স্মরণীয় দ্বৈরথ: বাতাস আর বন্ডের সঙ্গে আমিনুলের লড়াই

সফরকারী দলগুলির জন্য বরাবরই বড় চ্যালেঞ্জ ওয়েলিংটনের বাতাসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। তারওপর সেখানে যদি সামলাতে হয় শেন বন্ডের গতি, সুইং আর বাউন্সের গোলা! ক্যারিয়ারের স্মরণীয় দ্বৈরথের কথা ভাবতে গিয়ে সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক আমিনুল ইসলামের মনে পড়ল সেই লড়াইয়ের স্মৃতি।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 April 2020, 10:50 AM
Updated : 6 April 2020, 10:50 AM

২২ গজে প্রতিটি মুহূর্তই একেকটি চ্যালেঞ্জ। কিছু লড়াই আর চ্যালেঞ্জ জয়ের গল্প তবু আলাদা করে দাগ কেটে থাকে হৃদয়ে। ক্যারিয়ারের সেই অধ্যায় নিয়েই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আয়োজন, ‘স্মরণীয় দ্বৈরথ।’ ধারাবাহিক এই আয়োজনের শুরু হলো বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুলকে দিয়ে। 

‘প্রতিপক্ষ যখন বাতাস আর বন্ড’

“আমি যে লড়াইয়ের কথা বলব, অনেক কারণেই ওই ম্যাচের কথা আলাদা করে মনে আছে। প্রথমত, আমাদের প্রথম বক্সিং ডে টেস্ট ছিল সেটি। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে, ওয়েলিংটনে। অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডের মতো দেশে বক্সিং ডে ম্যাচ মানে অনেক বড় উপলক্ষ্য। আমরা তখন কেবলই টেস্ট খেলা শুরু করেছি। নবীন একটি টেস্ট দল হয়েও বক্সিং ডে টেস্ট খেলতে পারা অনেক বড় ব্যাপার ছিল। বক্সিং ডে ম্যাচ বলেই গ্যালারি ছিল প্রায় পূর্ণ।”

“দ্বিতীয় কারণ, ওই টেস্টের জন্য আমার প্রস্তুতি খুব ভালো ছিল। আগের টেস্টে (হ্যামিল্টনে) যদিও খুব ভালো করিনি, তারপরও মানসিকভাবে তৈরি ছিলাম। প্র্যাকটিস খুব ভালো হয়েছিল। আরেকটা বড় ব্যাপার ছিল, নতুন ব্যাট। তখন মাত্রই আমার ব্যাট স্পন্সর হিসেবে পেলাম নিউবেরিকে। অর্ডার দিয়ে দারুণ একটি ব্যাট আনিয়েছিলাম। ১৬০-১৭০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কোম্পানির একজন ব্যাট দিয়ে গিয়েছিল আমাকে। ব্যাটের বিশেষত্ব ছিল, খুব হালকা। ব্যাডমিন্টন র‌্যাকেটের চেয়ে একটু ভারি, এতটা হালকা কিন্তু পাওয়ারফুল। নিউ জিল্যান্ডের গতিময় ও সুইং বোলারদের সামলানোর জন্য ওই ব্যাট।”

“টস হেরে আমাদের ব্যাটিংয়ে নামতে হলো। উইকেট ছিল সিমিং। আবহাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে। পেস বোলিংয়ের আদর্শ কন্ডিশন যাকে বলে। ম্যাচের তৃতীয় ওভারেই ক্রিস কেয়ার্নস দুই উইকেট নিয়ে নিল (জাভেদ ওমর ও হাবিবুল বাশার)। চারে নামলাম আমি।”

“বাতাসের গতিবেগ ছিল তীব্র। মানিয়ে নেওয়াই কঠিন। ওয়েলিংটনে আমাদের অনেকের সেটি ছিল দ্বিতীয়বারের অভিজ্ঞতা। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর নিউ জিল্যান্ডে গিয়ে কিছু প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছিলাম আমরা। কিন্তু ওয়েলিংটনে অনেকবার সফরে গিয়েও বাইরের দেশের অনেকে মানিয়ে নিতে হিমশিম খায়। আমাদের জন্যও কাজটি ছিল কঠিন।”

“কিউই পেসাররা বরাবরই এখানকার বাতাসকে কাজে লাগায় দারুণভাবে। যথারীতি কন্ডিশন আর নিজেদের স্কিল মিলিয়ে কিউই পেসাররা দুর্দান্ত বোলিং করছিল। শেন বন্ড, ক্রিস কেয়ার্নস আর ক্রিস ড্রামকে নিয়ে ছিল পেস আক্রমণ। ড্যানিয়েল ভেটোরির মতো বোলারকেও তখন মনে হচ্ছিল তুলনামূলক সহজ, অন্তত গতি আর সুইং সামলানোর চ্যালেঞ্জ তো নেই!”

“সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অবশ্যই বন্ডকে খেলা। তার কোনো কোনো স্পেল ছিল, মনে হয় না, একটি বলও ৯০ মাইলের নিচে করেছে। সঙ্গে দুই দিকে সুইং তো ছিলই। তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল ইনসুইঙ্গিং বাউন্সার ও ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কার। সামনে খেলতে চাইলে বাউন্সারের শঙ্কা, পেছনে গেলে ইয়র্কারের ভয়।”

“আমি ঠিক করেছিলাম, যত পারা যায় বল ছাড়ব। একান্তই না পারা ছাড়া কোনো বল ব্যাটে খেলব না। বলের পর বল ছেড়েছি। নাকে বাতাস লাগিয়ে, জার্সি ছুঁয়ে, হেলমেট ঘেঁষে কত বল যে গেল! গায়েও লেগেছে অনেক। কিন্তু হাল ছাড়তে চাইনি।”

“মনে আছে, এক পর্যায়ে আমার মনোসংযোগ ব্যাঘাত ঘটাতে অ্যাডাম প্যারোরে (কিউই উইকেটকিপার) ‘ফ্যাট লেডি’ বলে স্লেজিং করে যাচ্ছিল ক্রমাগত। ‘ফ্যাট লেডিরা’ যেমন নড়াচড়া করতে চায় না, সেরকম বোঝাতে চেয়েছে আর কী। আমি তবু চেষ্টা করেছি স্রেফ পরের বলটায় মনোযোগ দিতে।”

“প্রায় তিন ঘণ্টা ছিলাম উইকেটে (১৭৫ মিনিট)। ৪২ রান করেছিলাম (১৩৪ বল, ১ চার)। আউট হয়েছিলাম বন্ডের বলেই। খুব বড় ইনিংস নয়, কিন্তু আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ইনিংসগুলোর মধ্যে ওপরে থাকবে। তাই তৃপ্তিও বেশি।”

এবং ‘স্পেশাল মেনশন’

“আরেকটি ইনিংসের কথাও এই সুযোগে বলতে চাই। বাংলাদেশের দ্বিতীয় টেস্ট সেটি, দেশের বাইরে প্রথম। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বুলাওয়ায়ো টেস্ট (২০০১ সালে)। উইকেটে চার ইঞ্চির মতো ঘাস ছিল। জিম্বাবুয়ের পেস আক্রমণে হিথ স্ট্রিক, অ্যান্ডি ব্লিগনট, ব্রাইটন ওয়াতামবাওয়া ও মলুলেকি এনকালা।”

“স্ট্রিক তখন বিশ্বের সেরা পেসারদের একজন। ব্লিগনট দুর্দান্ত গতিময়। ওয়াতামবাওয়া অনভিজ্ঞ হলেও গতিময় ও আগ্রাসী। সেখানেও টস হেরে আমাদের আগে ব্যাটিংয়ের চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। অপি (মেহরাব হোসেন) ও সুমন (হাবিবুল বাশার) আউট হওয়ার পর আমি নেমেছিলাম (২ উইকেটে ৩০ রান)।”

“ওই ইনিংসেও আমার লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব বল ছেড়ে দেওয়া। ৫ ঘন্টার মতো ছিলাম উইকেটে (২৮৭ মিনিট, ২০০ বল)। ৮৪ করেছিলাম। ক্যারিয়ারের প্রথম দুই টেস্টেই সেঞ্চুরি হয়নি অল্পের জন্য(ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ১৪৫)। তবে লড়াই করতে পারার আনন্দটা ছিল।”

“আমরা টেস্ট খেলার আগে খুব বেশি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাইনি। প্রস্তুতি নিতে হয়েছে তাই নিজে নিজেই। একসময় আমি প্রচুর শট খেলতাম মোহামেডান, বিমানের হয়ে। কিন্তু পরে টেস্টের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতেই শট খেলা কমিয়ে দিয়েছিলাম। নিজের সহজাত খেলার সঙ্গে অনেক আপোস করেছিলাম। নেটে, প্র্যাকটিসে লম্বা সময় টিতে থাকার চেষ্টা করতাম। টেস্ট খেলা শুরু করার পর বাদ দিয়ে দেবে, এই শঙ্কা থাকত সবসময়। প্রতিটি টেস্টই আমার জন্য ছিল একরকম টিকে থাকার লড়াই। এজন্য আরও চেষ্টা করেছি মনোসংযোগ বাড়াতে, লড়াই করতে।”

“কিছুদিন আগে একটা ব্যাটিং সেমিনারে ছিলাম সাবেক ভারতীয় ব্যাটসম্যান প্রাভিন আমরের সঙ্গে। আমরে ছেলেদের বলছিল, ‘ব্যাটিংয়ের জন্য তিনটি ব্যাপার সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, সেগুলোর মধ্যে সবার ওপরে হলো বল ছাড়তে শেখা।’ পেছন ফিরে তাকালে, ওই ইনিংস দুটি আমাকে আলাদা তৃপ্তি দেয় অনেক বল ছাড়তে পারার কারণেই।”