হলে, আরেকটু বেশি আস্থা রাখার অনুরোধ জানালেন তিনি।

“লেগ স্পিনাররা তো একটু খরুচেই হবে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট তুলে নিবে দুই-তিনটা। আমাদের দেশে যেটা হয়, ম্যাচ শেষে দেখা হয় ১০ ওভারে কে কত কম রান দিল। লেগ স্পিন ব্যাপারটা কিন্তু অন্যরকম। হ্যাঁ, শুরু থেকে লাইন লেংথ ঠিক রাখতে পারলে রানও কম দেওয়া যায়। এই ভরসার জায়গাটা কম আমাদের দেশে। বিশ্বাস রাখতে হবে, সুযোগ দিতে হবে।”

“একটা ম্যাচ হয়তো ভালো খেললাম। পরের ম্যাচে খারাপ খেললেই ম্যানেজমেন্ট থেকে নানা ধরনের কথা বলতে থাকে। এমন হলে দেখা যায়, ওই ক্রিকেটার মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। কারণ, বাদ পড়ার ভয়ে থাকতে হয়। আত্ববিশ্বাস কমে যায়। আমি বলব, এই সময় সুযোগটা যেন বেশি দেওয়া হয়। এক ম্যাচ খারাপ করলে আরেক ম্যাচ যেন সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে ভুল শুধরানোর সুযোগ থাকে।”

সমাধান কী?

ওয়াহিদুল আবারও মনে করিয়ে দিলেন, একটা সমাধান হতে পারে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। সেখানে লেগ স্পিনারকে যথেষ্ট সুযোগ দিয়ে তার সামর্থ্য দেখে নেওয়া যেতে পারে।

“আমি মনে করি, যদি ওদের নিয়ে চেষ্টা করতে হয় সেটা বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে করলেই ভালো। সেখানে দুটি ইনিংস পাওয়া যায়, অনেক লম্বা সময় ধরে বোলিংয়ের সুযোগ পাওয়া যায়।”

“আমিনুল শুরু করেছে টি-টোয়েন্টি দিয়ে। এই ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানের শট খেলতেই হয়। এখানে উইকেট পাওয়া খুব কঠিন নয়। তবে আসল পরীক্ষা হবে বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে। আমিনুল এখনও প্রাথমিক পর্যায়ের লেগ স্পিনার। ওর অনেক কিছু জানার আছে, শেখার আছে। ওকে অনেক কষ্ট করতে হবে। সে এখনও সেভাবে পরীক্ষিত নয়।”

জাতীয় লিগে লেগ স্পিনার খেলানো নিয়ে গত মৌসুম থেকে বেশ কড়াকড়ি করেছে বিসিবি। এটি আশা দেখাচ্ছে জুবায়েরকে।

“এবার বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছিল, জাতীয় লিগে লেগ স্পিনার খেলাতেই হবে, এটা দারুণ ব্যাপার ছিল। এ কারণে আমরা কিছু ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছি। নইলে হয়তো একটা ম্যাচও খেলার সুযোগ পেতাম না। বোর্ডের অধীনে খেলাগুলোতে এমন সহযোগিতা যদি পাওয়া যায়, আমি মনে করি ভালো লেগ স্পিনার পাবে দেশ। এটা না হলে, লেগ স্পিনার হিসেবে খেলাটা কঠিন।”

“এছাড়া বোর্ডের অধীনে কিছু দল আছে, যেমন এইচপি, 'এ' দল এসব। দেখা যাচ্ছে যে, ঘরোয়া লিগে আমরা নিয়মিত নই। ঘরোয়া লিগে না খেলায় এইচপি বা 'এ' দলেও রাখা হয় না। বোর্ড যদি এ জায়গাগুলোতে আমাদের দিকে একটু নজর দিত…এমনও যদি হয়, আমরা এইচপিতে নেই কিন্তু তাদের সাথে অনুশীলন করছি, ম্যাচ খেলছি। এ সুযোগটা যদি দিত, তাহলে আমাদের জন্য অনেক ভালো হতো।”

বোর্ডের পদক্ষেপে আশার আলো দেখছেন আফ্রিদিও। অন্তত নিজেকে প্রমাণের সুযোগ তো মিলছে!

“ম্যাচ না খেলতে পারলে খারাপ লাগে। জাতীয় লিগে অবশ্য ঠিক ছিল, জাতীয় লিগে চার ম্যাচে ছিলাম দলের সঙ্গে, চার ম্যাচই খেলছি। পরে ইমার্জিং এশিয়া কাপের জন্য চলে যাওয়ায় দুইটা ম্যাচ খেলতে পারিনি। আমাদের চট্টগ্রাম বিভাগের ম্যানেজমেন্ট বিসিবির কথা রেখেছিল। বোর্ডের এই চাপ দেওয়াটা ভালো লক্ষণ। আমাদের দলে নিলেও ম্যাচ খেলানো হয় না, আমাদের ওপর হয়তো উনাদের বিশ্বাস থাকে না। আমরা যদি না খেলি আমাদেরই তো ক্ষতি, কীভাবে প্রমাণ করব?”

“বোর্ড আমাকে সবগুলো জায়গায় রেখেছে জাতীয় দল ছাড়া, ম্যাচ খেলতে না পারলেও অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগাতে চাচ্ছিলাম, বসে থাকলেও প্রতিপক্ষ দলে যারা খেলে বা আমার সতীর্থ যারা তাদের কাছ থেকে শেখা যায়। বিপিএলে বসে থাকলেও অনেক লেগ স্পিনার একসঙ্গে হয়েছে যেটা আমার জন্য ভালো হয়েছে। আমার দলে অলকদা খেলেছে, উনার কাছ থেকে শিখতে পেরেছি।”

আশা দেখাচ্ছেন আমিনুল

ইংলিশ ও আফগান লেগ স্পিনারদের সামলানোর প্রস্তুতিতে সহায়তা করতে ২০১৬ সালে ডাক পড়েছিল জুবায়ের ও নূরের। জুবায়ের এখনও বিভিন্ন সময় জাতীয় পর্যায়ের নেটে বোলিং করেন প্রায়ই। তবে একসময় দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে আসা নূর আপাতত দেশের ক্রিকেটের মূল স্রোত থেকে বেশ দূরে। আমিনুলকে দেখে আবার অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন তিনি।

“ইচ্ছে আছে আবার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলার। অবশ্য এ বছর প্রিমিয়ার লিগে কারও সাথে কথা হয়নি।”

“লেগ স্পিনারদের গুরুত্ব না দিয়ে দেখলে ভালো লেগ স্পিনার আসবে না। এখন যেভাবে দেখছে বোর্ড এটা সত্যি ইতিবাচক বলতে হয়। এরকম চললে দুই-তিন জন লেগ স্পিনার বের করা কঠিন কিছু হবে না। এখন বিপ্লব (আমিনুল) খেলছে, দেখা যাবে তার বিকল্প আরও দুয়েক জন প্রস্তুত থাকবে।”

দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার অনুভূতি কী, ভালো করেই জানা জুবায়েরের। দিনের পর দিন বাইরে বসে থাকায় আক্ষেপ হয় অনেক সময়ই। তবে যখন ভাবেন, লেগ স্পিনার না হলে দেশের হয়ে খেলাই হতো না, আবারও লড়াইয়ের উৎসাহ পান তিনি।

“লেগ স্পিনার হয়েই জাতীয় দলে খেলেছি, অপেক্ষায় আছি নিজেকে প্রমাণ করে আবার দলে জায়গা করে নেওয়ার। এবার সুযোগ পেলে জায়গাটা যেন পাকা করতে পারি, সেই চেষ্টা থাকবে।”

জাতীয় দল ছাড়া আর সব জায়গায় অন্তত দলে থাকছেন আফ্রিদি। চট্টগ্রামের এই তরুণের আশার পালে হাওয়া দিচ্ছে টি-টোয়েন্টিতে আমিনুলের নিয়মিত উপস্থিতি।

“একটা জিনিস কী, ভালো খেললে তো আর কেউ বাদ দিতে পারবে না। এটা আমার ভেতরে কাজ করে সবসময়। কোথাও সুযোগ পেয়ে যদি ভালো খেলে ফেলি, তাহলে তো আর বাদ দেওয়া সম্ভব না।”

যা ভাবছেন আমিনুল

কোচ ওয়াহিদুল গণি নিশ্চিত, যেভাবে জীবন সংগ্রাম করে উঠে এসেছেন আমিনুল, তাতে অকালে হারিয়ে যাবেন না এই লেগ স্পিনার। টানাটানির সংসারে পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ এই প্রতিভাবান তরুণের শুরু ওয়াহিদুলেরই ক্রিকেট একাডেমিতে।

বয়সভিত্তিক ক্রিকেট হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটের শুরুর মৌসুম পর্যন্ত আমিনুল ছিলেন ব্যাটিং অলরাউন্ডার। তবে লেগ স্পিনের ঝলক দিয়ে জাতীয় দলে আলো ছড়ানোর পর আপাতত বোলিংই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তার কাছে। ক্যারিয়ার নিয়ে লক্ষ্য যদিও পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার হওয়া।

“লেগ স্পিনই আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ব্যাটিংয়ে সুযোগ পেলে ভালো করার জায়গা আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার লক্ষ্য নিজেকে ভালো একজন অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। গুগলিটা মোটামুটি ভালো হয়। গুগলি আর ফ্লিপার নিয়ে এখনও কাজ করছি। আশা করছি, এটা সামনে আরও ভালো হবে।”

“সত্যিকারের অলরাউন্ডার হতে চাই। বিশ্ব ক্রিকেটে আধিপত্য করার মত একজন হতে চাই। দিন দিন উন্নতি করার চেষ্টা করছি। ম্যাচ বাই ম্যাচ ভালো খেলার চেষ্টা করব। নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।”

বাংলাদেশে একজন লেগ স্পিনারের জীবন কেমন, অজানা নয় আমিনুলের। উপেক্ষা আসতে পারে, কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়তে হতে পারে, জানেন এই তরুণ। চ্যালেঞ্জ বেশি বলেই আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে মুখোমুখি হতে চান। 

“(বাংলাদেশে লেগ স্পিনার হিসেবে টিকে থাকা) খুব কঠিন। এটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছি। চ্যালেঞ্জ নিয়ে কোনো কিছু করার মজাই আলাদা। কোনো চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেখানে জয়ী হলে নিজের কাছেই খুব ভালো লাগে। আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি, এখন সাফল্য আসছে।”

“অনেক দিন খেলার স্বপ্ন সবারই থাকে। সবে শুরু করেছি। আমার অভিজ্ঞতা কম। নিজেকে প্রমাণ করার অনেক কিছু আছে। নিজেকে প্রমাণ করেই সবাইকে নিজের সামর্থ্য দেখাতে হবে। তবে, এটা আমার স্বপ্ন দেশকে অনেক দিন সার্ভিস দিবো।”