বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ধারাবাহিক আয়োজন, ‘স্মরণীয় দ্বৈরথ’-এ মিনহাজুল শোনালেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্কটিশ চ্যালেঞ্জ জয়ের গল্প। নিজের কাছে তার ক্যারিয়ারের স্মরণীয় আরও কিছু অধ্যায়ে স্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছে ওই বিশ্বকাপের আরও কয়েকটি পারফরম্যান্স।
ওই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ গিয়েছিল স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচকে লক্ষ্য বানিয়েই। জয়ের বাস্তব সম্ভাবনা ছিল তাদের বিপক্ষেই বেশি। নিউ জিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হেরে যাওয়া দল স্কটিশদের বিপক্ষেও ভয়ঙ্কর ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়েছিল। মিনহাজুল সেদিন ছিলেন ত্রাতা। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটিতে ৬৮ রানের অপরাজিত ইনিংসে গড়ে দিয়েছিলেন জয়ের ভিত।
‘দুঃস্বপ্নের শুরুর পর স্বপ্নের জয়’
“স্মরণীয় দ্বৈরথ নিয়ে আমাকে আসলে একটুও ভাবতে হচ্ছে না। স্কটল্যান্ড ম্যাচটি নিঃসন্দেহে আমার ক্যারিয়ারের বড় একটি মাইলফলক।”
“এডিনবরায় কন্ডিশন ছিল ভীষণ কঠিন। ৬-৭ ডিগ্রির মতো ছিল তাপমাত্রা, কিন্তু আরও বেশি ঠাণ্ডা লাগছিল প্রচণ্ড বাতাসের কারণে। আমরা একদম জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিলাম। অমন ঠাণ্ডায় অভ্যস্ত ছিলাম না মোটেও। উইকেটে ঘাসের ছোঁয়া তো ছিলই। সব মিলিয়ে খুব করে চাইছিলাম টস জিততে। কিন্তু স্কটল্যান্ড জিতে গেল টস, আমাদের ব্যাটিংয়ে পাঠাল।”
“অপির (মেহরাব হেসেন) সঙ্গে পাইলট (খালেদ মাসুদ) ওপেন করেছিল সেদিন। পাইলটই আগে আউট হলো, জন ব্লেইনের বাড়তি বাউন্সে। ব্লেইন অনেক জোরে বল করছিল, আরেক পাশে বাঁহাতি আসিম বাট সুইং করাচ্ছিল অনেক। তবে বাউন্সটাই বেশি ভোগাচ্ছিল। উইকেট বাউন্স ছিল আনইভেন।”
“দেখতে দেখতেই অপি, বুলবুল (আমিনুল ইসলাম), আকরাম আউট হয়ে গেল। আমি নামলাম দশম ওভারে, রান তখন ৪ উইকেটে ২৩। পরের ওভারে ফারুকও আউট, ৫ উইকেটে ২৬।”
“আমিও শুরুতে ছন্দ পাচ্ছিলাম না। স্ট্রাগল করছিলাম। উইকেট-কন্ডিশনের সঙ্গে আরেকটা অস্বস্তি ছিল পোশাক। ঠাণ্ডার কারণে জার্সির নিচে, ট্রাউজারের নিচে বাড়তি পোশাক পরেছিলাম, নড়াচড়ায় অস্বস্তি ছিল। তবে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে করেই হোক, ভালো করতেই হবে। সহজে উইকেট দিয়ে আসব না।”
“অনেকেই জানেন, বিশ্বকাপ স্কোয়াডে আমি ছিলাম না শুরুতে। অনেক ঘটনার পর নেওয়া হয়। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেও বাইরে ছিলাম। পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সুযোগ পেয়ে ভালো করিনি। তাই জানতাম, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ভালো করতে না পারলে আর সুযোগ পাব না হয়তো।”
“প্রথম লক্ষ্য ছিল আমার, ব্লেইন আর বাটের স্পেল পার করে দেওয়া। সেটি পারলাম। প্রথম ১৫ ওভারে আমাদের কেবল দুটি বাউন্ডারি ছিল। দুর্জয়কে (নাঈমুর রহমান) কৃতিত্ব দিতেই হবে। ও উইকেটে গিয়ে কিছু শট খেলায় আমার চাপ কমে গিয়েছিল। ভালো একটি জুটি হলো আমাদের (৬৯ রানের)।”
“আমি আর দূর্জয় আলোচনা করছিলাম অন্তত দেড়শ রান করতেই হবে। এই কন্ডিশনে তাহলেই জয়ের সুযোগ থাকবে। কিন্তু দূর্জয় ও সুজন (খালেদ মাহমুদ) পরপর আউট হয়ে গেল (৭ উইকেটে ৯৬)। মনি ভাইকে (এনামুল হক) বললাম, উইকেটে থাকতে হবে। তার সঙ্গেও মোটামুটি একটা জুটি হলো।”
“আমি কোনো ঝুঁকি নেইনি। লক্ষ্য একটিই ছিল যে উইকেট দেব না। ব্লেইন, আসিম বাটকে দ্বিতীয় স্পেলেও উইকেট দেইনি। গ্যাভিন হ্যামিল্টনও খুব ভালো বল করছিল। সামাল দিয়েছি।”
“৪৫ ওভারের পর ফিফটি ছুঁয়েছি, আমার প্রথম ওয়ানডে ফিফটি। স্বস্তি পাচ্ছিলাম, দলের জন্য কিছু করতে পারলাম। তবে জানতাম কাজ শেষ নয়। ব্যাটসম্যান ছিল না আর, শেষ পর্যন্ত থাকতে চেয়েছি। পেরেছিলাম, ৬৮ রানে অপরাজিত ছিলাম। ৪৫ ওভারের পর কিছু শট খেলেছি। ১৮৫ রান করার পর আমাদের বিশ্বাস ছিল যে জিতব।”
“অনেকেরই মনে নেই, শেষ জুটিতে সেদিন ২১ রান তুলেছিলাম মঞ্জুকে নিয়ে (মঞ্জুরুল ইসলাম)। আমরা ম্যাচ জিতেছিলাম ২২ রানে। ওই জুটি তাই ম্যাচের প্রেক্ষাপটে ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাচে একটি উইকেটও নিয়েছিলাম।”
“ম্যাচ জয়ের পর খুব ভালো লাগছিল। বিশ্বকাপের আগে থেকে যা হচ্ছিল আমাকে নিয়ে, প্রচণ্ড চাপে ছিলাম ওই ম্যাচে। দেশের মানুষের জন্যও ম্যাচটি জেতা আমাদের দরকার ছিল। সেদিন হারলে বিশ্বকাপের উত্তেজনাই শেষ হয়ে যেত।”
“ম্যান অব দা ম্যাচ হওয়ার পর পুরস্কার বিতরণীতে ধারাভাষ্যকারের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পর নিজে থেকেই বললাম, ‘আমি কি আরেকটা কথা বলতে পারি?’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই, দা ফ্লোর ইজ ইওরস।’ তখন দেশের মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম বিশেষভাবে, তাদের কারণেই আমি বিশ্বকাপ খেলতে পেরেছিলাম।”
লারার উইকেট এবং আরও কিছু
“স্কটল্যান্ড ম্যাচের পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও ফিফটি করলাম। সেদিনও আউট হইনি। চেস্টার-লি-স্ট্রিটের উইকেটে ম্যাকগ্রা-ফ্লেমিং-জুলিয়ানদের খেলা, সঙ্গে শেন ওয়ার্নের মতো মাস্টার। অস্ট্রেলিয়ানরা অনেক প্রশংসা করেছিল। ওই লড়াইও আমার কাছে স্মরণীয়, ক্যারিয়ারের বড় একটা অর্জন।”
“আমি যেহেতু বোলিংও করতাম, এখানেও একটি লড়াইয়ের কথা বলছি। ওই বিশ্বকাপেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে ব্রায়ান লারাকে আউট করেছিলাম। বিশ্বকাপের আগেই লারা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অবিশ্বাস্য একটা সিরিজ খেলে এসেছে। সব প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ঙ্কর এক নাম।”
“আমরা রান বেশি করতে পারিনি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের টার্গেট বেশি ছিল না (১৮৩)। লারার উইকেট নেব, এরকম লক্ষ্য সত্যি বলতে ছিল না। চাওয়া ছিল, তাকে সহজে রান করতে দেব না। সে অবশ্য দ্রুতই রান করছিল। আমাকে দুটি চার মারল, একটি কাট করে, আরেকটি সুইপে। যেহেতু শট খেলছিল, একটা বল করলাম একটু টেনে। তার টাইমিংয়ে গড়বড় হলো, মিড অফে ক্যাচ।”
“অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাডাম গিলক্রিস্টকেও আউট করেছিলাম। সেটিও বলার মতো লড়াই। আমাকে টানা তিনটা বাউন্ডারি মারল। আমি তো ভাবলাম, সব বলেই চার মারে কিনা! পরের বলে বেরিয়ে এসে স্লগ করতে গিয়ে মিস করল। পাইলট খুব ভালো স্টাম্পিং করেছিল। তবে লারা তো লারাই, তার উইকেটই বেশি ভালো লেগেছিল।”
“আরেকটা ইনিংসের কথাও বলতে ইচ্ছে করছে। টেস্ট খেলার সৌভাগ্য হয়নি, সেটি ছিল ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচ। খুব ভালো দল ছিল ওদের, মাইকেল ভন, মার্ক রামপ্রকাশ, নিক নাইটরা খেলেছে। বোলিংয়ে ছিল ডমিনিক কর্ক, রিচার্ড জনসন, ইয়ান সলসবুরি, সবাই টেস্ট খেলেছে ইংল্যন্ডের হয়ে। ১০৪ বলে ৮১ রানের ইনিংস খেলেছিলাম ওই ম্যাচে, সম্ভবত বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে আমার সেরা ইনিংস।”