সাড়ে ৫ বছরের এই সময়টায় মাশরাফির হাত ধরে অনেক স্বপ্ন ধরা দিয়েছে বাস্তব হয়ে। কখনও রচিত হয়েছে রূপকথা। দল ছুটে চলেছে সাফল্যের পথ ধরে। মাশরাফি তার কাণ্ডারি। দেশের ক্রিকেটে ছুঁয়েছে নতুন উচ্চতা। মাশরাফিও পা রেখেছেন জনপ্রিয়তার চূড়ায়। নায়ক থেকে হয়ে উঠেছেন মহানায়ক। অধিনায়ক থেকে হয়েছেন নেতা।
হতাশার আঁধারও কিছু এসেছে এই সময়ে। তবে পেছন ফিরে তাকালে, রঙিন পোশাকে আলো ঝলমলে সময়টুকুর ঔজ্জ্বল্যই যথেষ্ট চোখ ধাঁধিয়ে দিতে। তামিম ইকবাল যেমন বলেছেন, এই দেশের ক্রিকেটের জন্য মাশরাফির অবদান, কখনও কারও ভোলার নয়।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভীষণ দুঃসময়ে বোর্ড তাকিয়েছিল তার দিকে। তিনি দেশের ক্রিকেটকে রাঙিয়েছেন সুসময়ের রঙে। সাফল্য বুভুক্ষু ক্রিকেট জাতিকে এনে দিয়েছেন অভাবনীয় সব সাফল্যের স্বাদ।
জিম্বাবুয়েকে ৫-০তে হারানো দিয়ে সাফল্য রথ ছোটার শুরু। দেশের ক্রিকেটের ওই সময়ের অবস্থায় জিম্বাবুয়েকে সব ম্যাচে হারানোর বিশ্বাসও ছিল না। অধিনায়ক মাশরাফি বিশ্বাস ফেরালেন। অধিনায়ক মাশরাফি স্বপ্ন দেখাতে শেখালেন। অধিনায়ক মাশরাফি আকাশ ছোঁয়ার মন্ত্র সতীর্থদের হৃদয়ে গেঁথে দিলেন। অসম্ভবগুলো তখন বাংলাদেশ সম্ভব করা শুরু করল অনায়াস অভিযানে!
সে এক জাদুকরী সময়। কিন্তু কোনো জাদুর কাঠি ছিল না মাশরাফির। ছিল ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্ক, নিবেদিতপ্রাণ মানসিকতা, দলকে উজ্জীবিত করার অনন্য দক্ষতা, পারিপার্শ্বিকতা ও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের সামর্থ্য। ক্রিকেট মাঠে তার কৌশল চমকে দিয়েছে প্রতিপক্ষকে। মাঠের বাইরে তার প্রাণশক্তি চাঙা রেখেছে দলকে। মাঠে সেসবের প্রভাব কাজ করেছে জাদুমন্ত্রের মতো।
যে কোনো সিরিজ মানেই তার রুম অঘোষিত ক্লাব ঘর। যে ঘরের দরজা ২৪ ঘণ্টা খোলা, দলের সবার অবারিক যাতায়াত। তুমুল আড্ডা, কখনও তাস পেটানো, হাসি-মজার কারখানা যেটি, পারস্পরিক সম্পর্কের মিথস্ত্রিয়া জমে উঠত যেখানে, কখনও প্রতিপক্ষকে বধের ছক কাটা, সব মিলিয়ে অধিনায়কের রুম যেন প্রাণের মেলা!
এভাবেই দলকে করে তুলেছেন এককাট্টা। ক্রিকেটারদের কাছে তার একটিই পরিচয়, ‘ভাই’, সবাই ‘ভাই’ বললেই বুঝে যেতেন কার কথা বলা হচ্ছে। তবে শুধু বড় ভাই নয়, মাশরাফি সতীর্থদের কাছে ছিলেন বড় নির্ভরতা। মাহমুদউল্লাহর ভাষায়, ‘মাশরাফি অসাধারণ মানুষ, তার চেয়েও অসাধারণ অধিনায়ক।”
সাফল্যের পথ ধরেই এসেছে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। ক্রিকেট মাঠ বা ক্রিকেটের গণ্ডি ছাপিয়ে তার আবেদন ছুঁয়েছে দেশের সব সীমানা। ক্রিকেটের ক্যানভাস থেকে হয়ে উঠেছেন জীবন ক্যানভাসের নায়ক।
অধিনায়কত্ব জীবনের উল্টো ছবি এরপরই দেখতে শুরু করেছেন মাশরাফি। সমালোচনার শূলে চড়ানো হয়েছে তাকে। ক্রিকেট অনুসারী বা সংবাদমাধ্যই শুধু নয়, এমনকি বোর্ড কর্তাদের কথায়ও ছিল প্রচ্ছন্ন অপমান। স্বয়ং বোর্ড সভাপতির কথা নানা সময়ে ছিল বিভ্রান্তিকর। দীর্ঘ প্রায় ৭ মাস কোনো ওয়ানডে ছিল না বাংলাদেশ দলের, মাশরাফিকে নিয়ে আলোচনার তবু শেষ ছিল না। এই জিম্বাবুয়ে সিরিজও শুরু হয়েছিল অনেক প্রশ্ন ও কৌতূহলকে সঙ্গী করে। সিরিজ শেষের আগে তিনি মেটালেন কৌতূহল।
নেতৃত্বগুণ, ব্যক্তিত্ব ও সার্বিক প্রভাবের কারণে অনেক সময়ই আড়ালে পড়ে থাকে তার বোলিং। অথচ অধিনায়কত্বের এই সময়টায় দলের সেরা পারফরমারদের একজন হয়েও ছিলেন বরাবরই। এই দফায় অধিনায়ক হওয়ার পর তিনি দলের দ্বিতীয় সফলতম বোলার (৯৫ উইকেট, এই সময়ে মুস্তাফিজের উইকেট ১০৮টি)।
শুক্রবারের ম্যাচ দিয়ে থামছে অধিনায়ক মাশরাফির পথচলা। সামনে দিনগুলোতে হয়তো বোলার মাশরাফির কাছ থেকে মিলবে আরও অনেক কিছু। ভিন্ন ভূমিকায় হয়তো আরও সমৃদ্ধ করবেন দেশের ক্রিকেটকে। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে তিনি যে ছাপ রেখেছেন, যতটা গভীরে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট যতদিন থাকবেন, মাশরাফি বরাবরই থাকবেন নেতৃত্বের শেষ কথা। মাশরাফি থাকবেন ‘ভাই’ হয়ে। থাকবেন নেতার প্রতিশব্দ হয়ে!