স্মরণীয় দ্বৈরথ: ব্রেট লির গোলায় হাবিবুলের রক্ষা

পেস বোলিংয়ে বরাবরই বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন হাবিবুল বাশার। পুল-হুক খেলতে ভালোবাসতেন। তার ব্যাটিং ছিল টাইমিং নির্ভর, গতিময় বোলিংও তাই উপভোগই করতেন। তবে একবার বেশ ভড়কে গিয়েছিলেন, যখন তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রেট লির আগুনে বোলিংয়ের আঁচ!

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 April 2020, 10:40 AM
Updated : 7 April 2020, 10:40 AM

গতিময় বোলিংয়ের সামনে সেবারই প্রথম খানিকটা অসহায়ত্ব অনুভব করেছিলেন হাবিবুল। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ধারাবাহিক আয়োজন, ‘স্মরণীয় দ্বৈরথ’-এ সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক তুলে আনলেন লির সঙ্গে তার সেই লড়াইয়ের স্মৃতি।

বাংলাদেশের সবসময়ের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন হাবিবুল। দেশের প্রথম টেস্ট ফিফটি এসেছিল তার ব্যাট থেকে। ৫০ টেস্ট খেলা দেশের প্রথম ক্রিকেটার তিনি, প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে করেছেন তিন হাজার রান। দেশের ব্যাটিংয়ের অনেক প্রথমই এসেছে তার হাত ধরে। কঠিন সময়ে দেশকে নেতৃত্বও দিয়েছেন সামনে থেকে। কিন্তু সেবার তাকে ভুগিয়েছিল লি আর অস্ট্রেলিয়ার বোলিং।

‘বিরক্ত হয়ে স্লেজিং শুরু করেছিল ব্রেট লি’

“বাংলাদেশের প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফর ছিল সেটি (২০০৩)। দ্বিতীয় টেস্ট ছিল কেয়ার্নসে। অস্ট্রেলিয়ার পেস আক্রমণে ছিল ব্রেট লি, গ্লেন ম্যাকগ্রা ও জেসন গিলেস্পি। তখন গিলেস্পিও অনেক জোরে বল করত। তবে লির গতি ছিল অন্য পর্যায়ের। সত্যি বলতে, অতটা গতিময় বোলিং জীবনে আগে কখনও খেলিনি।”

“প্রথম টেস্টেও (ডারউইনে) একই পেস আক্রমণ ছিল। ফিফটি করেছিলাম দ্বিতীয় ইনিংসে। তবে ডারউইনের উইকেট একটু ধীরগতির ছিল। কেয়ার্নসে এসে বুঝলাম গতি কাকে বলে। লির হাত থেকে যেন বের হচ্ছিল একের পর এক গোলা।”

“সত্যি বলতে, একটু ভয়ও কাজ করছিল। বল গায়ে লাগার ভয় নয়, আউট হওয়ার ভয়। মনে হচ্ছিল যে কোনো সময় আউট হয়ে যেতে পারি। ম্যাকগ্রাও ভোগাচ্ছিল। তবে সে মূলত বাড়তি বাউন্সেই ঝামেলা করছিল। কিন্তু লির গতির সঙ্গে মানিয়েই নিতে পারছিলাম না।”

“নরম্যালি আমি গতির কারণে পরাস্ত হয়েছি কমই। বরং গতি আমার ভালোই লাগত। কারণ আমি তো পেশিশক্তির ব্যাটসম্যান ছিলাম না। টাইমিং আর প্লেসমেন্টের ওপর খেলতাম। বলে গতি বেশি থাকলে সেটা কাজে লাগত আমার। কিন্তু সেদিন একের পর এক বলে পরাস্ত হচ্ছিলাম। ব্যাটে-বলেই করতে পারছিলাম না সেভাবে। বলের লাইন মিস করেছি সমানে। অনেক ডেলিভারিতে এমন হয়ছে, শট খেলার আগেই বল চলে গেছে কিপারের গ্লাভসে।”

“আমি ঠিক করেছিলাম, যতবারই পরাস্ত হই, উইকেট দিয়ে আসব না। পার করে দেব কোনোভাবে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞার কারণেই হয়তো টিকে থাকতে পারছিলাম। বেশ কিছু চারও মেরেছি। হান্নানের সঙ্গে ভালো একটা জুটিও হলো (দ্বিতীয় উইকেটে ১০৮, হান্নান সরকার করেছিলেন ৭৬)।”

“বিরক্ত হয়ে ব্রেট লি একসময় সমানে স্লেজিং শুরু করল। আমি কান দিতে চাইনি, যা ইচ্ছা বলুক। তবু কানে এসেছিল, অন্ধের মতো ব্যাট চালাচ্ছি, বল চোখে দেখছি না, এসব কিছু বলছিল সে। আমি নিজের কাজই করে গেছি।”

“ইনিংস অবশ্য খুব বেশি বড় করতে পারিনি। ফিফটির আগেই আউট হলাম (৬ চারে ৭৯ বলে ৪৬)। আসলে লি-গিলেস্পিদের পার করে দেওয়ার পর যখন লেগ স্পিনার স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল এলো বোলিংয়ে, একটু রোমাঞ্চপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। সেটাই কাল হয়েছিল। ফিরতি ক্যাচ দিয়ে আউট হয়ে গেলাম।”

“আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরি কিছু করেছি, ফিফটি তো কতই। কিন্তু ফিফটি না হওয়া ওই ইনিংসটির মূল্য আমার কাছে অনেক। যেভাবেই হোক, লির চ্যালেঞ্জ উতরাতে পেরেছিলাম!”

‘সবুজ উইকেটে স্ট্রিকের সুইং’

“চ্যালেঞ্জের কথা বলতে গেলে আসলে আরও অনেক মনে পড়ে যায়। আরেকটি ম্যাচের কথা না বললেই নয়। সেখানে গতি নয়, বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সুইং সামলানো।”

“টেস্ট খেলার জন্য আমাদের প্রথম সফর ছিল সেটি। প্রথম টেস্টে বুলাওয়ায়োতে আমি ভালো করতে পারিনি। দ্বিতীয় টেস্ট হারারেতে। ভালো করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। কিন্তু কাজটা ছিল কঠিন। উইকেট সবুজ ঘাসে ভরা!”

“ওই ধরনের ঘাসের উইকেটে খেলার অভ্যাস আমাদের একটুও ছিল না। সুইং বোলিং সামলানোর প্র্যাকটিস তো ছিলই না। অ্যান্ডি ব্লিগনট, ব্রাইটন ওয়াতামবাওয়া অনেক জোরে বল করেছিল। তবে স্ট্রিকের সুইং খেলাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। সে তখন বিশ্বের সেরা পেসারদের একজন। তার সিগনেচার আউট সুইঙ্গার তো ছিলই, ঘাসের উইকেটে ইচ্ছেমত সুইং করাচ্ছিল দুই দিকেই।”

“ওই টেস্টে তিনে ব্যাট করেছিল রোকন (আল শাহরিয়ার)। আমি পাঁচে খেলেছি। আমি শট খেলতে পছন্দ করতাম, সুইংয়ে আউট হওয়ার সুযোগ তাই ছিল আরও বেশি। এজন্যই ঠিক করেছিলাম, জেনুইন কোনো হাফভলি না পেলে সামনের পায়ে খেলব না বা ড্রাইভ করব না। ব্যাকফুটে খেলব, পেছনের পায়ে খেলা বলের জন্য অপেক্ষা করব।”

“পরিকল্পনা মোটামুটি কাজে লেগেছিল। দুই ইনিংসে ফিফটি করেছিলাম (৬৪ ও ৭৬)। প্রথম ইনিংসে স্ট্রিক-ব্লিগনটদের পার করে রেমন্ড প্রাইসের বলে (বাঁহাতি স্পিনার) বলে আউট হলাম। দ্বিতীয় ইনিংসে স্ট্রিকের বলেই।”

“মনে আছে, আমরা ভালোই লড়াই করেছিলাম। ম্যাচ বাঁচানোর একটু সম্ভাবনাও জাগাতে পেরেছিলাম। শেষ দিনে ৫ উইকেট ছিল আমাদের। আমি ৬৬ রান নিয়ে খেলছিলাম, দূর্জয় (নাঈমুর রহমান) ছিল সঙ্গে। বাইরে মনি ভাই (এনামুল হক), মুশফিক বাবুরা (মুশফিকুর রহমান) ব্যাটিং পারত। সম্ভাবনা তাই ছিল।”

“সকালে ট্রেভর চ্যাপেল (সেই সময়ের কোচ) আমাকে বললেন, ‘তোমার ওপর নির্ভর করছে আমরা ড্র করতে পারব কিনা। তুমি টিকে থাকলে পারব।’ দিনের শুরুটা ভালোই করেছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ পারিনি টিকতে। যে বলে আউট হলাম, খুব বেশি কিছু করার ছিল না। স্ট্রিকের ট্রেডমার্ক আউটসুইঙ্গার ছিল সেটি, মিডল স্টাম্পে পিচ করে বেরিয়ে গেছে ব্যাট ছুঁয়ে। ম্যাচ আর বাঁচাতে পারিনি আমরা।”