চলে গেলেন দেশের ক্রিকেটের দুঃসময়ের কাণ্ডারি

শুরুর দিকে যখন টালমাটাল ছিল দেশের ক্রিকেট, তখন তিনি হাল ধরেছেন শক্ত হাতে। অসংখ্য প্রতিকূলতা পেরিয়ে যারা দেশের ক্রিকেটকে দাঁড় করিয়েছেন শক্ত ভিতে, তিনি তাদেরই একজন। সেই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ের অন্যতম সেনানী রেজা-ই-করিম আর নেই। রোববার ভোরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেছেন।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 March 2020, 07:30 AM
Updated : 22 March 2020, 08:16 AM

দীর্ঘদিন ধরেই নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। কিডনি দুটিই ছিল প্রায় অকেজো। অবশেষে চলে গেলেন ৮১ বছর বয়সে। বাদ জোহর জানাজার পর তার দাফন হবে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিভিন্ন ভূমিকায় ছিলেন রেজা-ই-করিম। একসময় খেলেছেন। খেলোয়াড়ী জীবনেই যাত্রা শুরু করেছেন সংগঠক হিসেবে। ছিলেন প্রথম বিভাগ লিগের সচিব। ক্রিকেট বোর্ডের প্রথম গঠনতন্ত্র তৈরির সময় ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। এছাড়াও নানা সময়ে ছিলেন বোর্ডের কোষাধ্যক্ষ, যুগ্ম-সম্পাদক ও সহ-সভাপতি। বিভিন্ন সময়ে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ম্যানেজার, নির্বাচক। কাজ করেছেন আম্পায়ার হিসেবেও, পরিচালনা করেছেন আম্পায়ার্স বোর্ড।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে যখন ছোট্ট একটি ঘরে ছিল ক্রিকেট বোর্ড, তখন থেকেই কাজ করেছেন রেজা-ই-করিম। সেই ঘরে তখন ছিল না বিদ্যুৎ সংযোগ। তারা কাজ করতেন মোমবাতি জ্বালিয়ে। পরে তাদের উদ্যোগে বিদ্যুৎ এলেও প্রায়ই সংযোগ কেটে দেওয়া হতো বিল পরিশোধ করতে না পারায়। ছিল আর্থিক অনটন ও নানা প্রতিবন্ধকতা। সেই সময়ে লড়াই করে তারা দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়েছেন।

রেজা-ই-করিমের জন্ম ১৯৩৯ সালে কলকাতায়। চাকরির সুবাদে তার বাবা থাকতেন সেখানেই। ১৯৪২ সালে বাবা তাদেরকে রেখে যান চাঁদপুরে। দেশ বিভাগের পর চট্টগ্রাম রেলওয়ের হেড অফিসে যোগ দেন চিফ অডিট অফিসার হিসেবে। চট্টগ্রামে তার ক্রিকেট জীবনের শুরু। তারা গড়েছিলেন স্টার ক্লাব, যেখানে পরে খেলেছেন সেই সময়ের অনেক নামি ক্রিকেটার। তার সংগঠক হওয়ার শুরুও সেই ক্লাব থেকেই।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় করেন বিএসসি ও এমএসসি। ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক আরও পোক্ত হয় তখন। ছিলেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান, প্রয়োজনে করতেন উইকেটকিপিংও। ঢাকা প্রথম বিভাগে খেলেন সেই সময়ের অন্যতম সেরা ক্লাব ঈগলটসে। পরে চাকরির সুবাদে খেলেন কমার্স ব্যাংকের হয়ে।

ঈগলটসে খেলার সময়ই সংগঠক হিসেবে ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। ক্রমে খেলোয়াড় পরিচয় ছাপিয়ে সেটিই হয়ে উঠেছে বড়। পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলার স্বপ্ন ছিল তার, কিন্তু সংগঠক হিসেবে এতটাই অপরিহার্য হয়ে ওঠেন যে নিজের খেলার স্বপ্ন একসময় বিসর্জন দিতে হয়।

স্বাধীনতার আগে নানা ভূমিকায় সম্পৃক্ত ছিলেন দেশের ক্রিকেটে। স্বাধীনতার পর পুরোনো কমিটির কাউকে রাখা হয়নি, তাকেও রাখা হয়েছিল দূরে। পরে ১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৩-৭৪ মৌসুমে পরপর ঢাকা লিগ শেষ করতে না পারায় তাকে অনুরোধ করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিস ক্রিকেটের দায়িত্ব নিতে। অভিমান করে তখন তিনি দায়িত্ব নেননি। তবে বেশিদিন দূরে থাকতেও পারেননি। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে শুরু করেন লিগ কমিটির সচিব হিসেবে। এরপর আর পেছনে তাকাননি।

ক্রিকেট বোর্ডের সম্পদ বলতে তখন ছিল একটি টেবিল-চেয়ার ও একটি স্টিলের আলমারি। কোনো কিছু টাইপ করাতে হলেও যেতে হতো ফুটবল ফেডারেশনে। সেখান থেকে সূচি বা বাইলজ টাইপ করিয়ে তিনি নিজে ক্লাবে ক্লাবে ঘুরে দিয়ে আসতেন কাগজপত্র। ছিল না একজন অফিস সহকারিও। অনেক সীমাবদ্ধতায় কাজ করেই তারা দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়েছেন আজকের রমরমা অবস্থার পথে।

বাংলাদেশের আইসিসির সদস্যপদ পাওয়ার পেছনে তার ছিল অনেক অবদান। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে এসেছিল মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি), বিদেশি কোনো দলের প্রথম বাংলাদেশ সফর ছিল সেটি। সেই সফরের আমন্ত্রণপত্রটি ছিল তারই লেখা।

এমসিসির সফরের আগে ইংল্যান্ড সিরিজ কাভার করতে ভারতে এসে ব্রিটিশ সাংবাদিক রবিন মার্লার ঘুরে গিয়েছিলেন ঢাকা থেকেও। এখানকার ক্রিকেটের অবস্থা দেখে নিজের পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট অস্তগামী।’ পরে রেজা-ই-করিম কড়া ভাষায় মার্লারকে চিঠি লিখে করেছিলেন প্রতিবাদ, বলেছিলেন সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার কথা। মার্লার পরে অনেকভাবে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে।

১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম আইসিসি ট্রফির দলে তিনি ছিলেন সহকারী ম্যানেজার। এরপর ম্যানেজার, নির্বাচক হিসেবে কাজ করেছেন নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত।

ক্রিকেট বোর্ডে দীর্ঘদিন তার সঙ্গে কাজ করেছেন বিসিবির বর্তমান পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম। তার স্মৃতিচারণায় উঠে এলো রেজা-ই-করিমের অবদান।

“বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়েছেন রেজা ভাই, দেশের ক্রিকেটে উনার অবদান বলে শেষ করার মতো নয়। বিভিন্ন ভূমিকায় উনার দায়িত্ব পালন করার কথা তো অনেকেই জানেন। এর বাইরেও ছোট ছোট কিছু কাজ করেছেন, যা আসলে ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একসময় এমসিসির বাইলজ আসত না দেশে, তখন উনিই বাইলজ করেছেন। তার করা অনেক প্লেয়িং কন্ডিশন অনুযায়ী খেলা হয়েছে অনেক বছর।”

“পরে এমসিসির বাইলজ আনার ব্যবস্থা করেছেন। সবার সুবিধার জন্য তার উদ্যোগে আমরা এসব বাংলায় বুকলেট আকারে ছাপিয়েছি। এছাড়াও আবাহনী-মোহামেডানের মতো অনেক বড় ম্যাচে সমর্থকদের ভয়ে অনেকে আম্পিায়ারিং করতে চাইত না, রেজা ভাই নিজেই দাঁড়িয়ে যেতেন। তার সিদ্ধান্ত নিয়ে কখনও সংশয় জাগেনি। ঢাকার ক্রিকেটে বিদেশি ক্রিকেটারদের খেলার ব্যবস্থা উনি করে দিয়েছেন, দেশের ক্রিকেটের মান বেড়েছে তাতে।”

১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকেই বদলে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের গতিপথ। সেই সাফল্যের পেছনেও রেজা-ই-করিমের অবদানের কথা বললেন আহমেদ সাজ্জাদুল আলম।

“১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি হয়েছে মালেয়েশিয়ায়, আড়াই বছর আগে আমরা জানতে পারি অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলা হবে। তখন আমরা বাইরে থেকে সেই টার্ফ নিয়ে আসি। তিনটি টার্ফ বসানো হয় বিকেএসপি, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও আবাহনী মাঠে। দুই বছর লিগের খেলা হয়েছে সেই টার্ফে, আইসিসি ট্রফিতে সাফল্যের পেছনে বড় অবদান ছিল সেটির। সেখানেও উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন রেজা ভাই।”

“সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন সত্যিকারের সংগঠক ও আপাদমস্তক জেন্টলম্যান। ক্রিকেট বোর্ডে যখন চা পর্যন্ত কিনে খেতে হতো, সেই দিনগুলি থেকে আজকের পর্যায়ে আনার পেছনে তার অবদান অনেক। একসময় বাংলাদেশের ক্রিকেট বলতে রেজা ভাই, রাইস ভাইদেরই (সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাইস উদ্দিন আহমেদ) বুঝতাম। তারা দেশের ক্রিকেটের ভিত গড়ে দিয়েছিলেন বলেই আজকের এই সুরম্য অট্টালিকা।”