‘প্র্যাকটিসের পোশাকে এসে ইমরান বললেন, মাঠের বাইরেই টস করি’

টস হয়েছিল মাঠের বাইরে। এক অধিনায়ক এসেছিলেন অনুশীলনের পোশাকে। কোনো আম্পায়ারও ছিল না টসের সময়। এখন পাড়ার ক্রিকেটেও এসব হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে হয়েছিল এসবই। স্মৃতির আয়নায় তাকিয়ে ওই ম্যাচের আরও অনেক চমকপ্রদ গল্প শোনালেন সেই ম্যাচের বাংলাদেশ অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 March 2020, 02:44 PM
Updated : 30 March 2020, 05:05 PM

১৯৮৪ সালের সাউথ-ইস্ট এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১৯৮৬ এশিয়া কাপে সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কায় সেই টুর্নামেন্ট দিয়েই শুরু হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পথচলা। ৩১ মার্চ অভিষেক ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। সেই দিনটির ৩৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে মঙ্গলবার।

আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ সেই যুগে বাংলাদেশের জন্য ছিল চরম প্রার্থিত। কালেভদ্রে সুযোগ মিলত। সেই সময়ে গাজী আশরাফের অলরাউন্ড সামর্থ্য ও নেতৃত্বগুণ ফুটিয়ে তুলতে যথেষ্ট একটি তথ্যই; বাংলাদেশের প্রথম ৭ ওয়ানডেতেই তিনি ছিলেন অধিনায়ক।

তবে প্রথম ম্যাচ হৃদয়ে বিশেষ জায়গা নিয়ে থাকেই। দেশের ক্রিকেটের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হওয়ার দিনটিতে তিনিই ছিলেন অধিনায়ক, এই গৌরব গাজী আশরাফকে আন্দোলিত করে এখনও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় গাজী আশরাফ ফিরে তাকালেন সেই দিনে।

‘স্মৃতি অমলিন’

“তখন তো জাতীয় দলের খেলা বেশি ছিল না। সিরিজ-টিরিজ থাকলে অধিনায়ক করা হতো। তবে ১৯৮৫ সাল থেকেই আমি দলের অধিনায়ক ছিলাম। ১৯৮৬ এশিয়া কাপেও অধিনায়ক হিসেবে যাওয়াটা তাই নিজের কাছে খুব অপ্রত্যাশিত ছিল না।”

“আমার নিজের জন্য অবশ্যই অনেক বড় ব্যাপার ছিল ওই ম্যাচ। তবে তার চেয়ে বড় ছিল দেশের জন্য। দলের জন্য। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ, একটা মাইলফলক। নিজের জন্য অনেক বড় সম্মান ছিল তো বটেই।”

“রোমাঞ্চ-উত্তেজনা আমাদের যথেষ্টই ছিল। তার চেয়ে বেশি ছিল ভাবনা, কীভাবে খেলব, এত বড় বড় ক্রিকেটারদের সামলাবো। অবশ্যই তখন জয়ের ভাবনা ছিল না। আমাদের চাওয়া ছিল, খুব ভালো লড়াই করা।”

“প্রথম ম্যাচ পাকিস্তানের বিপক্ষে, দারুণ শক্তিশালী ছিল ওরা। টুর্নামেন্টের ফেভারিট। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, টসে হেরে গেলাম।”

“ইমরান খান, মহসিন খান, ওয়াসিম আকরাম, মুদাসসর নজর, ওরা তখন অনেক বড় তারকা। ইমরান তো তারকাদের তারকা। সত্যি বলতে, দুরু দুরু বুকেই টস করতে এগিয়ে গেলাম।”

“ইমরান যখন টস করতে এলেন, বুঝে উঠতেই পারছিলাম না তিনি তৈরি কিনা। কারণ তার পরনে প্র্যাকটিসের পোশাক! আমি তো ম্যাচের পোশাকেই ছিলাম। যাই হোক, তিনি বললেন, ‘টস করার জন্য উইকেট পর্যন্ত এত দূর কষ্ট করে যাওয়ার দরকার নেই, এখানেই করি!’ ব্যস, মাঠের বাইরেই হলো টস।”

“তখন টসের সময় আম্পায়ার থাকার বাধ্যবাধকতাও ছিল না। অধিনায়করা টস করে গিয়ে আম্পায়ারদের বলে আসতেন। টিভি সম্প্রচার ওই আসরে হয়েছিল সীমিত আকারে। টস দেখায়নি টিভিতে। কোনো আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার তাই ছিল না।”

“উইকেট খুব ভালোভাবে ঢেকে রাখা হতো না। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। উইকেটে তাই আর্দ্রতা ছিল যথেষ্টই। আমাদের চাওয়া ছিল আগে বোলিং করা। কিন্তু টস হেরে আগে ব্যাটিংয়ে নামতে হলো। ওদের শক্তিশালী পেস আক্রমণের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সেটি। ড্রেসিং রুমে ফিরে টস হারার কথা বলার পর সবাই স্বাভাবিকভাবেই একটু হতাশ হয়েছিল।”

“কেউ অবশ্য ভড়কে যায়নি। আমরা লড়াই করতে চেয়েছিলাম। তবে বাস্তবতা হলো, স্কিল, অভিজ্ঞতা, সব বাস্তবতা মিলিয়ে ওদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলাম আমরা অনেক। একটা উদাহরণ দেই। আমাদের সবার তখন চেস্ট গার্ডও ছিল না। হেলমেটের গ্রিল ছিল না সবার। পাকিস্তানী পেসারদের খেলতে হবে বলে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে চেস্ট গার্ড খুঁজলাম। ওদের বোর্ডের সহায়তায় একটি দোকান থেকে চেস্টা গার্ড কিনলাম। ওই ম্যাচেই জীবনে প্রথমবার চেস্ট গার্ড পরে খেলেছে আমাদের অনেকে। স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তি ছিল।”

“ইমরান-আকরামরা দারুণ বোলিং করে আমাদের অল্পতেই আউট করে দিল। আমি তিনে নেমে তিন বল খেলতে পেরেছিলাম। ওয়াসিম আকরাম তখন অনেক জোরে বল করত। তৃতীয় বলটা দিল হাফ ভলি মতো। আমি ভাবলাম, রান করার সুযোগ। পজিশনে গিয়ে ড্রাইভ করলাম, ভাবলাম রান পাব। একটু পর একটা শব্দ শুনলাম। বুঝলাম স্টাম্প গেছে! বলটা আসলে খুব শার্প সুইং করে ভেতরে ঢুকেছিল।”

“আমাদের শহীদ (শহীদুর রহমান) খুব ভালো লড়াই করেছিল (৬০ বলে ৩৭)। অনভিজ্ঞ ছিল অনেক, কিন্তু পুল-হুক ভালো খেলত। একশ হয়নি তবু আমাদের (৯৪)। ওরা জিতে গেল ৭ উইকেটে। তবে বোলিংয়ে আমরা ভালোই লড়াই করেছিলাম। বাদশা ভাই (জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা) দারুণ বোলিং করেছিলেন (৯-১-২৩-২)। তিনি অবশ্য সবসময়ই লড়াকু ছিলেন। কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না।”

“বোলিংয়ে আমি একটি উইকেট পেয়েছিলাম। কাট করতে গিয়ে কটবিহাইন্ড হয়েছিল জাভেদ মিয়াঁদাদ। আমার অবশ্য পরের ম্যাচের (শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে) উইকেটের কথা বেশি মনে পড়ে। রয় ডায়াসকে আউট করেছিলাম। ডায়াসের তখন বাজে সময় চলছিল, আউটও হলো বাজে শটে। হাফ ভলি মতো ছিল, তবে একটু লাফিয়ে উঠেছিল। ডায়াস ক্যাচ দিয়েছিল স্লিপে। সে আমার খুব প্রিয় ব্যাটসম্যান ছিল। দারুণ আগ্রাসী ও সাহসী। উইকেট পাওয়ার পর ভালো লাগার পাশাপাশি একটু খারাপও লাগছিল।”

“আমাদের প্রথম ম্যাচের আগের একটি ঘটনাও খুব মনে পড়ে। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে পাত্তাই পায়নি শ্রীলঙ্কা। আমাদের সেদিন প্র্যাকটিস ছিল। দেখি, ম্যাচ হারার পর সেদিনই লঙ্কান ক্রিকেটারদের অনেকে আমাদের মাঠে চলে এসেছে প্র্যাকটিস করতে। রোশান মাহনামাকে বাউন্সার সামলানোর প্র্যাকটিস করানো হচ্ছিল। স্পিনে আগ্রাসী ব্যাটিং প্র্যাকটিস করছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। মনে হচ্ছিল, তারা কিছু করতে চায়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে ফাইনালে হারিয়ে ওরাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।”

“তখন ক্রিকেট এখনকার মতো এতটা বাণিজ্যিক ছিল না। আমরা ফাইনালে না উঠলেও আমাদেরকে রেখে দেওয়া হয়েছিল, যেন ফাইনাল দেখে শিখতে পারি ও অভিজ্ঞতা নিতে পারি। এখন হলে, বাদ পড়ার পর সেদিনই বা পরদিনই পাঠিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু তখনকার সংগঠক-আয়োজকরা অনেক কিছু ভাবতেন। ছোটখাটো করে একটা উদ্বোধনী আয়োজনও ছিল। যার যার দেশের পতাকা তুলে ধরতে পেরেছিলাম আমরা। তখন ক্রিকেটের একটা গভীরতা ছিল, ক্রিকেট সংস্কৃতির চর্চা ছিল।”

“সেবার ১০-১২ দিন ছিলাম শ্রীলঙ্কায়। খুব ভালো সময় কেটেছে। কিছু কিছু ব্যাপার এখনও মনে দাগ কেটে আছে। তখন হোটেলের সব খাবার নারকেল তেল দিয়ে রান্না হতো, আমরা তাই বাইরে খেতে যেতাম বাসে করে। বাসের সামনে ‘বাংলাদেশ’ লেখা বোর্ড থাকত। রাস্তায় লোকজন জড়ো হতো বাস দেখে, অনেক সম্মান করত। অনেক জায়গায় আমাদের অটোগ্রাফ নিয়েছে, দারুণ মর্যাদা দিয়েছে। আমরা এত নবীন দল, তারপরও সব জায়গায় অনেক সম্মান দিয়েছে। এটা আজীবন মনে থাকবে।”

“মাঠের বাইরে দারুণ সময় কেটেছে আমাদের। তাজ সমুদ্র হোটেলের উল্টো দিকে গল ফেইস এলাকায় আমরা বিকেলে-সন্ধ্যায় বসে আড্ডা দিতাম। ফারুক, নান্নুদের মতো যারা তরুণ যারা ছিল, আমরা, সামি ভাই (সামিউর রহমান), সুরু ভাই (গোলাম ফারুক), বাদশা ভাই, সবাই আমরা একসঙ্গে বসে গল্প করতাম। সাগরের ঢেউ দেখা, গল্প, মজা, গান করা, সব মিলিয়ে খুব উপভোগ্য সময় ছিল।”