স্মরণীয় দ্বৈরথ: সাইফুলের সুইংয়ের শিকার জয়াসুরিয়া-রানাতুঙ্গা

সনাৎ জয়াসুরিয়া, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, আসাঙ্কা গুরুসিনহা, নামগুলি মনে পড়লে এখনও রোমাঞ্চের দোলা জাগে সাইফুল ইসলামের মনে। বাংলাদেশের যখন ওয়ানডে মর্যাদাও নেই, একেকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার জন্য অপেক্ষা করতে হতো তীর্থের কাকের মতো, সেই সময়েই সুইং বোলিংয়ের দারুণ প্রদর্শনীতে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং লাইনআপ নাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাইফুল।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2020, 01:23 PM
Updated : 10 April 2020, 01:23 PM

দুই দিকেই সুইং করানোর মতো সহজাত সুইং বোলার বাংলাদেশের ক্রিকেট পেয়েছে কমই। সাইফুল সেই বিরলদের একজন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ধারাবাহিক আয়োজন, ‘স্মরণীয় দ্বৈরথ’-এ সাইফুল তুলে আনলেন সুইং বোলিংয়ে লড়াই জয়ের স্মৃতিগুলো।

২৫ বছর আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটির কথা উঠে এলো অবধারিতভাবেই। শারজাহতে রেকর্ড গড়া বোলিংয়ে সাইফুল নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। বাংলাদেশের কোনো বোলার ওয়ানডেতে তার আগে ম্যাচে ২ উইকেটের বেশিও নিতে পারেননি।

ব্যাটের হাতও তার মন্দ ছিল না। দলের ভীষণ প্রয়োজনের সময় তার বেশ কিছু ১৫-২০ বা ২৫ রানের ইনিংস বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে রেখেছিল বড় ভূমিকা।

‘সেই সাফল্য ছিল ভাবনার বাইরে’

“ম্যাচের প্রথম বলেই উইকেট! ম্যাচটা আমাদের জন্য শুরুই হয়েছিল দুর্দান্তভাবে। আমি ভুলব না কখনোই।”

“টস জিতে বোলিংয়ে নেমেছিলাম আমরা। প্রথম ওভারে স্ট্রাইক নিল গুরুসিনহা। যতদূর মনে পড়ে, আমার বলটি মিডল স্টাম্পে পিচ করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। গুরুসিনহা ঠিকমত খেলতে পারেনি। ক্যাচ যায় বুলবুলের হাতে (আমিনুল ইসলাম)।”

“দারুণ শুরুর পর আমরা উজ্জীবিত ছিলাম। জয়াসুরিয়াকেও শূন্য রানে আউট করতে পারতাম। কিন্তু পয়েন্টে ক্যাচ নিতে পারল না বুলবুল। শটে জোর ছিল অবশ্য, তবে বুলবুলের নাগালেই ছিল।”

“আরেকপাশে শান্তও (হাসিবুল হোসেন) ভালো বল করেছে। রোশান মাহানামাকে দ্রুত আউট করে দিল। জয়াসুরিয়া তখনও বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেনি, তবে বিপজ্জনক ছিল। আমার টার্গেট ছিল, দ্রুত রান যেন করতে না পারে। শান্তর পর আতহার ভাইও ভালো বল করেছে। অরবিন্দ ডি সিলভাকেও দ্রুত রান করতে দেইনি। আমার জন্য, বোলারদের সবার জন্য বড় ব্যাপার ছিল সেটি।”

“ওদের চাপে ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু রানাতুঙ্গা নেমে খুব ভালো ব্যাট করল। জয়াসুরিয়াও ধীরে খেলে ফিফটি করল। ফিফটির পর অসুস্থ হয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। পরে যখন আবার ফিরল, আমি শুরুতেই আউট করে দিলাম (৭২ বলে ৫১)।”

“পরে রানাতুঙ্গাকেও আউট করেছি (৭২ বলে ৭১)। ইনসুইঙ্গার ছিল, বাঁহাতি রানাতুঙ্গার জন্য যেটি আসলে আউটসুইঙ্গার। সে না বুঝে খেলে ইনসাইড এজ লেগে বোল্ড হয়েছিল। পরে চামিন্দা ভাস আউট হলো মারতে গিয়ে। আকরাম ক্যাচ নিয়েছিল।”

“সেদিনের চার উইকেটই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের। আমার ন্যাচারাল ছিল আউট সুইঙ্গার (ডানহাতির জন্য)। তবে অ্যাকশন একটু বদলে ইনসুইঙ্গারও করতাম। বাঁহাতিদের জন্য সেটা বেরিয়ে যেত, অনেক সময় অনেক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান বুঝে উঠতে পারত না। ক্যারিয়ারে অনেক বাঁহাতিকে আউট করেছি এভাবে।”

“৪ উইকেট পাওয়া আমাদের দলের জন্য তখন অনেক বড় ব্যাপার। আমি খুব ভালো একটা রানআউটও করেছিলাম রুয়ান কালপাগেকে। আরও খুশি ছিলাম যে ওদেরকে মাত্র ২৩৩ রানে অলআউট করেছিলাম। শ্রীলঙ্কা ওই টুর্নামেন্টে একবারই অলআউট হয়েছিল। কিন্তু ব্যাটিংয়ে খারাপ করে আমরা বড় ব্যবধানেই হেরেছিলাম (১০৭ রানে)।”

“অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, আমি বল সুইং করাতে শিখেছিলাম কীভাবে। আমার আসলে সুইং ছিল ন্যাচারাল। কিছুটা শিখেছি অভিজ্ঞতার সঙ্গে। আউট সুইঙ্গার তো এমনিতেই অনেকের হয়ে যায় নতুন বলে। ইনসুইঙ্গার শেখাটা হলো আসল পরীক্ষা। টেকনিক্যাল কিছু কাজ করতে হয়। গ্রিপ, অ্যাকশন, সিমের ব্যবহার, কবজির পজিশন, বাতাসকে কাজে লাগানো, সুইং অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।”

প্রথম বলে আরও শিকার ও ব্যাটিং দৃঢ়তা

“সুইংয়ের কারণেই আমি অনেক সময় প্রথম বলে উইকেট পেয়ে যেতাম। আইসিসি ট্রফিতে (১৯৯৭) সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ম্যাচটার কথা মনে পড়ে। আমরা খুব বেশি রান করিনি (২০৫)। বোলিংয়ে নামার পর পাইলটকে (খালেদ মাসুদ) বললাম, ‘রেডি থাকিস, প্রথম বলেই আউট করব।’ আসলেই করেছিলাম!”

“ওই ডেলিভারি করেছিলাম ক্রস সিম। নতুন বলে ক্রস সিম তখন খুব বেশি করত না কেউ। আমি মাঝেমধ্যে পরীক্ষা করার জন্য করতাম। ওই বলটা করেছিলাম অনেকটা অনিল কুম্বলের মতো গ্রিপে। আমিরাতের ওপেনার সেলিম রাজা বুঝতে পারেনি। অবশ্যই নিশ্চিত জানতাম না যে উইকেট পাবই প্রথম বলে। মজা করে পাইলটকে বলেছিলাম। কাজে লেগে গেছে।”

“ব্যাটিংয়ে একটি লড়াইয়ের কথা আমি বিশেষভাবে বলব। সবাই আইসিসি বা এসিসি ট্রফিতে আমার ব্যাটিংয়ের কথা বলে। কিন্তু ওই এশিয়া কাপেই (১৯৯৫) ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে আমি একটা ইনিংস খেলেছিলাম ২২ রানের। ওই ইনিংন মনে পড়ে, কারণ আনিস (আনিসুর রহমান) ও আমি, আমরা ১০ আর ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান শেষ জুটিতে লড়াই করেছিলাম অনেকক্ষণ। ভারতের জাভাগাল শ্রিনাথ, মনোজ প্রভাকর, অনিল কুম্বলেরা ছিল। আমি ঠিক করেছিলাম, আউট হব না। হইনি শেষ পর্যন্ত।”

“অনেকেই জানে না, আমি একসময় ব্যাটসম্যানই ছিলাম। ক্লাব ক্রিকেট শুরুর সময় চার-পাঁচে ব্যাট করেছি। ব্যাটিং অলরাউন্ডার ছিলাম। পরে দেখলাম যে সুইং যেহেতু আমার ন্যাচারাল, এটাতে মনোযোগ বেশি দেই। কিন্তু ব্যাটিং করতে আমার সবসময় ভালো লাগত। যখনই উইকেটে গিয়েছি, দলের জন্য কিছু করতে চেয়েছি।”

“একবার অবশ্য নিজের চিন্তায় ব্যাট করেছিলাম। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪ উইকেট নেওয়ার ম্যাচেই আমার খুব ইচ্ছা ছিল, মুরালিধরনকে ছক্কা মারার। মেরেছিলামও একটা শট অনেক জোরে, ভেবেছিলাম ছক্কা হচ্ছে। কোত্থেকে চামিন্দা ভাস এসে ধরে ফেলল।”

“গুরুত্বের কথা যদি বলেন, তাহলে তো আইসিসি ট্রফিতে (১৯৯৭) নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ইনিংস সবকিছুর ওপরে। ওই ইনিংসটা না খেললে আমরা হয়তো বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারতাম না।”

“আমি যখন নামি তখনও ৬০ রানের মতো দরকার (৫৫ দরকার ছিল, দলের রান ৬ উইকেটে ৮৬)। আকরাম ছিল, আমি শুধু সিঙ্গেল নিয়ে ওকে স্ট্রাইক দিয়েছি। লক্ষ্য ছিল একটাই, যত কিছুই হোক, আমার উইকেট নিতে পারবে না ওরা। খারাপ লেগেছিল, জয়ের ৫ রান দূরে থাকতে আউট হই (২০ বলে ১৮)। তবে ম্যাচের জয়টা কখনোই ভোলার নয়।”